যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত ৩০২ বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী!
ভয়াবহ তৎপরতা আইএসের
তৎপর হয়ে উঠছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএসআইএস) জঙ্গিরা। দেশের উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী তরুণ-তরুণীরাই এখন তাদের টার্গেট। আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, আইএসআইএস জঙ্গিদের ফাঁদে পড়ে সিরিয়া যেতে প্রস্তুতি নিয়েছেন ৩০২ জন বাংলাদেশি তরুণ-তরুণী। তাদের ১৯ জন ইতিমধ্যেই সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। পড়াশোনা, ভ্রমণ কিংবা চাকরির জন্য প্রথমে তুরস্কে গেলেও তাদের মূল লক্ষ্য থাকে সিরিয়ার যুদ্ধে যোগ দেওয়া। এই ১৯ জনের মধ্যে রয়েছেন দুজন তরুণীও। তাদের একজন বেসরকারি কোম্পানির কম্পিউটার প্রকৌশলী এবং অপরজন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। অন্যদিকে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নজরদারি এড়াতে নিজেদের মধ্যে তারা যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছেন বিশেষ সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন ‘উইকার’। তবে সর্বশেষ বাংলাদেশে অবস্থানরত ‘আইএসআইএস’-এর প্রধান সমন্বয়কারী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বেগ ও তার অন্যতম সহযোগী সাকিব গ্রেফতার হওয়ার পর পুরো প্রক্রিয়ায় একটা বড় ধাক্কা আসতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, যারা তুরস্ক হয়ে ইরাক যাওয়ার পরিকল্পনা করছে তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের কোনোভাবেই দেশত্যাগ করতে দেওয়া হবে না। তবে আমরা জানতে পেরেছি তাদের সবাই আধুনিক শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরেই ‘আইএসআইএস’ কর্মীরা নিজেদের যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘উইকার’ ব্যবহার করছে। কারণ হিসেবে জানা গেছে, উইকারে ছয় মিনিট পরপর ডাটাগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কেউ চাইলেও সেগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারে না। টার্গেটে থাকা উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের মগজ ধোলাই করতে আটক হননি আইএসআইএসের এমন কিছু সদস্য টার্গেটে থাকা তরুণদের হরদম মগজ ধোলাই করে যাচ্ছে। সিরিয়ায় যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠাই আইএসআইএস জঙ্গিদের টার্গেট। তবে প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং স্থাপনায় হামলা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। আইএসআইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন এমন বেশির ভাগ সদস্যই দেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান।
গোয়েন্দা সূত্র আরও জানায়, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গত রবিবার গ্রেফতার হন আমিনুল ইসলাম বেগ। তিনি দেশে আইএসের প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি মালয়েশিয়ায় কম্পিউটার সায়েন্স এবং আইটি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। দেশের একটি মোবাইলফোন কোম্পানি, ইন্টারনেট প্রোভাইডার কোম্পানি, কোমলপানীয় কোম্পানির আইটি বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বালাকড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার রয়েছে ৩০৮২ জন বন্ধু। তাদের বেশির ভাগই তার মতাদর্শের বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক হলেও বিদেশে তার পরামর্শক হিসেবে কাজ করছেন জাপান প্রবাসী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাইফুল্লাহ ওরফে আবু মুসা। নও-মুসলিম এই ব্যক্তি জাপানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আইএসআইএসের কর্মকাণ্ডের জন্য সংগৃহীত ৫০ লক্ষাধিক টাকাও আমিন বেগের ইস্টার্ন ব্যাংকের হিসাব নম্বরে জমা রয়েছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
গ্রেফতারের সময় অভিযান চালানো দলের সঙ্গে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, আমিন তার পরিবারের সব সদস্যকেই সিরিয়া যুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। স্ত্রী এবং দুই সন্তানকেও তিনি এভাবেই গড়ে তুলেছেন। আইএসআইএসের পোশাকে তাদের ছবিও তুলে প্রিন্ট করে ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছেন তিনি। তবে অভিযান চালানোর একপর্যায়ে আমিনের মা আমিনের ল্যাপটপটি পাঁচতলা থেকে নিচে ফেলে দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে নিজেদের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তির আত্মীয় বলে দাবি করেছিলেন। পরে ওই ভাঙা ল্যাপটপটি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় উদ্ধার করা হয়েছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমিন বেগের অন্যতম সহযোগী আশরার আহমেদ খান চৌধুরী গত মার্চ মাসে গ্রেফতার হন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে। তার বাবা সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তির সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তা। সিরিয়ার যুদ্ধে যেতে আগ্রহীদের বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন তিনি। পেশায় তিনিও আইটি বিশেষজ্ঞ। বিটিআরসির আইটি কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। কাজ করেছেন সামস্যাং মোবাইল ফোন এবং সরকারের একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আইটি বিভাগেও।
বাংলাদেশে আইএসআইএসের অন্যতম সমন্বয়ক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছিলেন সাকিব বিন কামাল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক উপদেষ্টার মেয়ের জামাই তিনি। গাজীপুর আইইউটি থেকে লেখাপড়া শেষ করে মোহাম্মদপুরে একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। গত রবিবার তাকে মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) ছাত্র মো. আশেকুর রহমান ওরফে জিলানী তুরস্কে গিয়ে নিরুদ্দেশ হন। জিলানী সিরিয়ায় ঢুকে আইএসে যোগ দিয়েছেন বলে সন্দেহ আঙ্কারায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের। গত বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আইএসআইএস জঙ্গি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ওরফে ইবনে হামদানকে। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের সাবেক এক বিচারপতির ছেলে আদনান এবং ওএসডি যুগ্ম-সচিবের ছেলে তানজিলকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতদের বরাত দিয়ে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার আরও বলেন, আইএসের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে সশস্ত্র জিহাদের পরিকল্পনা ছিল তাদের। দেশে আইএসআইএসের তৎপরতার বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। তবে এ বিষয়ে সচেতনতার জন্য অভিভাবকদের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানদের মাঝে কোনো ধরনের পরিবর্তন এলো কিনা, এ বিষয়টি আমাদের জানানোর জন্য অনুরোধ করছি। জঙ্গি তৎপরতা রুখে দিতে আমাদের তরফ থেকে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে।
মন্তব্য চালু নেই