মঞ্চ প্রস্তুত, ফাঁসি আজ
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় আজ কার্যকর হতে যাচ্ছে। শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ৪১ মিনিটে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল টেলিফোনে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজ শনিবার কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হবে। টেকনিক্যাল কারণে সব প্রস্তুতি থাকার পরও শুক্রবার রায় কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।’
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করতে শুক্রবার বিকালেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কারা কর্তৃপক্ষ।
শুক্রবার সন্ধ্যার কিছু আগে ফাঁসি কার্যকরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন। পাশাপাশি সন্ধ্যায় কারাগার ঘিরে গড়ে তোলা হয় কঠোর নিরাপত্তা বলয়। ফাঁসি কার্যকর হতে যাচ্ছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়াও এ খবর প্রচার করে। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা অব্যাহত থাকে এ রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। রাত ৯টার কিছু পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। হঠাৎ করেই কারাগারের ভেতরে যাওয়া কর্মকর্তারা বের হয়ে আসেন। আর এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ফাঁসি নিয়ে নানা গুঞ্জনের। এসব ঘটনার মধ্যেই শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমিতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, কামারুজ্জামান রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাননি, তাকে আর সময় দেয়া হচ্ছে না। রায় কার্যকরে শেষ সময়ের প্রস্তুতি চলছে।
কারা সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন কিনা তা জানতে শুক্রবার সকাল ১০টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন ঢাকা জেলার ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজ জামিল ও তানভীর মো. আজিম। তবে তাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেননি কামারুজ্জামান। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ওই দুই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তিনি আরও সময় চান। তবে ঠিক কতটা সময় চান সে ব্যাপারেও তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। পরে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজ জামিল ও তানভীর মো. আজিম যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এ নেতাকে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন (মার্সি পিটিশন) দিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। বেলা ১১টা ৩৮ মিনিটে কারাগার থেকে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকরা তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কোনো কথা না বলেই দ্রুত গাড়িতে কারাগার ত্যাগ করেন ওই দুই ম্যাজিস্ট্রেট।
আরও জানা গেছে, সকাল ৯টার দিকে আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইফতেখার উদ্দিন, ডিআইজি প্রিজন গোলাম হায়দার, সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলীসহ কারা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কারাগারে আসেন। তারা কারা অভ্যন্তরে একটি বৈঠকও করেন। পরে ঊর্ধ্বতন এ কারা কর্মকর্তারা ফাঁসির মঞ্চ এলাকা পরিদর্শন করেন।
এদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যক্রম কেন্দ্র করে বিকাল থেকে কারাগার ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। কারাগারের সামনের দোকানপাট বন্ধ করে দেয় পুলিশ। কারাগারের সামনের রাস্তায় সাধারণ মানুষের চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী ফের কারাগারে ঢোকেন। এর পরপরই র্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কারাগার ও আশপাশের এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে একটি ভ্যানে করে কারাগারে বাঁশ নিয়ে যাওয়া হয়। ফাঁসির মঞ্চের উপর শামিয়ানা টানানোর জন্য এই বাঁশ নেয়া হয়, যাতে বৃষ্টি এলে ফাঁসি কার্যকরে কোনো সমস্যা না হয়। রাত ৮টা ৩০ মিনিটে কারাগারে প্রবেশ করেন কারা চিকিৎসক আহসান হাবিব ও লালবাগ জোনের উপ-কমিশনার মুফজ উদ্দিন আহমেদসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। এর পরপরই কারাগারে প্রবেশ করে দুটি অ্যাম্বুলেন্স। কামারুজ্জামানের ফাঁসির গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ায় গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড়ও বেড়ে যায়। ফাঁসি কার্যকরের খবর ছড়িয়ে পড়ায় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা শাহবাগে জড়ো হন। মুহুর্মুহু স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে পুরো এলাকা।
সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও মূলত দুটি কারণে সরকার শুক্রবার রাতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করেনি বলে কারাগারের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। প্রথম কারণ হচ্ছে, ফাঁসি কার্যকরের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে ফাইলটি কারাগারে যাওয়ার কথা ছিল, সেটি যথাসময়ে প্রস্তুত করা হয়নি। শুক্রবার সরকারি ছুটি থাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অফিসে উপস্থিত না থাকায় ফাইলটি প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। তবে আজ সপ্তাহিক ছুটি থাকলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অফিসে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছে। শুক্রবার ফাঁসি না হওয়ার অপর কারণটি হচ্ছে- কামারুজ্জামানকে যখন ফাঁসির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল তখন তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু তখন এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত সময় ছিল না কারা কর্তৃপক্ষের হাতে।
কারাসূত্রে আরও জানা গেছে, যে কোনো মুহূর্তেই রায় কার্যকর হতে যাচ্ছে এমনটা ভেবে শুক্রবার অস্থিরতার মধ্যেই ছিলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান।
কারাসূত্র জানায়, যে কোনো মুহূর্তেই রায় কার্যকর হতে যাচ্ছে এমনটা ভেবে শুক্রবার দিনভর উৎকণ্ঠা ছিল তার ভেতর। কারারক্ষী বা কারাগারের কেউ তার আশপাশে গেলেই তাদের কাছে নানা কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন, জানতে চেষ্টা করেছেন তার জন্য সরকার ও কারা কর্তৃপক্ষের পরবর্তী পদক্ষেপ প্রসঙ্গে। দিনভর তাকে খুব বিমর্ষ মনে না হলেও অনেকটাই চিন্তিত দেখা গেছে। রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা নিয়ে সময়ক্ষেপণ করলেও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।
বিশেষ করে শুক্রবার সকালে ঢাকা জেলা প্রশাসনের দু’জন ম্যাজিস্ট্রেট ওই কনডেম সেলে এসে ঘুরে যাওয়ার পর তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। কারারক্ষী কিংবা কারাগারের কেউ কনডেম সেলের আশপাশে গেলেই তাদের ডেকে কথা বলেছেন। জানার চেষ্টা করেছেন, সর্বশেষ অবস্থা। কনডেম সেলের অদূরে শুক্রবার দায়িত্বরত এক কারারক্ষী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অন্যদিন পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও জিকির-আজকারে ব্যস্ত থাকলেও শুক্রবার ফাঁসি মঞ্চের মাত্র ১০ থেকে ১২ গজ দূরে কনডেম সেলে অবস্থানরত কামারুজ্জামান ছিলেন অন্য এক ব্যক্তি। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৬ নম্বর কনডেম সেলে ৭ থেকে ৮ বর্গ হাতের ওই কক্ষে দিনের বেশিরভাগ সময় পায়চারি করেই কেটেছে এ জামায়াত নেতার। কিছুক্ষণ পরপর কনডেম সেলের শিক ধরে উদাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।
কারা সূত্র বলেছে, ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তাদের একসঙ্গে কারাগার পরিদর্শন ও ম্যাজিস্ট্রেট এসে কথা বলার পর থেকেই দিনভর অনেকটা অস্থির ও চিন্তিত মনে হয়েছে কামারুজ্জামানকে। বৃহস্পতিবার এক কারারক্ষীর সঙ্গে রূঢ় আচরণ করলেও শুক্রবার যাকে সামনে পেয়েছেন তাকেই ডেকে কথা বলেছেন। যদিও কনডেম সেলের ওই দিকটায় দায়িত্বরত কারারক্ষী ছাড়া সাধারণ কারারক্ষীদের যাতায়াত একেবারেই নিষেধ।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের আশপাশে দায়িত্বরত এক কারারক্ষী বলেন, সকাল ৭টার কিছু পরে তিনি নিজেই তিনটি রুটি, গুড় এবং ডাল নিয়ে কামারুজ্জামানের কক্ষে যান। এ সময় কামারুজ্জামান তার সঙ্গে কথা বলেন। গ্রামের বাড়ি কোথায়, কতদিন চাকরি করছেন এমনকি ক’জন ছেলে-মেয়ে এসব কথাও তার কাছ থেকে তিনি (কামারুজ্জামান) জানতে চান। একপর্যায়ে কবে ফাঁসি হতে পারে এমন তথ্যও তার কাছে জানাতে চান কামারুজ্জামান।
ওই কারারক্ষী জানান, দুপুরে ভাতের সঙ্গে খাসির মাংস, ডাল ও সবজি নিয়ে আবারও কামারুজ্জামানের কক্ষে যান। ওই সময় তিনি তাকে (কামারুজ্জামান) বেশ অস্থির দেখতে পান। ওই কারারক্ষী বলেন, তিনি যখন ওই কনডেম সেলের সামনে যান তখন কামারুজ্জামান পায়চারী করছিলেন। দু’বার ডাক দিয়ে তিনি পায়চারী থামিয়ে দেন কামারুজ্জামানের। পরে তিনি খাবার গ্রহণ করেন। তবে কোনো কথা বলেননি। বিকাল ৫টার দিকে রুই মাছ, ডাল ও সবজি দিয়ে রাতের খাবার দেয়া হয় কামারুজ্জামানকে। ওই খাবারও গ্রহণ করেন কামারুজ্জামান।
এদিকে ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে শুক্রবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে এসেছিলেন কামারুজ্জামানের বড় ভাই কফিল উদ্দিন (৫০)। ভেবেছিলেন, ছোট ভাই মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হবে। ফাঁসির আগে তিনি ভাইয়ের শেষ দেখা পাবেন এমন আশায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর তিনি বাসার উদ্দেশে ফিরে যান।
এর আগে রাত ৮টার দিকে কামারুজ্জামানের বড় ছেলে হাসান ইকবাল টেলিফোনে বলেন, কারা কর্তৃপক্ষের ডাক পেলে যাব এমন আশায় আমরা পরিবারের সব সদস্য দিনভর প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু আমাদের ডাকা হয়নি। তিনি আরও বলেন, এর আগে কারা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল ফাঁসি কার্যকরের আগে পরিবারের সঙ্গে শেষ দেখা করতে দেয়া হবে। কিন্তু শুক্রবার কারা কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতিতে তারা ভেবেছিলেন তার বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না।
২০১৩ সালের ৯ মে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন তিনি। গত বছরের ৩ নভেম্বর বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তার আপিল খারিজ করেন। তিন বিচারপতি শেরপুরের সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে ১৪৪ জনকে হত্যা ও বহু নারীকে ধর্ষণের অভিযোগে তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। অপর একজন বিচারপতি এই অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
১৮ ফেব্র“য়ারি আপিল বিভাগের রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হয়। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর ৫ মার্চ রায়টি পুনর্বিবেচনার (রিভিউয়ের) আবেদন জানান কামারুজ্জামান। এরপর ৫ এপ্রিল এই রিভিউ আবেদনের শুনানি গ্রহণ করে ৬ এপ্রিল তা খারিজ করে দেন সর্বোচ্চ আদালত।
রিভিউ আবেদন খারিজের মধ্য দিয়ে বিচারের পরিসমাপ্তি ঘটে। এরপর রিভিউ খারিজের রায়ের কপি ৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় কারা কর্তৃপক্ষের হাতে পৌঁছায়। পরে ওই দিনেই রিভিউ খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় তাকে পড়ে শোনান কারা কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি প্রাণভিক্ষার আবেদন করবেন কিনা জানতে চান। কিন্তু কামারুজ্জামান পরের দিন আইনজীবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সিদ্ধান্ত দেয়ার কথা জানান। ৯ এপ্রিল ৫ জন আইনজীবী তার সঙ্গে দেখা করেন। পরে আইনজীবীরা বের হয়ে কারা ফটকে গণমাধ্যমকে জানান, প্রাণভিক্ষার বিষয়ে কামারুজ্জামান ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু শুক্রবার রাত পর্যন্ত তিনি প্রাণভিক্ষার আবেদন জানাননি বলে কারাসূত্র জানায়।
মন্তব্য চালু নেই