মহাসড়কে লাশের মিছিল : তিন দিনে ৩৮ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু
হঠাৎ করেই মহাসড়কে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। মাত্র তিন দিনেই মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন অন্তত ৩৮ জন। এর মধ্যে রোববার (১২ ফেব্রুয়ারি) নরসিংদীতে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন। এর আগে গত শুক্রবার রাতে ফরিদপুরে আরেকটি সড়ক দুর্ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। গত শুক্রবার থেকে রোববার পর্যন্ত ঢাকা, নরসিংদী, ফরিদপুর, গাজীপুর, নাটোর ও মাগুরায় মোট সাতটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩৮ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পাশাপাশি আহত হয়েছেন আরো প্রায় ১০০ জন।
এদিকে গত এক যুগে সারা দেশে সাড়ে ৫১ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ২২৬। আহত হয়েছেন ৯৩ হাজার ৫০৬।
বিআরটিএর হিসাবে, দেশে ১৩ লাখের বেশি অবৈধ চালক রয়েছেন। এসব চালকের কাছে যানবাহন ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকরা। এমন বাস্তবতায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মৃত্যু প্রতিরোধে মহাসড়কে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নেই। মহাসড়কে গড়ে প্রতি মিনিট পরপর একটি গাড়ি আরেকটিকে পাশ কাটিয়ে (ওভারটেকিং) এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।
রোববার নরসিংদীর বেলাবো উপজেলায় বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মাইক্রোবাসের ১২ যাত্রী নিহত হয়েছেন; আহত হয়েছেন বাসযাত্রীসহ ২৯ জন। নিহতরা হলেন- কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামের মানিক মিয়া (৪৫), তার স্ত্রী হালিমা বেগম (২৬), শ্যালিকা জুম্মা বেগম (১৬), ছেলে ইল্লা (৮), অন্য পরিবারের মানিক মিয়া (৪৫), তার স্ত্রী মাফিয়া (৩৫), ছেলে অন্তর (১০) এবং হিরা মিয়া (৩৫), আমেনা বেগম (৩২), জান্নাত (৩৫), নাজমুল (১০) ও শারমিন (১৮)। বাসটি ভৈরব থেকে ঢাকা যাচ্ছিল। আর মাইক্রোবাস ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যাওয়ার পথে দড়িকান্দি এলাকায় যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়।
ফরিদপুরের নগরকান্দায় গত শুক্রবার রাতে গ্যাস সিলিন্ডারবাহী কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে বেপরোয়া গতির যাত্রীবাহী বাসের সংঘর্ষের পর আগুন ধরে যায় দুটি গাড়িতেই। এতে পুড়ে মারা গেছেন ১৩ জন। এ দুর্ঘটনায় দগ্ধ ও আহত হয়েছেন ৩৩ জন।
গত শনিবার রাত ১টার দিকে রাজধানীর মিরপুরে ফরহাদ (২০) নামের এক যুবক বাসের ধাক্কায় নিহত হন। শনিবার ভোর রাতে যশোর-মাগুরা সড়কের শেখপাড়া নামক স্থানে দুর্ঘটনায় একই পরিবারের তিনজনসহ চার ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর আরপি গেট এলাকায় গত শুক্রবার রাতে সড়ক দুর্ঘটনায় সাবেক সেনাসদস্যসহ তিনজন নিহত হয়েছেন।
এ ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অধীন চক্রবর্তী এলাকার নবীনগর-চন্দ্রা সড়কে শনিবার রাতে যাত্রীবাহী বাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে বাসের দুই যাত্রী নিহত হন।
নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার আইড়মারি সেতু এলাকায় বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে শনিবার ভোরে একটি ট্রাক অপর একটি ট্রাককে ধাক্কা দিলে দুজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার হারোয়া গ্রামের আবদুল হাকিমের ছেলে শহীদ হোসেন (৪০) ও টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চর তেঁতুলিয়া গ্রামের মৃত কোরবান আলীর ছেলে ফুলচাঁদ আলী (৩৮)। রাজশাহীর পুঠিয়ায় শনিবার ট্রাকের ধাক্কায় বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তার নাম আবদুর রাজ্জাক (৫৯)।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমাদের যারা চালক, হেলপার প্রায়ই লেখাপড়া জানেন না। আমার মনে হয়, একটা লেভেল পর্যন্ত শিক্ষিত না হলে চালক বা হেলপার হওয়া যাবে না এরকম ব্যবস্থাও আমাদের করতে হবে। আমরা সে ব্যাপারেও চিন্তাভাবনা করছি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে, গত কয়েক দিনের দুর্ঘটনার মূল অনুষঙ্গ বেপরোয়া গতি। চালকরা বেপরোয়া গতিতে এবং একের পর এক পাল্লা দিয়ে যান চালানোর কারণেই দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে।
এক যুগের দুর্ঘটনার চিত্র : সারা দেশে গত ১২ বছরে সাড়ে ৫১ হাজার সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ২২৬। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে পাঁচ হাজার ৯৯৭টি। যাতে আট হাজার ৭৯৮ জন নিহত ও ১৮ হাজার ১১৩ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা ঘটেছে বিদায়ী বছর ২০১৬ সালে দুই হাজার ৯৯৮ জন। এসব দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা তিন হাজার ৪১২ ও আহত আট হাজার ৫৭২। যাত্রী ও সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংগঠনের গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সড়ক দুর্ঘটনার ওপর জরিপ ও পর্যবেক্ষণ চালিয়ে বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) এই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে সারা দেশে ৫১ হাজার ৬৬৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে চার হাজার ৫৯২টি। এতে নিহত ও আহতের সংখ্যা যথাক্রমে ছয় হাজার ৮২৩ ও ১৪ হাজার ২৬। ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা দুই হাজার ৯৯৮। এতে তিন হাজার ৪১২ নিহত ও আট হাজার ৫৭২ জন আহত হন। এই হিসাবে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনা কমেছে এক হাজার ৫৯৪টি। নিহত ও আহতের সংখ্যা কমেছে যথাক্রমে তিন হাজার ৪১১ ও পাঁচ হাজার ৪৫৪ জন। অর্থাৎ ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনার হার ৩৫ শতাংশ, নিহতের হার ৫০ শতাংশ ও আহতের হার ৩৯ শতাংশ কমেছে।
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা নেই বলেই দুর্ঘটনা বাড়ছে। এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সবাই একযোগে কাজ করলে সুফল মিলবে। তিনি বলেন, সড়ক নিরাপত্তা শুধু মুখে মুখেই। বাস্তবে কর্মসূচি নেই বললেই চলে। পাশাপাশি দক্ষ চালক বৃদ্ধি, জনসচেতনতা বাড়ানো, কঠোর আইন প্রয়োগ, চালকদের শাস্তি বৃদ্ধি নিশ্চিত করলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে বলেও মনে করেন তিনি।
১৩ লাখ চালক অবৈধ : বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী মোট সড়কের দৈর্ঘ্য ২০ হাজার ৯৪৭.৭৩ কিলোমিটার। সারা দেশে এসব সড়কে চলাচলের জন্য গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত নিবন্ধিত যানবাহন ২৯ লাখ ১৮ হাজার ১১০টি। এর মধ্যে বাসের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৪০২টি। কার্গো ভ্যান সাত হাজার ৮৩টি। মাইক্রো ৯১ হাজার ৮৪৬টি। মিনিবাস ২৭ হাজার ৪১৫টি। কাভার্ডভ্যান ২০ হাজার ৬৩৯টি, ডেলিভারি ভ্যান ২৫ হাজার ৭টি, এক লাখ ২২ হাজার ৫৮৪টি ট্রাক, তিন লাখ ১০ হাজার প্রাইভেটকার, ট্যাক্সিক্যাব ৪৫ হাজার, ট্যাংকার চার হাজার ৫৬৭টি ছাড়াও আছে অন্যান্য পরিবহন। এসব গাড়ির জন্য লাইসেন্সধারী ড্রাইভারের সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। অর্থাৎ দেশে ১৩ লাখ মোটরযান চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই। যাদের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিসার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক শামসুল হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ভুয়া লাইসেন্স কিংবা বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালিয়ে আসছে একশ্রেণির অদক্ষ চালক। এসব চালকের অধিকাংশেরই ব্যস্ততম সড়কে গাড়ি চালানোর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ নেই। যে কারণে সড়ক ও মহাসড়কে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর কোথাও সরকারি পরিবহন অথরিটি চালক তৈরি ও যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করে না। এটি বেসরকারিভাবে পরিচালিত হয়। আমাদের দেশেও বিআরটিএর নির্দিষ্ট জনবল দিয়ে বিশাল কাজ নিখুঁতভাবে করা সম্ভব নয়। বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। বিআরটিএর পরিবহন রেজিস্ট্রেশনের বিপরীতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকের সংখ্যা অনেক কম।
মন্তব্য চালু নেই