মনের অব্যক্ত কথা বললেন সেই খাদিজা, যা শুনলে চমকে উঠবেন আপনিও
একদম মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছেন খাদিজা নামের মেয়েটি। কথা বলতে পারার পর মনের অব্যক্ত কথা বললেন সেই খাদিজা, যা শুনলে চমকে উঠবেন আপনিও।
শুরুতে তাকে বলা হয় ‘আস্সালামু আলাইকুম। কেমন আছেন।’ কেবিনের বেডে হেলান দিয়ে বসে নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন খাদিজা বেগম। বেশ হাসি-খুশির সঙ্গে কুশল বিনিময় করছিলেন।
রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খাদিজার সর্বশেষ অবস্থা জানতে শুক্রবার সেখানে গেলে এরকমই হাসি-খুশি দেখা যায় খাদিজাকে। বেশ প্রাণবন্ত ও স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলছেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় খাদিজার সঙ্গে কথা হয়। বাড়ি যাওয়ার জন্য এখন ব্যকুল হয়ে আছেন তিনি। কবে যাবেন, জানতে চাইলে খাদিজা বলেন, ২০ তারিখ ভাই আসবে। তারপর বাড়ি যাব। ভাই বলেছে এসে বাড়ি নিয়ে যাবে।
এ সময় পাশে ছিলেন তার বাবা-মা ও খাদিজাকে দেখতে আসা অপর একজন। খাদিজার মা আমাদের আপেল এবং কমলা খেতে দেন। খাদিজাকে খেতে বললে তিনি বলেন, ‘একটু আগেও খেয়েছি।’ আমাদের অনুরোধে এক কোয়া কমলা তুলে মুখে দেন।
খাদিজার ডান হাতে কনুইয়ের নিচ থেকে ব্যান্ডেজ করা। এর মধ্য থেকে বের করা আঙ্গুল দিয়ে তিনি ধরতে পারছেন। বাম হাতেও ব্যান্ডেজ। বাম হাতের কি অবস্থা জানতে চাইলে তার বাবা মাসুক মিয়া খাদিজাকে বলেন, ‘দেখাও তো মা।’ তখন খাদিজা বাম হাত একটু উঁচু করে দেখান। আঙ্গুলগুলোও নাড়িয়ে দেখান।
একটু পরে খাদিজা নিজেই তার এক নিকটাত্মীয়কে ফোন করে তার কুশল জানতে চান। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন তার সঙ্গে। মাথায় বা কানের কাছে সেলাই থাকার কারনে মোবাইল কানের কাছে না নিয়ে তিনি ভিডিও কলে লাউডস্পিকারে কথা বলেন।
খাদিজা জানান, এখন তিনি নিজে ফোন দিতে এবং রিসিভ করতে পারেন। ফোন নিজে হাতে ধরে কথা বলেন। তবে তা বেশি সময় করলে হাতে ব্যথা হয়ে যায়।
হাসপাতালে খাদিজার পাশে প্রায় এক ঘণ্টা ছিলেন প্রতিবেদক।
এই সময়ের মধ্যে তার মুখের হাসি একটুও মলিন হতে দেখা যায়নি। খাদিজার বাবা মাসুক মিয়া বলেন, মেয়ের দূর্ঘটনা শুনে দেশ-বিদেশ থেকে স্বজন ও পরিচিতজনদের অনেকে ফোন করে কান্নকাটি করেছেন। দোয়া করেছেন। কেউ কেউ ওমরাহ করেছেন তার জন্য। এখন তাদের সবাইকে ফোন করে মেয়ের সাথে কথা বলিয়ে দেই। তারা এতে খুশি হন। বিদেশ থেকে কেউ ফোন দিলে খাদিজা তাদের সঙ্গে কথা বলে। সবার কাছে দোয়া চায়।
মাসুক মিয়া মেয়ের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। মোবাইলে ব্যালেন্স কত দিয়ে যেন দেখতে হয়, খাদিজার বাবা এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে খাদিজা বলেন, স্টার ফাইভ ডাবল সিক্স হ্যাস।’ এসময় একজন নার্স আসেন। খাদিজার তার কাছেও জানতে চান তিনি কেমন আছেন। এরপর নার্স খাদিজার প্রেশার মেপে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কি না জানতে চান।
খাদিজাকে দেখতে আসা তার ভাই শাহীনের এক শিক্ষকের সঙ্গে হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করেন এবং তার পরিবারের সকলের বিষয়ে খোঁজ খবর নেন। এসময় শাহীনের শিক্ষক খাদিজার মাথা দেখতে চাইলে খাদিজার বাবা এসে মাথায় লাগানো কাপড়ের টুপিটা খুলে আমাদের দেখান।
অস্ত্রোপচারের পর সেলাইয়ের জায়গা গুলো শুকিয়ে গেছে। মাথার সেলাইগুলো দেখে মনে হয় যেন মাথায় মানচিত্র আঁকা হয়েছে। এসয়ম খাদিজা তার বাবার কাছে জানতে চান, মাথায় আর অস্ত্রোপচার করবে কি না। বাবা মেয়েকে জানান, না আর অস্ত্রোপচার করা লাগবে না। ২২ নভেম্বর চিকিৎসক সেলাই কাটার কথা বলেছেন। সেলাই কাটার সময় ব্যথা লাগবে কি না তাও জানতে চান খাদিজা। অস্ত্রোচপারে তার খুব ভয়।
খাদিজার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে তারা খুবই বিনয়ী, সদালাপি ও অতিথিপরায়ন। খাদিজার মা আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘ঘটনার তিন দিন পর্যন্ত আমি পাগল প্রায় ছিলাম। আমার মেয়ের এ ক্ষতি হবে কোন দিন চিন্তাও করিনি। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। কেউ আমার মেয়ের অবস্থাটুকু আমাকে ভয়ে জানায় নি, যেন আমার কিছু না হয়।
‘ঘটনার ১৯ দিন পর আমি আমার মেয়েকে দেখতে আসি। মেয়েটাকে দেখে এখনও নিজেকে সামলাতে পারি না। ক্ষণে ক্ষণে ভয় হয়। তার যেন কিছু না হয়। বাবা ছাড়া খাদিজা থাকতে পারে না। ভয় পায়। এক মূহুর্তের জন্য বাইরে গেলে খুঁজতে থাকে।’
‘তিনি বলেন, সবার ভাল চাইতো খাদিজা। অথচ আজ তারই ক্ষতি হলো। আমরা খাদিজার ওপর হামলাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। খাদিজার বাবা মাসুক মিয়া বলেন, ‘খাদিজার স্মৃতিশক্তি ঠিক আছে। তাকে আমি ৭ থেকে ৮ বছর আগে আরবী সংখ্যা গননা শিখিয়েছিলাম। এখনও তার সব মনে আছে। এক নিশ্বাসে সব বলে দিতে পারে। সে সূরা ইয়াসিন মুখস্ত করেছিল। তার তিন ভাগের দুই ভাগ মনে আছে। মাঝে একদিন আমাকে পড়ে শুনিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘খাদিজাকে সকাল ৬টায় ঘুম থেকে ডেকে তুলি। ব্রাশ করাই। মুখ ধোয়াই। তার মা মুখে ক্রিম দিয়ে দেয়। সকাল সাড়ে ৭টার দিকে হাসপাতাল থেকে খাবার চলে আসে। এই খাবার তাকে খাওয়াই। খাওয়ানোর পর তাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে চার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। দুপুর ১২টা বা সাড়ে ১২টার দিকে তাকে কেবিনে নিয়ে আসি। একটু সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর তাকে দুপুরের খাবার খাওয়াই।’
খাদিজা স্বাভাবিক খাবার খেতে পারছে। হাসপাতাল থেকে তার জন্য ভাত, মাছ, সবজি, মাংসসহ পুষ্টিকর খাবার ও ফলমূল দেওয়া হয়। শরীরে রক্ত উৎপাদনের জন্য ভিটামিন যুক্ত খাবারই বেশি দেওয়া হয় তাকে ।
মাসুক মিয়া জানান, খাদিজা হাত পা নাড়াচাড়া করতে পারে। মাথার ক্ষতগুলোও অনেকটা শুকিয়ে গেছে। নাকের ডান পাশের ক্ষতটাও শুকিয়ে গেছে। তবে তার পায়ে এখনও সমস্যা রয়েছে। পা নাড়াতে পারে, কিন্তু ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে আরো কিছুদিন এখানে থাকলে খাদিজা হাঁটেতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী।
চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, তারা নিয়মিত তার মেয়ের খোঁজ নেন। তাকে যখন কেবিনে শিফট করা হয় মেডিক্যালের সব চিকিৎসকরা এসে দেখে গেছেন। নার্সরা সময় মতো ঔষুধ দিয়ে যান। তারা খুব যত্ন নেন। এছাড়া পরিচ্ছন্ন কর্মীরাও খাদিজার কক্ষ নিয়মিত পরিস্কার রাখেন। এক সাংবাদিক এসে ছবি তুলতে গেলে দায়িত্বরতরা তাকে ছবি তোলা থেকে বিরত রাখেন ।
তিনি বলেন, দেশে এসে খাদিজার যে অবস্থা দেখেছিলাম সেই সময় থেকে এখন তুলনা করলে সবকিছু যেন স্বপ্নে মতো মনে হয়। এখন সে যে ভাবে আছে সেটা এই সময়ের মধ্যে আশা করা যায় না। মানুষের দোয়া আর চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে মেয়েটা দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠছে।
খাদিজা পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর তাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন মাসুক মিয়া। তিনি বলেন, তিনি আমার মেয়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাঁর কাছে আমরা ঋণী। মেয়ে সুস্থ্য হলে বাড়ি যাওয়ার আগে খাদিজাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবো। প্রধানমন্ত্রী দোয়া না নিয়ে খাদিজাকে নিয়ে বাড়িতে যাবো না। দেখা করব, দোয়া চাইব।
তিনি বলেন, ‘খাদিজা আমাকে প্রায়ই বলে আব্বা বাড়িত কোন দিন যাইতাম। আমি কত দিন অইল নামাজ পড়ড়াম না। তেলাওয়াত কররাম না। বাড়িত না গেলে ইতা করতাম কিলান। আপনে তাড়াতাড়ি আমার বাড়িত যাওয়ার ব্যবস্থা করউক্কা।’
মাসুক মিয়া জানান, খাদিজা সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তারা ঢাকায়ই থাকবেন। চিকিৎসকরা যেভাবে বলবেন সেভাবেই তারা চলবেন। তিনি বলেন, ফিজিও থেরাপির জন্য খাদিজাকে কোথায় পাঠানো হবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে সাভারের সিআরপির নাম বেশি বলছেন ডাক্তাররা। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, যেখানে খাদিজার জন্য ভাল হয় সেখানেই তারা তাকে পাঠাবেন।
খাদিজার ভাই শাহীন এখন এমবিবিএস শেষ বর্ষের পরীক্ষা দিতে চীনে আছেন। চীনের রাজধানী বেইজিং-এ নর্থ চীনা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন তিনি। ২০ নভেম্বর তার আসার কথা রয়েছে।
খাদিজা অনেকটা সুস্থ । তাই বাবা মাসুক মিয়াও বেশ খুশি। আর সন্তানকে ফিরে পেয়ে খোদার কাছে মায়ের শোকরের শেষ নেই। খাদিজা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরুক এই প্রত্যাশা আমাদের সবার। নিয়ে এদিনে মত সকলের কাছ থেকে আমাদেরও বিদায় নিতে হলো।
প্রসঙ্গত, গত ৩ অক্টোবর সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে তার ওপর হামলা হয়। ছাত্রলীগ নেতা এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিষ্কৃত ছাত্র বদরুল আলম তাঁকে উপর্যুপরি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে। খাদিজাকে প্রথমে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে এনে ভর্তি করা হয়।রাইজিংবিডি
মন্তব্য চালু নেই