ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থাকা ব্যক্তিকে সিইসি চান বিশিষ্টজনরা
চার বিশিষ্ট নাগরিকের মতামত নেয়ার পর আজ বৃহস্পতিবার (০২ ফেব্রুয়ারি) আবার বৈঠকে বসছে অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটি। যাচাই বাছাই শেষে সার্চ কমিটি নতুন ইসি গঠনে যেসব নাম সুপারিশ করবে, রাষ্ট্রপতি তার বাইরে যাবেন না বলে প্রত্যাশা এসেছে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনায়। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে চার বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে সার্চ কমিটির সদস্যদের এই মতবিনিময়ের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও বিধি) আব্দুল ওয়াদুদ সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
যে চারজন বিশিষ্ট নাগরিক গতকাল বুধবার অনুসন্ধান কমিটিকে মতামত জানিয়েছেন, তারা হলেন- সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) মোহাম্মদ আবু হেনা, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রোকনউদ্দিন মাহমুদ। নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও পরে গত মঙ্গলবার তার নাম বাদ দেয়া হয়।
বৈঠক থেকে বেরিয়ে আবু হেনা গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের স্বার্থে ইসি গঠনে সার্চ কমিটিকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা পালনে তারা সক্ষম হবে। সব ভয়ভীতি ও হুমকির ঊর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালন করবেন এমন ব্যক্তিবর্গ নিয়ে ইসি গঠনের প্রস্তাব করবে সার্চ কমিটি। মাহফুজ আনাম বলেন, যে ২০ জনের নাম বাছাই করা হয়েছে, ইতিমধ্যে সেই তালিকা প্রকাশ করা দরকার। এর আগেও সার্চ কমিটির সুপারিশ মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রকাশ করেছে আমরা জানি। এবারও নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে আশা করি। শুধু সুপারিশ থাকলে হবে না, একটি ভিশনও থাকা উচিত।
গোলাম সারওয়ার বলেন, প্রথমবারের মতো সুশীল সমাজের ব্যক্তিবর্গকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াকে আরো সুসংহত করবে। নির্বাচনী বিষয়গুলো সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শুধু আইন করলে হবে না, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে সহায়ক বিধি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আর রোকনউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আগের ইসির সঙ্গে এবারের ইসির কাজের সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। কারণ এর আগে ইসি যেসব গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছে, তার সবই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় হয়েছে। এবার রাজনৈতিক সরকারের সময় থেকেই কাজটি করতে হবে। ফলে এটা তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং। সার্চ কমিটি যাদের নাম চূড়ান্ত করবে, তারা দায়িত্ব পাওয়ার পর যদি আশানুরূপ আচরণ না করতে পারেন, তাহলে সার্চ কমিটিকে দায়ী করা সমীচীন হবে না।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানিয়েছেন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুর রশিদের নামে মামলা থাকায় আগে রাখলেও পরে তাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।
কমিটির সাচিবিক দায়িত্ব পালনকারী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আব্দুল ওয়াদুদ গতকালের বৈঠকের পর গণমাধ্যমকে জানান, আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় সুপ্রিম কোর্ট জাজেস লাউঞ্জেই আবারও বসবে সার্চ কমিটি। তিনি বলেন, আজ যে চারজনের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে, তারা যেসব ব্যক্তির ক্লিন ইমেজ আছে, প্রশাসনিক দক্ষতা আছে, দায়িত্ব পালনের জন্য শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা আছে এবং যারা চাপের মুখে মাথা নত করবেন না- এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি জানান, রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পাঠানো ১২৫ জনের নামের তালিকা থেকে ২০ জনের শর্ট লিস্ট করা হয়েছে। এখান থেকেও সংযোজন-বিয়োজন হতে পারে। তিনি বলেন, শর্ট লিস্টের বাইরে থেকেও সার্চ কমিটি যোগ্য ব্যক্তিদের নাম বের করে আনতে পারে। ২০ জনের প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ এবং যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। কমিটি নিজ বিবেচনায় এখান থেকে নাম বাদ এবং যোগও করতে পারে।
সমাজের বিশিষ্ট এই চার ব্যক্তির সঙ্গে গতকাল সকাল ১১টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনা করে অনুসন্ধান কমিটি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সার্চ কমিটির সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক, মহা হিসাব নিরীক্ষক (সিএজি) মাসুদ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য শিরীণ আখতারও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে আবু হেনা আরো বলেন, নির্বাচন কমিশন কার্যকর ও স্বাধীন দেখতে চাইলে যোগ্য এবং সাহসী ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। তিনি বলেন, নতুন নির্বাচন কমিশনে যারা নেতৃত্ব দেবেন, তাদের নিরপেক্ষ, সাহসী, বিবেকবান, প্রজ্ঞাসম্পন্ন ও অধিক পরিশ্রমী হতে হবে। আবু হেনা বলেন, ‘আমাদের পরামর্শ ছিল- প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে সর্বজন গ্রহণযোগ্য হতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ওপর সংবিধানের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা যথাযথভাবে যারা পালন করতে পারবেন, তাদের সার্চ কমিটি খুঁজে বের করবে।’ সার্চ কমিটির ওপর আস্থা রেখে তিনি বলেন, নাগরিকদের সঙ্গে যেভাবে আলোচনা করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ এবং এ আলোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা উচিত। সার্চ কমিটি নিরপেক্ষ কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, তাদের ভূমিকা নিয়ে এখনো প্রশ্ন তোলার সময় আসেনি। আমরা চাই নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তাদের গুরুদায়িত্ব তারা শেষ পর্যন্ত রক্ষা করুক।
আগামী নির্বাচন কমিশনের ওপর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে বলে ব্রিফিংয়ে মন্তব্য করেছেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, সার্চ কমিটির সর্বোচ্চ প্রজ্ঞার পরিচয় দেয়া উচিত। নির্বাচন কমিশন গঠনে গণবিতর্ক (পাবলিক ডিবেট) হতে পারে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আনাম বলেন, এখনো বিতর্কের সময় আসেনি। তবে নাম নির্বাচনের পরপরই জনসম্মুখে ঘোষণা করা উচিত, যা গতবার করা হয়েছিল। কমিটির প্রতি আস্থা রেখে তিনি আরো বলেন, দেশবাসীর আকাক্সক্ষা পূরণে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সার্চ কমিটি নাম প্রস্তাব করবে বলে বিশ্বাস করি। তিনি আরো বলেন, ঐতিহাসিক কারণেই আগামী নির্বাচন কমিশনের ওপর দায়িত্ব অনেক বেশি। কমিশন কিভাবে তার দায়িত্ব পালন করে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারে, তারও পরামর্শ দেয়া হয়েছে বিশিষ্ট নাগরিকদের পক্ষ থেকে।
আর নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে সার্চ কমিটির সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেয়া নাগরিকদের মতামত কমিশনের কাছে লিপিবদ্ধ আকারে জমা দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন দৈনিক সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে যার সামান্যতম বিরোধ আছে, তাকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেয়া যাবে না। গোলাম সারওয়ার বলেন, অনেকেই কমিশনারদের যোগ্যতা নিয়ে কথা বলছেন। আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি অধিক গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা উচিত। তিনি আরো বলেন, সার্চ কমিটি যে সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করেছে তার প্রতি আমাদের আস্থা আছে এবং রাষ্ট্রপতি যাদের নিয়োগ দেবেন তাদের প্রতিও আমাদের আস্থা থাকবে। সুশীল সমাজের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে বলে সার্চ কমিটিকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ব্যর্থতা সার্চ কমিটির ওপর বর্তায় না বলে ব্রিফিংয়ে মন্তব্য করেন ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, সব দিক বিবেচনা করেই সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করবে বলে বিশ্বাস করি। দায়িত্ব নেয়ার পর যদি কমিশনাররা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন, তাহলে তার দায় সার্চ কমিটিকে দেয়া সমীচীন হবে না। তিনি বলেন, সার্চ কমিটি গতবারও নাম সিলেক্ট করেছিল। কিন্তু কমিশন এমন হলো কেন, সে প্রশ্ন জনমনে। এর উত্তর কমিশনকেই খুঁজতে হবে। কমিশন গঠন নিয়ে আইন করার ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, অনেক কিছু নিয়েই আইন তৈরি করার সময় এসেছে। সার্চ কমিটি যে নাম দেবে, তা শেষ পর্যন্ত থাকবে কি না- আইন থাকলে এমন সংশয় কাজ করত না। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বের ওপরই সব নির্ভর করবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক সরকার কমিশনের ওপর হস্তক্ষেপ করবে না। সার্চ কমিটি যে নাম দেবে, সরকারও তার ওপর আস্থা রাখবে বলে আমার পূর্ণ আস্থা আছে।
এর আগে গত সোমবার ১২ বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে বৈঠকে বসে নির্বাচন কমিশন গঠন বিষয়ে তাদের মতামত নেয় সার্চ কমিটি। আর মঙ্গলবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া নাম বাছাই করে ২০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা হয়।
মন্তব্য চালু নেই