মাতবরদের বর্বরতার শিকার দম্পতি

ময়মনসিংহ: ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় অবৈধ সম্পর্কের মিথ্যা অভিযোগে গ্রাম্য সালিশ বসিয়ে মাথা ন্যাড়া করে জুতার মালা পরিয়ে নির্দয়ভাবে মারপিট করা হয়েছে এক হিন্দ্র দম্পতিকে। এ ছাড়া ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পরিশোধের আলটিমেটাম দেয়া হয়েছে হতদরিদ্র ওই স্বামী-স্ত্রীকে।

গত বুধবার (১৬ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১২টায় উপজেলার রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের হাতিলেইট বিলপাড়া গ্রামে দেড় শতাধিক গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে বর্বরোচিত ওই ঘটনা ঘটে। মাতবরদের কারণেই গণমাধ্যমকর্মীরা তিনদিন পর খবর পান।

এদিকে, ঘটনার পর থেকেই কয়েস চন্দ্র বর্মণ (৩৫) ও লক্ষ্মী রানি বর্মণ (৩০) নামে স্বামী-স্ত্রীকে এক ঘরে করে রাখা হয়েছে। এ দম্পতির দুই প্রতিবন্ধী মেয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া বৃষ্টি বর্মণ (১০) ও ছোট মেয়ে বিউটি বর্মণ (৮) কেঁদেই চলেছে। বাড়ি থেকে বের হতে না দেয়ায় মারপিটে অসুস্থ কয়েস বর্মণের চিকিৎসা চলছে বাড়িতেই।

কয়েস বর্মণ হাতিলেইট বিলপাড়া গ্রামের মান্দাই জনগোষ্ঠীর মিত্র মোহন বর্মণের ছেলে। প্রায় ১৮ বছর আগে ঘাটাইল উপজেলার ফকির চালা গ্রামের লক্ষ্মী রানি বর্মণকে (৩০) বিয়ে করেন।

ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সালিশের নেতৃত্বদানকারী মতবরদের দ্রুত গ্রেপ্তারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন এলাকার জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা। এলাকাবাসী ও পরিবার জানায়, হাতিলেইট বিলপাড়া গ্রামের কয়েস ও লক্ষ্মী রানি দম্পতি দরিদ্র হলেও তারা সুখে শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিল।

গেল বৃস্পতিবার থেকে তাদের একঘরে করে রাখা হয়েছে। প্রকাশ্যে সালিশে বাবা-মাকে নির্যাতনের সময় মেয়ে বৃষ্টি বর্মণ হাউমাউ করে কান্নাকাটি করে। বাবা-মায়ের মাথার চুল না কাটতে অনুরোধ জানালে মাতব্বরের রক্তচক্ষুর শাসানিতে অবুঝ শিশুটি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে।

স্থানীয়রা জানায়, বছর খানেক আগে বাক্কুর চালা গ্রামের ইবির আলীর সঙ্গে কয়েস বর্মণের বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়। এ সুবাদে একে অপরের বাড়িতে মাঝে মধ্যেই যাওয়া আসা করেন। গেল বুধবার (১২ এপ্রিল) দুপুরে লক্ষ্মী রানি ইবির আলীর বাড়িতে বেড়াতে যান। এতে মান্দাই পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের মাতববরা ক্ষেপে ওঠেন।

এ ঘটনায় রাতেই মান্দাই জনগোষ্ঠীর চন্দন বর্মণ, রূপচান, নরেন, পাইলট, পরেশ, কালি মহন বর্মণসহ আরো তিনচারজন মিলে মিত্র মোহন বর্মণের বাড়িতে সালিশ ডাকেন। সালিশে লক্ষ্মী রানির বিরুদ্ধে ইবির আলীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের অভিযোগ তোলা হয়। দীর্ঘ সালিশ বৈঠকে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবুও মাতবরা সালিশে কয়েস ও লক্ষ্মী রাণীকে বেদম মারপিটের পর মাথা ন্যাড়া করে, জুতার মালা পরিয়ে দেয়। এরপর ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হয়।

লক্ষী রানী বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমাদের বিনা অপরাধে এক ঘরে করে রাখা হয়েছে। এখন বলছে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে।

রাঙামাটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি এহেন মানবাধিকার লংঘনের তীব্র নিন্দা জানান এবং অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান করবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেছেন।

ভুক্তভোগী দম্পতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি মনে করে যে কোনো প্রকার হুমকি-ধামকি মোকাবেলায় এলাকাবাসীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান সালিনা চৌধুরী। তিনি বলেন, ঘটনাটি দুঃখজনক। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওই পরিবারকে সাহায্য করেছি। ঘটনার সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা চলছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ সাবেক এক মেম্বারের ইন্ধনে ঘটনাটি ঘটেছে আবার সেই মেম্বারই ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে ব্যাপক তদবির চালাচ্ছে। ফুলবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিফাত খান রাজিব বলেন, এ ব্যাপারে কেউ অভিযোগ করেননি।



মন্তব্য চালু নেই