বন্দি ৫ শতাধিক
ভয়ঙ্কর অপরাধে বিদেশিরা
ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অনেক বিদেশি নাগরিক। মাদক, জাল মুদ্রা এবং অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি তৎপরতার মতো মারাত্মক অপরাধে। তারা জড়িত নানা প্রতারণামূলক কাজেও। বিশেষ করে আফ্রিকার নাইজেরিয়াসহ ১৪টি দেশের নাগরিকদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, বাংলাদেশে বসবাসরত ৫ লাখ বিদেশির মধ্যে ৪ লাখ ৯০ হাজার ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া অবৈধভাবে কাজ করায় সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বিভিন্ন অপরাধে কারাগারে বন্দি আছে পাঁচ শতাধিক বিদেশি। শুধু চলতি বছরেই খুন ও জঙ্গি তৎপরতাসহ নানা অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে শতাধিক বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর গুলশান-উত্তরাসহ কয়েকটি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ২৫ বিদেশিকে। পরে তাদের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এর আগে ১০ অক্টোবর বলাৎকারে বাধা দেয়ায় আলজেরীয় নাগরিক ওবায়েদ কাদেরের হাতে উত্তরায় ও-লেভেল শিক্ষার্থী জুবায়েরের হত্যাকান্ডে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি) শেখ নাজমুল আলম বলেন, বাংলাদেশে বসবাসরত বিপুলসংখ্যক বিদেশি নানামুখী অপরাধে জড়িত। সাধারাণত খেলোয়াড়, টুরিস্ট ভিসা নিয়ে কিংবা ব্যবসার কথা বলে বাংলাদেশে এসে বিদেশিরা অপরাধ কার্যক্রম চালাচ্ছে। ভিসা দেয়ার সময় ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করলে এ ধরনের অপরাধীর তৎপরতা অনেক কমে আসবে। আইনের মাধ্যমে কঠোর সাজা হলেও বিদেশিরা ডলার জালিয়াতি ও মাদক ব্যবসার মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে সাহস পাবে না। এজন্য সব সেক্টরের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার বলে তিনি মনে করেন। দেশে অবৈধভাবে কত বিদেশি নাগরিক রয়েছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নেই। বিভিন্ন সংস্থার দেয়া তথ্য মতে, দেশে বৈধ ও অবৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) বলছে, দেশে বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ। এদের মধ্যে আফ্রিকার ১৫ হাজার বৈধ ও অবৈধ নাগরিক দেশে অবস্থান করছে। কঙ্গো, ঘানা, নাইজেরিয়া, আলজেরিয়া, আইভরিকোস্ট, সিয়েরা লিওন, সেনেগাল, ক্যামেরুন, ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া থেকে আসা প্রায় ৮ হাজার নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা ফিরে যায়নি। এসব অবৈধ বিদেশি বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অপরাধ কর্মকান্ডে জড়িত বেশিরভাগ বিদেশি বৈধ ভিসার পাশাপাশি জাল ভিসা ব্যবহার করে এদেশে প্রবেশ করছে। পুলিশের ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি কন্ট্রোল অ্যান্ড অপারেশন (এসসিও) শাখার কিছু কর্মকর্তা ভিনদেশি অপরাধীদের এদেশে প্রবেশে সহায়তা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। ভিনদেশি এসব প্রতারকের পৃষ্ঠপোষকদের একটি তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। এসবির এক কর্মকর্তা জানান, অ্যারাইভেল ভিসা যত্রতত্র অপব্যবহার করে এ অপরাধীদের তৎপরতা বাড়ছে। র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, গত কয়েক বছরে র্যাব বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা সন্দেহে ৯১ বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতদের বেশিরভাগই জঙ্গি কর্মকান্ড, মাদক, জাল মুদ্রা তৈরি ও মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত। এরা এদেশে ঢুকেই নিজেদের পাসপোর্ট ফেলে দেয়। ঢাকায় ওইসব দেশের দূতাবাস না থাকায় নিজ নিজ দেশে পুশব্যাকও করা যায় না। পুলিশ জানিয়েছে, বিদেশি অপরাধীদের গ্রেফতার করেও বিপদে পড়তে হয়। মামলা পরিচালনা ও কারাগারে দেখভাল করাটাও মুশকিল। অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে জামিনে বেরিয়ে যায়। মামলার দীর্ঘসূত্রতার জেরে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করে। এতে মামলার মীমাংসা হতে কোনো কোনো সময় ১০ বছরও পার হয়ে যায়। মামলা চালানোর অজুহাত দেখিয়ে তারা দীর্ঘদিন এদেশে অবস্থান করে। এক সময় ঠিকানা বদলে তাদের অপরাধ তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও এদের আর খুঁজে পায় না।
১০ হাজার অভিযোগ, ১৪ দেশের নাগরিক বেশি সক্রিয় : বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে প্রায় ১০ হাজার অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি দেশের নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যাই বেশি। এ তালিকার প্রথমেই আছে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া। এছাড়া ঘানা, কঙ্গো, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, সুদান, তানজানিয়া, উগান্ডা, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও পাকিস্তান অন্যতম। এসব দেশের নাগরিক কোথায় কী পেশায় আছেন, তার বেশিরভাগই অজানা পুলিশের।
কারাগারে বন্দি পাঁচ শতাধিক : দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রয়েছে পাঁচ শতাধিক বিদেশি। তাদের মধ্যে ৭৯ জন বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত। বিদেশি বন্দির মধ্যে বর্তমানে ২৯ জন কারাগার থেকে মুক্তির অপেক্ষায় আছে বলে কারা অধিদফতর সূত্র জানা গেছে। বন্দি বিদেশিদের মধ্যে চলতি বছরেই গ্রেফতার হয়েছে শতাধিক। এছাড়া একযুগ আগে গ্রেফতার হওয়া বিদেশিও কারাগারে রয়েছে।
ওয়ার্ক পারমিট নেই বেশিরভাগের : বাংলাদেশে বসবাসরত বেশিরভাগ বিদেশি নাগরিক ওয়ার্ক পারমিট ছাড়া কাজ করছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, বিভিন্ন দেশের ৫ লাখ বিদেশি বর্তমানে বাংলাদেশ কাজ করছে। বায়িং হাউস, এনজিওসহ বিভিন্ন ধরনের চাকরি ও ব্যবসা করছে তারা। এদের মধ্যে মাত্র ১০ হাজার বিদেশির ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে। বাকি ৪ লাখ ৯০ হাজার বিদেশি বৈধ অনুুমোদন ছাড়াই কাজ করছে। এতে বাংলাদেশ হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। কর অঞ্চল-১১ এর হিসাব মতে, চলতি বছর তাদের ১৮৭ কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশিদের দেয়া রাজস্ব নগণ্যই।
অভিজাত এলাকায় আস্তানা : রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বারিধারার মতো অভিজাত এলাকায় এসব বিদেশি বাড়িভাড়া নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করে। পুলিশের চোখ এড়িয়ে তারা নির্বিঘ্নে অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব এলাকায় বিদেশিদের অপরাধ দমনে পুলিশের ভূমিকার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে ডিএমপির গুলশান বিভাগের পুলিশ উপকমিশনার (ডিসি) লুৎফুল কবির বলেন, পুলিশের পক্ষে প্রতিটি বাড়ি অনুসন্ধান করে বিদেশিদের চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। বিদেশি অপরাধীদের শনাক্ত করার জন্য পুলিশের পাশাপাশি স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি ও বাড়ির মালিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাড়িওয়ালা কিংবা ফ্ল্যাট মালিকরা যাতে বিদেশিদের ভাড়া দেয়ার ক্ষেত্রে সচেতন হন, সেজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে অনুরোধ করা হয়েছে। তবে বিদেশিরা বাড়িভাড়া বেশি দেয় বলে বাড়ির মালিক তাদের ব্যাপারে পুলিশের কাছে তথ্য দেন না বলে তিনি জানান।
প্রতারণার ধরন : সাধারণত মাদক ব্যবসা, বিদেশে লোক পাঠানোর নামে প্রতারণা, জালনোট তৈরি, বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার, জাল টাকার উপকরণ সরবরাহ ও হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে বিদেশি নাগরিকরা জড়িত। এছাড়া অনুমোদন ছাড়া আমদানি নিষিদ্ধ ক্যান্সার ও যৌন উত্তেজক নিম্নমানের ট্যাবলেট, ভ্রুণ নষ্টকারী গায়োনিক এসিডের ওলিভা, নিম্নমান ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর কসমেটিকস সামগ্রী, টেক্সটাইল পার্টস, ফার্নিচার মেশিনারিজ ও মার্বেলসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য অবৈধভাবে আমদানি করছে এসব বিদেশি নাগরিক।
কয়েকটি ঘটনা : ২০ জানুয়ারি সেগুনবাগিচা থেকে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই তালেবান অব পাকিস্তানের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তারা হলো মেহমুদ, উসমান ও ফখরুল হাসান। রাজধানীর উত্তরা থেকে মাদক ও জাল ডলার বিক্রির অভিযোগে এক নারীসহ পাঁচ নাইজেরীয় নাগরিককে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। তারা হলো ডুমানটিয়ার, মেরিটনি, জেরিনালিপেন, বমারছো ও ইউসুফ। গত বছর ২৩ ডিসেম্বর উত্তরার একটি বাড়ি থেকে অবৈধ ভিওআইপি সরঞ্জামসহ ৩৭ বিদেশিকে গ্রেফতার করে র্যাব। এর আগে ১১ জুন কারওয়ানবাজারের একটি আবাসিক হোটেল থেকে সাড়ে তিন কেজি কোকেনসহ গ্রেফতার করা হয় পেরুর নাগরিক জুয়ান পাবলো রেফায়েল। ২ জুন ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির বিভিন্ন সরঞ্জাম, বিদেশি মুদ্রা ও জাল ভিসাসহ শ্রীলঙ্কার নাগরিক মোহনাথারাস পন্নুথারাইকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। ২ মে উত্তরা এলাকায় রিকশা ভাড়াকে কেন্দ্র করে এক রিকশাচালককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে পাঁচ বিদেশি নাগরিক। একই সময় ডলার জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগে তিন নাইজেরীয়কে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। সূত্রঃ আলোকিত বাংলাদেশ
মন্তব্য চালু নেই