‘ভ্যাট দিমু না, গুলিকর!’ আন্দোলনের একবছর

বিধান মুখার্জী, গণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: ১৯৫২ সাল থেকেই বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বিজয় সংগ্রামের ইতিহাস।বারবার অন্যায্য দাবির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে এদেশের ছাত্র জনতা।ছাত্র আন্দোলনের এই বিজয় মুকুটে যুক্ত হয়েছে আরেকটি পালক আর জাতি মুক্ত হয়েছে শিক্ষার ওপর ভ্যাট নির্ধারণের লজ্জা থেকে।

শিক্ষা দেশের নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। দেশের প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে।বর্তমানে দেশের সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চ শিক্ষার চাহিদার অনেকাংশই পুরন করে আসছে।

এমতাবস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের যাবতীয় লেনদেনের ওপর ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরের বাজেটে ৪ জুন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের যে প্রস্তাব করেন তা শিক্ষার্থীদের ভেতর গভীর অসন্তোষের সঞ্চার করে।ইতিমধ্যে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নোটিশ দিয়ে ভ্যাট আদায় শুরু করলে এই অসন্তোষ শিক্ষার্থীদের ভেতর দাবানলের মত ছড়িয়ে পরে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের উচ্চ শিক্ষার চাহিদার সিংহভাগ পুরন করা সত্তেও বারবার সমালোচিত হয়েছে,বিভিন্ন সময় বিশিষ্ট জনেরাও করেছেন বিরূপ মন্তব্য কিন্তু দেশের সিংহভাগ শিক্ষার্থীর সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসেননি কেউ।আর তাই দেশ পেল নজিরবিহীন অনন্য এক অহিংস সফল আন্দোলন।

সরকারের এই ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবের পরে প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে।শিক্ষার্থীরা এই প্রস্তাবের বিদ্রূপাত্মক সমালোচনা করেন ।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ লিখে হ্যাশ ট্যাগ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষের প্রকাশকে ছড়িয়ে দেয়।বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা এর বিরুদ্ধে মানববন্ধন করতে শুরু করেন।

কিন্তু এতকিছুর পরেও ২৯ জুন পুনরায় প্রস্তাব আসে ১০ শতাংশের পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের।শুরু হয় সংঘবদ্ধ আন্দোলন।দেশের সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নেমে আসেন রাজপথে।এরপরই মূলত শুরু হয় ভ্যাট বিরোধী ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ আন্দোলন।

আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহনের কথা বলতে গিয়ে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলনের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক পলাশ বলেন , ‘এই আন্দোলন ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় রক্ষার আন্দোলন।শিক্ষার্থীরা নিজেদের মূল্যবোধ থেকেই নেমে এসেছিল রাজপথে।আর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রথম থেকেই অংশ নিয়েছে এই আন্দোলনে’।

আন্দোলনের অংশ হিসাবে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ২২ মাইলে একাধিকবার মানববন্ধন করেছে শিক্ষার্থীরা, প্রেসক্লাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, প্রতিবাদ জানাতে স্মৃতিসৌধের সামনে নো ভ্যাট অন এডুকেশন লিখে মোমবাতি প্রজ্বলন করেছেন,কালো ব্যাজ ধারন করেছেন।সরকারের অনড় অবস্থানের প্রতিবাদে ২২ আগস্ট গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অর্থমন্ত্রীর কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।এরপর ২৭ আগস্ট শিক্ষার্থীরা সম্মিলিত ভাবে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি জমা দেন।

শিক্ষার্থীদের দাবি বারবার প্রতিহত হয়েছে কিন্তু দমে যাননি তারা। আন্দোলনের নামে দেশের জাতীয় সম্পদের ক্ষতি না করে শান্তিপূর্ণ ভাবে অবস্থান নিয়েছেন নিজেদের দাবীতে।কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।

এর ফলশ্রুতিতে ১০ থেকে ১৪ তারিখ রাজধানীর প্রধান প্রধান পয়েন্টে শান্তিপূর্ণ ভাবে রাস্তা অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা।গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকা আরিচা মহাসড়কে অবস্থান নিলে রাজধানী ঢাকা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।অবশেষে শিক্ষার্থীদের দাবীর মুখে তাদের দাবী মেনে নেয় সরকার। আন্দোলন ক্ষেত্র গুলো মুহূর্তে বদলে যায় আনন্দমঞ্চে।নতুন এক আন্দোলনের বিজয় যোগ হয় ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই প্রথম কোন আন্দোলন করেন সম্মিলিত ভাবে যা সফল হয়েছে পদ্ধতিগত দিক থেকেও।দেশের কোন সম্পদের ক্ষতি না করে এই প্রথম কোন আন্দোলন দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ।পুলিশের কাজে বাধা না দিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নিদর্শন হিসেবে ফুল বিনিময়, রাস্তা অবরোধে যাত্রীদের অসুবিধা হওয়ায় লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা বাংলাদেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে।অবশেষে দাবী আদায়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক অনন্য আন্দোলন।

এবার ১৪ ই সেপ্টেম্বর পূর্ণ হল এই আন্দোলনের সফলতার একবছর।দিনটি ঈদের ছুটিতে বাড়িতে থেকেও মনে করেছেন তারা,আর এখন ক্যাম্পাসে চলছে তার স্মৃতিচারণ।



মন্তব্য চালু নেই