ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ
আজ সেই ভয়াল ভয়ংকর ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় অঞ্চল ভোলা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামে তাণ্ডবলীলা বয়ে যায়।
সরকারি হিসেবে প্রায় পাঁচ লাখ এবং বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১০ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশু নিহত হয়। মারা যায় লাখ লাখ গবাদিপশু। ধ্বংস হয় হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ও গাছপালা। সম্পদের ক্ষতি হয় প্রচুর যা ছিলো পরিসংখ্যানের বাইরে।
ভয়াল সেই ১২ নভেম্বরের দুঃসহ স্মৃতি আজো কাঁদায় ভোলার মানুষদের। ৪৪ বছর আগে এই দিনটিতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল দ্বীপ জেলা ভোলাসহ উপকূলীয় অসংখ্য জনপদ ।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় ওই সময় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায় এক সপ্তাহ পর। আর সেই সময়ে বেঁচে যাওয়াদের স্বজন হারানোর স্মৃতি এখনও তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
সেদিন মুহূর্তের মধ্যেই প্রলংয়করী ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় জনপদগুলোকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, মাঠ-ঘাট এমনকি গাছের সঙ্গে ঝুলে ছিল শত শত মানুষের মৃতদেহ। গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় চর কুকড়ি-মুকড়ির মানুষের। সেখানের প্রায় সবাই সেদিনের জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৯৭০ সালের ওই দিনটি ছিল রোজার দিন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিসহ টানা বাতাস বইছিল সারা দিন। উপকূলের ওপর দিয়ে প্রায় ২০০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড়। বহু মানুষ তাদের প্রিয়জনের লাশ খুজেও পায়নি।
জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে দেড়মাস পর্যন্ত স্বজন হারানোদের কান্নায় উপকূলের আকাশ বাতাস ভারি হয়েছিল। গত ৪৪ বছরের সব কয়টি ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে ৭০ সনের ঝড়টি সব চাইতে হিংস্র ছিল বলে দাবি করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। উপকূলীয় ভোলা, বরিশাল, বরগুনা, লক্ষীপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ ১৮টি জেলায় আঘাত হানে এ ঝড়।
সে সময় সংবাদ প্রচারের মাধ্যম কম থাকায় এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকায় উপকূলে অনেক মানুষই ঝড়ের পূর্বাভাস পায়নি। ওই জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল ৮/১০ ফুট উচ্চতায়। কেউ গাছের ডালে, কেউ উঁচু ছাদে আশ্রয় নিয়ে কোনো মতে প্রাণে রক্ষা পেলেও ৩/৪ দিন তাদের অভুক্ত কাটাতে হয়েছে।
লালমোহন উপজেলার মঙ্গল শিকদার গ্রামের মাকসুদ আলম স্বজন হারানোদের একজন। ওই সময় ১২ বছরের মাকসুদ পরিবারের ৬ সদস্যের মধ্যে বেঁচে যাওয়া একমাএ সদস্য। তিনি সেদিনের ভয়াল স্মৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। দুপুরের পর থেকে ধীরে ধীরে বাতাস বইতে শুরু করে। বিকেলের দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সন্ধ্যায় বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে। এর পর বাতাস ও বৃষ্টির প্রচণ্ডতা বেড়ে যায়।
রাত ২টার দিকে মেঘনা, তেতুলিয়া ও বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাসের পানি ১৪ ফুট উঁচু বেড়িবাধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোটা জেলা তলিয়ে যায়। এ সময় মির্জাকালু বাজারে সদর রোডে হাটুর ওপরে (৩/৪ ফুট) পানি ওঠে। পানি আসছে বলে বাজারের আশপাশ থেকে বহু নারী, পুরুষ ও শিশু ছুটোছুটি করে হাই স্কুলের দোতালায় আশ্রয় নেন।
তিনি আরো বলেন, পরদিন ১৩ নভেম্বর পানি যখন নামতে শুরু করে তখন প্রচণ্ড বেগে জলোচ্ছ্বাসের পানির স্রোতেমা ভোরে পানি যখন নামতে শুরু করে তখন প্রচণ্ড বেগে জলোচ্ছ্বাসের পানির স্রোতে মাছ ধরার ট্রলার ও লঞ্চ বাজারে এসে পড়ে। পানিতে ভেসে যাচ্ছে অগণিত মানুষের লাশ। বিভিন্ন গাছের মাথায় ঝুলতে দেখা গেছে মানুষ ও পশুর মৃতদেহ। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ।
গোটা জেলাকে তছনছ করে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে দিয়েছিলো। ঝড়ের বর্ণনা করতে গিয়ে ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মনপুরার হাবিবা খাতুন বলেন, ‘সেই ভয়াল জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় অথৈ পানিতে একটি ভাসমান কাঠ ধরে প্রায়মৃত অবস্থায় গভির সাগরের মধ্যে থেকে আল্লা আমাকে বাঁচায়।
মন্তব্য চালু নেই