মনে রাখিস, আমি একটা বেশ্যা…

শারমিন শামস্: আমি একটা বেশ্যা। কী ভড়কে গেলেন তো! জী, ঠিকই শুনেছেন। আমার চালচলন, বলন, ধরণ, পোষাক-আশাক, কথা, লেখা কোন কিছুই ভালো না। আমি রাস্তা দিয়ে সিনা টান করে চলি। আমি পথের ধারে দাঁড়িয়ে গ্যাজাই, চা-পানি খাই, আমি রাত-বিরাতে রিকশার হুড ফালায়ে ঘুরি, কখনো ইচ্ছা হইলে মদ-টদ খাই, খাইয়া বমিও করি, যখন যা ইচ্ছা তেমন পোশাক পিন্দি। সেইসব পইরা আবার ফটোও তুলি। ফেইসবুকে দেই।

আমার চিকন স্লিভ ডিপ নেক লাইনের সেইসব ছবি দেখে লোকজনের মাথা ঘুরে। তারা ছবি দেখে আর কান ঘুসঘুসানি করে। তারপরে ধরেন গিয়া আমি আজেবাজে কথা লিখি, একবার লিখছিলাম, রেপ করতে এলে পুরুষাঙ্গ কেটে দিব। তো সেই লেখা ভাইরাল হয়ে গেল। তারপরে বহু লোকে আমারে কে ক্যামনে রেপ করবে তার প্রকাশ্য বর্ণনা দিতে লাগলো।

তারা বললো, আমি বেশ্যা। তো বেশ্যারে রেপ করাই যায়। তাই তারা করবে। তারা ধরেই নিয়েছে সকলের পুরুষাঙ্গ কাটা হবে। আসলে আমি তো সেটা বলি নাই। কারণ আমি ভাবছিলাম, সবাই রেপিস্ট না। পরে বুঝলাম, সবাই রেপিস্ট। ঘুমিয়ে আছে রেপিস্ট মামা সব পুরুষের অন্তরে।

তো যাই হোক, আমার লেখার বিষয় খারাপ। আমার ছোটকালের বান্ধবী আমারে বলছে, ‘তোর উইমেন চ্যাপ্টারের লেখাগুলো ভালো না। বেশি বিদ্রোহী। অন্যখানে যা লিখিস, সেগুলো ভালো’। তো তার মনে হইসে, মেয়ে হয়ে আমি বেশি তড়ফরাইতেসি। তো আমারে তো বহু লোকেই যাচাই করে।

চোখ দিয়ে, মুখ দিয়ে, লেখা দিয়ে, পোশাক দিয়ে। আমি খারাপ। আমি বেশ্যা। এরকমটা ভাবার লোকের অভাব নাই। তো বেশ্যারে রেপ করা যায়। এটাই এই সুশীল সমাজের নিয়ম। কেন এই নিয়ম? অথবা কেন আমি বেশ্যা? অথবা কেন আমার উপর ক্ষেপলেই দলবেঁধে একপাল পুরুষ সবার আগে আমারে রেপ করার হুমকি দেয়? আমি জানিনা।
রেপ কি তাইলে পুরুষের মূল অস্ত্র নারীর বিরুদ্ধে? রেপ তো আমরা সবাই হইছি। ছোটকাল থেকেই হইছি। যৌনকর্ম করলেই শুধু রেপ হয়? চোখ দিয়া রেপ হয় না? ধর্ষণ কি শুধু পুরুষাঙ্গের? চোখ, হাত, পা, মুখ, কনুই, বুক, পিঠ- কোনটা দিয়া ধর্ষণ করে না পুরুষ এই দেশে?

আজ তনুরে নিয়া যে হাহাকার, এই হাহাকার আগে হয় নাই কেন? এখন হইলো ক্যান? হইলো কারণ তনু সহানুভূতি জাগাইতে পারছে। তনুর হিজাবে ঢাকা নিষ্পাপ মুখ সহানুভূতি জাগাইছে। হিজাব দেইখা সব পুরুষ দরদী হইয়া উঠছে। আহা রে! আমারে কেউ ধর্ষণ করলে এই সহানুভূতি আসতো না। সাথে সাথে আমার ফেইসবুক প্রোফাইল খুইলা আমার হাতা-কাটা, মিনি পরা ছবি বাইর কইরা অনলাইনে নিউজ হইতো। তারপর আমার রেইপ হালাল হইয়া যাইতো।
তবে, দুর্ভাগ্য, তনুরে নিয়া সহানুভূতি জাগছে কি জাগে নাই, তাতে কিছুই আর যায় আসবে না তনুর।

এই কুৎসিত সমাজ, বীভৎস পুরুষতন্ত্র আর আইনের শাসনহীন এই দেশ ছেড়ে কোথায় কোন অচিন দেশে চলে গেছে এই মেয়ে। আর ফিরবে না। সামাজিক নেটওয়ার্কে তনু আর তার হিজাব নিয়ে কথা চালাচালি চলছে। ভালো। একটা রক্তাক্ত প্রমাণ পাওয়া গেল যে হিজাবে কিছুই বন্ধ হয় না। হিজাব দিয়া রেপ ঠেকানো যায় না।

বরং হিজাব হইলো সেই বস্তু, যা চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখায়ে দেয়, তুই একটা খাবার। তুই একটা ঝলসানো মাংসের টুকরা। তুই একটা লালা ঝরানো আইটেম। হিজাব হইলো খাবার ঢাকার ঢাকনি। ঢাকনির নিচে খানাখাদ্য আছে। তাই ঢেকে রাখা লাগে।

যাই হোক। আমার সমাজে পুরুষেরা গরম বেশি পরলে তাদের ঠ্যাং বের করে খালি গায়ে রাস্তায় বাইর হয়। আমি একখান ছোট হাতার জামা পরলেই, আমি বেশ্যা। আমি একটা বড় গলার পোশাক পরলে আমি তাদের আহ্বান জানাইতেসি। তো, বেশ। আমি বেশ্যা। এবার বল, কী করবি? আমি আমার পছন্দের পোশাক পরবো, যা ইচ্ছা তাই বলবো, যখন ইচ্ছা বাইরে যাবো, যেভাবে ইচ্ছা দাঁড়াবো, বসবো, কথা বলবো।

যে সমাজ রাতের অন্ধকারে বেশ্যার দরজায় টোকা মারে আর দিনের বেলায় তারে দেখে থুতু ছিটায়, যে রাষ্ট্র নারী উন্নয়নের বুলি কপচায়ে কপচায়ে ফেনা তোলে কিন্তু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে না, যে গণমাধ্যম বিশেষ ক্ষমতাবান রেপিস্টের পুরুষাঙ্গের জোর দেখে কুঁকড়ে চুপ করে থাকে, সেই সমাজের মুখে আমার মত এরকম সহস্র বেশ্যা রেগুলার থুতু মারতেসে, আরো মারবে, মারতেই থাকবে। মনে রাখিস।



মন্তব্য চালু নেই