মহানবী (সাঃ ) এর ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন নিয়ে বিতর্কিত পত্রিকার সাফাই গাইলেন তসলিমা

মহানবী (সাঃ ) এর ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন ছাপানো নিয়ে যখন পুরো মুসলিম বিশ্ব প্রতিবাদে সরগরম ঠিক তখন ব্যাঙ্গ চিত্র প্রকাশকারী পত্রিকা শার্লি আবদোর এর ‘সাফাই’ গাইলেন বাংলাদেশের বিতর্কিত নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম  ফেসবুকে এই লিংকে নিজের মন্তব্য জানিয়ে এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, – বেশ কয়েক বছর আগে শার্লি আবদোর সম্পাদক এবং এক ঝাঁক কার্টুনশিল্পী আমাকে তাদের অফিসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্যারিসের যে কোনও ছোটখাটো পত্রিকা অফিসের মতোই শার্লি আবদোর অফিস। কার্টুনিস্টদের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বাক স্বাধীনতার পক্ষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওদের লড়ে যাওয়াটা অনেকটা আমার লড়ে যাওয়ার মতো। ফতোয়া আসছে, মুত্যুর হুমকি আসছে, কিন্তু ওরা থামছেন না। যা বলতে ইচ্ছে করছে, তা বলছেন।

মৌলবাদীরা শাসিয়ে গেছে ইসলাম নিয়ে কোনও কটু কথা বললে ওদের জবাই করবে, তারপরও ওরা কটু কথা বলছেন। পয়গম্বরের কার্টুন আঁকলে খুন করবে, তারপরও আঁকছেন। আগুন-বোমা পড়লো অফিসে, আল কায়দার ওয়ান্টেড লিস্টে নাম উঠলো, তারপরও ম্যাগাজিন বন্ধ করলেন না ওরা। চমৎকার মানুষ ওই কার্টুনিস্টরা। হাসাতে যেমন জানেন, হাসতেও জানেন প্রচণ্ড। ওঁরা কেউই ঈশ্বরে, মৌলবাদে, সন্ত্রাসে আর সহিংসতায় বিশ্বাস করেন না। আমি যেমন। ফতোয়া, নিষেধাজ্ঞা, নির্বাসন কিছুই আমাকে ভাঙতে পারেনি। ওরা আমার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।

ওরা বাস করেন সর্বোচ্চ গণতন্ত্রের দেশে, তাই নিজেদের নিয়ে দুশ্চিন্তাটা ওঁ

দের অতটা ছিল না। আমি কি আর বুঝেছি তখন যে, কোনও একদিন এই অফিসেই বন্দুক হাতে এক দল সন্ত্রাসী ঢুকে ওঁদের সবাইকে এক এক করে নৃশংসভাবে হত্যা করবে! আমি কি আর বুঝিছি তখন যে, আসলে পৃথিবীর কোনও দেশই, কোনও অঞ্চলই এখন আর নিরাপদ নয়। সন্ত্রাসীরা সর্বত্র বিরাজ করছে।

শার্লি আবদো বন্ধ হবে না। বন্ধ হয়ে গেলে, বা কার্টুনিস্টরা ভয় পেলেই জিতে যাবে সন্ত্রাসীরা। শুনে ভালো লাগছে যে শার্লি আবদোর পরবর্তী সংখ্যাটা ছাপা হবে দশ লক্ষ কপি। শার্লি আবদোর প্রকাশই মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে, এবং ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিপক্ষে একটি বিশাল আন্দোলনের মতো। সন্ত্রাসী হওয়ার জন্য দক্ষতার দরকার হয় না। অটোমেটিক রাইফেল চালিয়ে মানুষ মারতে কোনও প্রতিভার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু সাংবাদিক বা কার্টুনশিল্পী প্রতিভা ছাড়া হওয়া যায় না। এতগুলো প্রতিভাকে নিতান্তই অসভ্য, অশিক্ষিত আর বর্বর কিছু লোক হত্যা করেছে তাদের কাল্পনিক ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য, অথবা বেহেস্তবাসী হওয়ার জন্য।

শার্লি আবদোর কার্টুনিস্টদের মেরে ফেলেছে ইসলামী সন্ত্রাসীরা, এই খবর পাওয়ার পর থেকে আমি শোক স্তব্ধ বসে রয়েছি। আমার কেবল মনে হচ্ছে, ঠিক এভাবে একদিন আমাকেও মেরে ফেলবে ওরা। আমি হয়তো কোনও কবিতা বা উপন্

Image2

যাস লিখতে থাকবো, আর অতর্কিতে আমার ঘরেও ঢুকে ওরা আমাকে জবাই করবে, নয়তো মাথা লক্ষ করে গুলি করবে, ‘আল্লাহু আকবর’ বলতে বলতে। কেবলই মনে হচ্ছে, প্যারিসের মতো শহরে নিরাপত্তা রক্ষী থাকার পরও যদি খুনের ঘটনা ঘটে যায়, তাহলে দিল্লিতে না ঘটার কোনও তো কারণ নেই। যত দুশ্চিন্তাই করি না কেন, আমার লেখা কিন্তু বন্ধ হবে না। ঠিক যেভাবে শার্লি আবদোর কার্টুনের মতো কার্টুন আঁকাও বন্ধ হবে না।

পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের বেশির ভাগই বেশির ভাগ সময় মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেন, যতই সন্ত্রাস মুসলিমরা করুক না কেন। পাশ্চাত্যের লিবারেল ট্রাডিশান রক্ষা করাটা তাঁদের দায়িত্ব বলেই মনে করেন। মুসলিমরা সংখ্যালঘু বলে , আফগানিস্তানে, ফিলিস্তিনে, ইরাকের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধে মুসলিমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে, সম্ভবত একটা সহানুভূতি কাজ করে। শার্লি আবদোর বুদ্ধিজীবীরা এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। ওঁরা কিন্তু কারও সঙ্গে আপোস করেননি। কোনও রাজনীতিবাদ, কোনও ধর্মগুরু, কোনও পয়গম্বর—কারও সঙ্গেই নয়। ক্রিশ্চান ধর্ম বা ইহুদি ধর্ম নিয়ে যেমন কটাক্ষ করেছেন, ইসলাম ধর্ম নিয়েও করেছেন। মাঝে মাঝে কার্টুনশিল্পীরা যীশু, মুসা এবং অন্যান্য পয়গম্বর নিয়ে কৌতুক করতেন, ইসলামের পয়গম্বর নিয়েও করতেন। বেশ বুদ্ধিদীপ্ত সেসব কৌতুক।

জানি প্রচুর লোক আজ শার্লি আবদোর পক্ষে দাঁড়াবে। তারা খুনীদের দিকে নিন্দা ছুড়বে এবং বলবে খুনীদের ইসলাম সত্যিকার ইসলাম নয়। সত্যিকার ইসলাম কোনও বিধর্মীকে বা নাস্তিককে খুনের ইন্ধন জোগায় না। ইসলাম শান্তির ধর্ম ইত্যাদি। কেউ কিন্তু বলবে না কোরানের সুরা আল বাকারা, আল নিসা, আল আনফাল, আল তওবা এরকম অনেক সুরায় ইসলামে-অবিশ্বাসীদের কতল করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে মুসলিমদের উপদেশ দেওয়া হয়েছে বিধর্মীদের হত্যা করার জন্য। । অজস্র অগুনতি হাদিসও বলেছে একই কথা। মুসলিম হওয়ার শর্ত, কোরানে অর্থাৎ আল্লাহর বাণীতে নিঃশর্ত বিশ্বাস।

ইসলামের ইতিহাস বলে ইসলামের পয়গম্বর প্রচুর যুদ্ধ করেছেন। আরবের বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর লোককে তখন ইসলাম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হত। বানু কোরাইজা নামের এক ইহুদি গোষ্ঠীর আটশ পুরুষকে হত্যা করা হয়েছিল, শুধু তারা মুসলিম ছিল না বলে। সন্ত্রাসের মাধ্যমে ইসলাম বিশ্বময় ছড়িয়েছে। এখন যদি পয়গম্বরের অনুসারীরা পয়গম্বরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সন্ত্রাস করে পৃথিবীতে, আমরা অবাক কেন হবো! অন্যান্য ধর্মকে যেমন যুগোপযোগী করা হয়েছি, ইসলামকে করা হয়নি। ইসলাম রয়ে গেছে ১৪০০ বছর আগের ইসলামের মতোই।

মুহম্মদের অনুসারীরা সত্যিকার ইসলামে বিশ্বাস করে, তারা বিশ্বাস করে পুরো পৃথিবীতে তারা সত্যিকার ইসলামী সাম্রাজ্য তৈরি করবে, যে সাম্রাজ্যে সত্যিকার মুসলিম ছাড়া আর কারওর ঠাঁই নেই। তারা বিশ্বাস করে, সেই ১৪০০ বছর আগের ইসলামের মতোই, যে, ইসলাম নিয়ে যে মানুষই কটাক্ষ করবে, তাদের মেরে ফেলার অধিকার তাদের আছে। আজ পৃথিবীতে সন্ত্রাস করে বেড়াচ্ছে আল কায়দা, আইসিস, বোকো হারাম, আল শাবাব ইত্যাদি সন্ত্রাসী দল। সবারই আদর্শ এক এবং অভিন্ন। আল্লাহ এক এবং মুহম্মদের দেখানো পথই সত্যিকার ইসলামের পথ।

ইসলামী মৌলবাদী কোনও ছোটখাটো সমস্যা নয়। এই বড় সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে মূলে যেতে হবে। মত প্রকাশের অধিকারের বাণী শুনিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সন্ত্রাসীরা কী মন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে, কী মন্ত্র তাদের শেখাচ্ছে অস্ত্র হাতে নিতে, মানুষ খুন করতে, জানতে হবে।

আমার মনে হয়, যতদিন ইসলাম অপরিবর্তিত বা অবিবর্তিত থাকবে, ততদিন সন্ত্রাস থাকবে।

আবারো বিশ্বনবীর কার্টুন ছাপাবে ‘শার্লি এবদো’



মন্তব্য চালু নেই