মাছের মেলায় অশ্লীল নৃত্য, জুয়ার আসর

‘পানে জর্দ্দা যেমন ঘুরায়-ফিরাই খাইরে চিবাইয়া/দেখনা খিলি কেমন/নে না তর ঠোঁটে রাঙ্গাইয়া/লাল লাল জাম্বুরা/কে কে খাবি তোরা/খাইলে মনে হবে ঠিক যেন রসগোল্লা।’ এমন গানের শুরুতেই সস্তা মেকাপে নদী নামে ২০-২১ বছরের এক তরুণী মঞ্চে উঠেই শরীরে থাকা মিনি স্কাটটি খুলতে শুরু করেন। পাশে মাইক্রোফোন হাতে থাকা যুবকটি তাকে পোশাক খোলতে সহযোগিতার পাশাপাশি গলা ফাটিয়ে জানান দিচ্ছেন, ভাই চলে আসুন, শেষ হতে চলছে ঢাকাইয়া মডেল নদীর ঝুঁমুর ঝুঁমুর নাচ। আগে আসলে পাকা আম পাবেন, চালু চালু টিকেট কিনুন আপনাদের সামনে টিকেট কাউন্টার খোলা আছে। সাহেবের চেয়ার ২শ’ টাকা আর বাংলার মাটি ১শ’ টাকা। আসুন আসুন।

শুরু হলো দ্বিতীয় গান। গাছে আম ধরেছে/কাঁচা আম ওরা বুঝি পাঁকতে দেবে না/আমি বেড়া দিয়েও পোলাপানদের যন্ত্রণায় আর শান্তি পাচ্ছি না।’ এমন গানে আবারও শুরু হলো একই দৃশ্য।

বৃহস্পতিবার রাতে দেশের বৃহৎ শেরপুরের মাছের মেলার পুতুল নাচের প্যান্ডেলের ভেতরে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে। শুধু অশ্লীল নৃত্য নয়। পাশাপাশি বাইরের দিকে বসেছে শত শত জুয়ার আসর।

সরেজমিনে দেখা যায়, হিন্দু সম্প্রদায়ের পৌষ সংক্রান্তিকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও কুশিয়ারা নদীর তীরে মৌলভীবাজারের শেরপুরে বুধবার থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী মাছের মেলা। কিন্তু নামে মাছের মেলা হলেও কাজে জুয়া আর অশ্লীল নৃত্যের আসর বসিয়েছে আয়োজকরা। অশ্লীল নৃত্যের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে টিনশেড দিয়ে তৈরি অর্ধশতাধিক ঘর। এসব ঘরে উঠতি বয়সী মেয়েদের নিয়ে নগ্ন নৃত্য পরিবেশনসহ নাচ গানের পর শেষ রাতে দর কষাকষির মধ্যমে চলছে দেহ ব্যবসা। জুয়ার জন্য খোলামেলাভাবে বসেছে শত শত আসর। পাশাপাশি মদ, গাজা, হেরোইন ও ফেনসিডিলের বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে।

অশ্লীল নৃত্য প্রদর্শনীর টিকিটের অধিকাংশই উঠতি বয়সী তরুণদের হাতে দেখা যায়। টিকিটের মূল্য ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা ধরা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ঢগায় এমন অসামাজিক কর্মকাণ্ড চললেও প্রশাসন দেখে না দেখার ভান করছে। মেলাস্থল থেকে ৫০ গজে দূরে রয়েছে পুলিশ ক্যাম্প।

এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, পুলিশ প্রশাসন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অপকর্মের পাহারাদার হিসেবে কাজ করছে। সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে নাম মাত্র টাকা দিয়ে মেলা ইজারা এনে প্রশাসনের উদাসীনতায় দুই বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী মেলায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যাত্রাদলকে পুতুল নাচের অনুমতি দিয়ে থাকে ইজারাদাররা। আর এসব যাত্রাদল এবং জুয়ার আসর থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। পুতুল নাচের প্রতিটি প্যান্ডেল থেকে মেলা কমিটি এবার অগ্রীম ৬০-৭০ হাজার টাকা করে নিয়েছে। প্রতিটি জুয়ার আসর থেকে ২০-২৫ হাজার টাকা করে অগ্রীম নেয়া হয়েছে।

মেলায় আসা সাংবাদিক এম মছব্বির আলী, মাহবুবুর রহমান রাহেল, বিশ্বনাথের মোহাম্মদ আলী শিপন, সৈয়দ বয়তুল আলীসহ অনেকই জানান, তারা মেলায় এসেছিলেন মাছ কেনার জন্য। কিন্তু এখানে এসে যা দেখলেন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ইজারাদার ধিক্কার দিয়ে তারা বলেন, এসব অসামাজিক কার্যকলাপের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে খাওয়ার চেয়ে পান্তা ভাত খেয়ে বেঁচে থাকাই ভালো।

পুতুল নাচের দলের প্রধানরা জানান, প্রতিটি প্যান্ডেল থেকে অগ্রীম ৭০ হাজার টাকা করে নিয়ে গেছেন ইজারাদারসহ তাদের সহযোগীরা। প্রতিটি জুয়ার আসরের মালিকদের কাছ থেকে অগ্রীম নিয়েছে ২৫ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে মেলাকে কেন্দ্র করে আয়োজকদের কোটি টাকা আয় হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যবসায়ীরা জানান, প্রশাসনের সহযোগিতায় ইজারাদাররা যেমন খুশি মেলায় অশ্লীলতাসহ অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। এ যেন দেখার কেউ নেই।

এ ব্যাপারে মেলার ইজারাদার দলের প্রধান মিজানুর রহমান মিজানের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বৃহস্পতিবার একাধিকবার ফোন দেয়া হলেও তার ব্যবহৃত ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, ‘শেরপুরের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় যাতে কোনো অসামাজিক কার্যকলাপ না হয় এজন্য প্রশাসনের প্রতি জোর সুপারিশ করেছি।’

তবে শেরপুর পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবু সাঈদ বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় যাতে কোনো ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ না হয় সেজন্য আমরা সব সময় তৎপর রয়েছি। গত দুই দিনে একাধিকবার অভিযান চালিয়ে জুয়া ও অশ্লীল নৃত্যের আসর ভেঙে দিয়েছি।’

উল্লেখ্য, শেরপুরের কুশিয়ারা নদীর তীরে প্রায় ২শ’ বছর ধরে মাছের মেলা চলে আসছে। কালের ধারাবাহিকতায় এ মেলা এখনও প্রতি বছর পৌষ সংক্রান্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। তবে মাছের মেলাটি হিন্দু ধর্মাবলম্বী থেকে এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। বুধবার রাত থেকে শুরু হওয়া এ মেলা চলবে শুক্রবার পর্যন্ত।-বাংলামেইল



মন্তব্য চালু নেই