আন্তর্জাতিক সনদ ও জাতিসংঘই বাঙালী বনী আদমের ভরসা

ভেঙ্গে পড়েছে রাজনীতি, কোন পথে বাংলাদেশ?

দুই মাসের রাজনৈতিক সঙ্কট আর দু’পক্ষের পরস্পর বিরোধী শক্ত অবস্থানে কার্যত: দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সরকারের অঙ্গ- আইন, বিচার ও শাসন বিভাগ সঠিকভাবে কাজ করছে না।রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই অচল হয়ে পড়ছে। এতে আন্দোলনকারী বিরোধ জোট যেমন মানছে না রাষ্ট্রের আইনকানুন-বিধি-নিষেধ তেমনি সরকার ও তাদের পক্ষের লোকজনও আইনকানুনের তোয়াক্কা করছে না। ফলে বর্তমানে দেশে এক চরম অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদও লঙ্ঘিত, ফলে সর্বত্রই বাঙালী বনী আদমের দুর্বিষহ অবস্থা।

রাজনীতিতে শক্তি প্রয়োগের প্রতিযোগিতায় জিম্মি দেশ ও জনগণ, প্রতিদিন মানুষ মরছে পেট্রোল বোমায় না হয় বন্দুকযুদ্ধে। অন্যথা সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে গুম হয়ে যাচ্ছে মানুষ । এই মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। মূলত: গত ৫ জানুয়ারির পর থেকেই এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এই পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজন বলে আখ্যায়িত করেছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল ।

গত জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৫৫ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।এ সময়ে ১৮জনের পায়ে গুলি করে সরকারি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গুম হয়েছে ২১জন। এছাড়া গত দুই মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৮৬জন, আহত হয় ২৬৬১জন এবং গণপিটুনিতে নিহত হয় ১৯জন। সবশেষ গুমের শিকার হয়েছেন বিএনপির যুগ্মমহাসচিব সালেহউদ্দিন আহমেদ। (সূত্র-অধিকার’র মাসিক প্রতিবেদন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।

গণতান্ত্রিক চর্চা ও আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ, নাগরিকরা নিরাপত্তাহীন। রাষ্ট্রই জনগণের জন্য বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও মানবাধিকার এবং স্বাধীনতা ক্রমেই সংকীর্ণ হচ্ছে, ফলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভুলুন্ঠিত। বলে সুশিলসমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি।

এসব ঘটনায় ইতোমধ্যে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্র এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ (এইচআরডব্লিউ) বিশ্বের মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সংলাপের তাগিদ দিয়ে আসছে। তবে এ ব্যাপারে কোনো তোয়াক্কা নেই। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।

চলমান অবরোধের মাঝে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দীন আহমেদসহ অতীতের সব নিখোঁজের ঘটনা তদন্তের তাগিদ দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তবে সংস্থাটি দাবি করে ‘বিরোধী দলের সদস্য নিখোঁজের ঘটনা তদন্তে ব্যর্থ হওয়ার ইতিহাস রয়েছে বাংলাদেশের সরকারের।

সংস্থাটি বলছে, ২০১২ সালে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে কি ঘটেছিল, সেটি জানাতেও ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। ২০১৪ সালের মে মাসে গণ মাধ্যমের ব্যাপক সমালোচনার মুখে নারায়ণগঞ্জে ৭ জনের হত্যার সঙ্গে র্যাধপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের সম্পৃক্ততার বিষয়টি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়। শুরুতে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করলেও পরে এ ঘটনার সাথে র্যা বের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, বাংলাদেশে এবছরের শুরু থেকেই চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সহিংসতায় ১৫০ জনেরও মানুষের প্রাণহানি এবং কয়েকশ’ মানুষ আহত হয়েছে আর এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশে ধরপাকড় চালিয়ে বিরোধী দলের হাজার হাজার সদস্যকে আটক করেছে সরকার।

২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসের সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে বিরোধীদের দীর্ঘদিন ধরে মতানৈক্যের কারণেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।সংস্থাটি বলছে, নির্বাচনের আগে ও পরে বেশ কয়েকশ’ মানুষ দেশটিতে নিহত অথবা নিখোঁজ হয়েছে।

সংস্থাটির দাবি, ‘বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ অনেক নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত করলেও সরকারের পক্ষ থেকে এমন অনেক ঘটনারই কোনও রকম তদন্তের প্রমাণ নেই। জনগণের কাছে সরকার অঙ্গীকার করলেও এসব ঘটনায় সম্পৃক্ততার দায়ে নিরাপত্তা বাহিনীর কোনও সদস্যকে ধরা হয়নি।’(সুত্র: বিবিসি ১৮ মার্চ, ২০১৫)

এদিকে ৭ ফেব্রুয়ারি ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সপ্তাহিক দি ইকোনমিস্টের (প্রিন্ট সংস্করণে)প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশের রাজনীতি ভেঙে পড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘শোডাউন ইন বাংলাদেশ অন ফায়ার’ শিরোনামের ওই নিবন্ধে বলা হয়, চলমান সঙ্কটে সব মিলিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ডাকা এক মাসব্যাপী চলা অবরোধে প্রায় ৬০ জন প্রাণ হারিয়েছেন।

নিবন্ধে বিএনপি নেত্রী খালেদার প্রসঙ্গে বলা হয়, তার দল বিএনপির সড়ক-রেল ও পানিপথ অবরোধে দেশ অচল হয়ে গেছে। এতে যোগ হয়েছে হরতাল। নিবন্ধে বলা হয়, ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তি ঘিরে এ অস্থিরতার সূত্রপাত হয়। এতে দাবি করা হয়, বিক্ষোভ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত বিরোধী দলের ১০ হাজারেরও বেশি কর্মী আটক হয়েছেন। বিএনপির অধিকাংশ নেতা জেলে, নির্বাসনে কিংবা পলাতক রয়েছেন। সরকার সাময়িকভাবে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। অবরোধ প্রত্যাহারে বাধ্য করাতে এ চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল বলে অনুমেয়। কিন্তু তিনি (খালেদা জিয়া) শেষ দেখার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে।

নিবন্ধে অভিযোগ করা হয়, ২০০৯ সালের শুরুতে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতা সুরক্ষিত করেছে এবং বিএনপির জন্য ক্ষমতায় যাওয়াটা অসম্ভব করে তুলেছে। সেটা করতে আওয়ামী লীগ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলোপ ঘটিয়েছে।

এতে বলা হয়, সরকারের দাবি- বিএনপির সন্ত্রাস ও নাশকতা তারা মোকাবিলা করছে। আবার বিরোধী জোটের অভিযোগ, সরকার একদলীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত। উভয় দলেরই যুক্তি রয়েছে। নিবন্ধে বলা হয়, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, খালেদা জিয়া এখন দেশকে এমন এক অবস্থায় দাঁড় করাতে চান যেখানে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবে। তারা (সেনাবাহিনী) এটা নাও করতে পারে। তারা তাদের সুনাম এবং জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী মিশনে আকর্ষণীয় দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ, পাছে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের কর্মকান্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে অন্যতর পদক্ষেপ নেয়।

নিবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়, বিএনপির সড়ক অবরোধ ও সহিংসতা এবং সরকারের দমন-পীড়ন বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী আগে অথবা পরে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হতে পারে। চলমান পরিস্থিতিকে আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত না করে সরকার রাজনৈতিক সঙ্কট মনে করবে, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অন্যভাবে বলা চলে, নির্বাচনের ডাক দেয়ার বিষয়ে সরকার একেবারেই উদাসীন। এতে দেশটির রাজনীতি ভেঙে পড়েছে।

অবশ্য ২০১১ সালেই এ ধরনের পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল। ২০১১ সালের ১১ আগস্ট ‘সবাই সংযত হোন’ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলোতে গুরুত্বপূর্ণ একটি কলাম লিখে দেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি।

তিনি লিখেন, ‘বিরাজমান পরিস্থিতি আমার কাছে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে হয়। কী মূল্যস্ফীতি, কী আইনশৃঙ্খলা, কী প্রশাসন, কী অর্থনীতি, কী পররাষ্ট্রনীতি, কী দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের পরিস্থিতি—সর্বত্রই একটা ক্রমাবনতিশীল চেহারা প্রতিদিন অবনতির দিকেই ধাবিত হচ্ছে।

দেশের এ পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ-আশঙ্কা ব্যক্ত না করে আমি আর স্থির থাকতে পারছি না। দেশের এই অধোগতিতে এমন একটা লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে আমাকে আশ্বাসের সুরে বলতে পারবে যে আমি যা দেখেছি তা সব ভুল এবং আমার যে উদ্বেগ, এটার কোনো ভিত্তিই নেই। এমনকি যারা দেশ চালাচ্ছেন, তাদের মুখ থেকেও এই অবনতিশীল অবস্থা সম্পর্কে মাঝে-মধ্যে স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। আমি কারও ওপর দোষারোপ করার উদ্দেশ্যে একথা বলছি না।’





তিনি যে আদালতের প্রধান বিচারপতি ছিলেন সেখানে বিরাজমান পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিমকোর্ট একটি পরিশীলিত প্রতিষ্ঠান। বার এবং বেঞ্চ উভয়েরই উচিত এই স্থানকে রাজনীতির কলুষমুক্ত রাখা, সেখানে বার এবং বেঞ্চ কোনো পক্ষ থেকেই এমন প্রকাশ্য উচ্চারণ হওয়া উচিত নয় যে তারা বিশেষ একটা কিছু সহ্য করবেন না এবং এমন কথা বলবেন না যাতে আপনাদের অসহিষ্ণুতা বা বিচারকসুলভ সংযমের বিপরীতে ক্রুদ্ধতা বা আক্রোশের মনোভাব প্রকাশ পায়। ক্রমাগতভাবে এবং অতি দ্রুত সুপ্রিমকোর্টের এই অস্বাভাবিক অবস্থা আমার কাছে বড় বেদনাদায়ক। আমাদের চিত্তের উন্মত্ততা, আমাদের কর্মের নিষ্ঠুরতা ও আমাদের বিচারবুদ্ধির দেউলিয়াপনা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এর আগে আমি আমার দেশে এই চরম মত্তাবস্থা কোনোদিন দেখিনি।’

দেশের বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আবেদন জানিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘দেশের বহু সঙ্কটে আপনাদের বুদ্ধিদীপ্ত সতর্ক অবস্থান ও হস্তক্ষেপ অনেক সময় সরকার ও সরকারবিরোধীদের সংযত হতে সাহায্য করেছে। ভবিষ্যতেও আপনাদের কাছে সেই ভূমিকা প্রত্যাশিত। দেশের এই মহাসঙ্কটে আপনারা যেখানেই অরাজকতা দেখবেন সেখানেই গলা উঁচু করে তার প্রতিবাদ জানাবেন এবং অবনতিশীল বাংলাদেশকে চূড়ান্ত অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করবেন। আমি বিনয়ের সঙ্গে সবাইকে সংযত আচরণের আহ্বান জানাচ্ছি।’

বিচারপতি মোস্তাফা কামাল অবনতিশীল বাংলাদেশকে চূড়ান্ত অধঃপতনের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়াসী হতে এবং গলা উঁচু করে প্রতিবাদ জানানোর আহ্বান জানিয়ে গেছেন। তার উদ্বেগের কারণ হলো- বাংলাদেশ চূড়ান্ত অধঃপতনের কিনারায় পৌঁছে গেছে। এরকম পরিস্থিতিতে একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

মূলত: শীতলযুদ্ধের অবসানের পর থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসে। এক্ষেত্রে মার্শাল টিটোর সম্মোহিনী নেতৃত্ব বিচিত্র জাতিসত্তার দেশ যে যুগোস্লাভিয়া ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিশ্ব মানচিত্রে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার মৃত্যুর পর বিভেদের বীজ থেকে ঘৃণা ও বিদ্বেষের আগুনে শেষ পর্যন্ত যুগোস্লাভিয়াকে খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার পথে নিয়ে গেল।

এভাবে শুধু যুগোস্লাভিয়া নয়, আরও কয়েকটি দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায়-সোমালিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়েছে যে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য ত্রাণসামগ্রী পাঠানোও দুষ্কর। আফগানিস্তান ও ইরাকের কথাও বলতে পারি। জঙ্গিগোষ্ঠীর বোমা হামলায় পাকিস্তানের শত শত লোক নিহত হয়েছে।জঙ্গি দমনে মার্কিন ড্রোন বিমান হামলা ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে বহু মানুষ নিহত হয়েছে। এত রক্ত ও এত মৃত্যুর পাশাপাশি যোগ হয়েছে বন্দরনগরী করাচিতে জাতিগত সহিংসতা। সেখানে প্রতিবেশীকে দেখা হচ্ছে চরম দুশমন হিসেবে। প্রতিবেশীর লাগোয়া ঘরে হামলা চালানোর জন্য বিরাটভাবে দেয়াল ফুটো করার ছবিও আমরা মিডিয়াতে দেখেছি। হিংসায় উন্মত্ত হলে মানুষ কত বদলে যেতে পারে এটি তারই দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের পরিস্থিতিও আজ সেই দিকেই এগুচ্ছে বলে জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। একসময় অর্থাৎ বর্তমান দশকের শুরুর দিকে জাতীয়তাবাদী ঘরানার লোকজন তাদের প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রের জন্য দায়ী করত। এখন জাতীয়তাবাদী ঘরানা এবং আওয়ামী ঘরানা উভয় পক্ষই একে অপরের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে শামিল থাকার অভিযোগ উত্থাপন করছে। ফলে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাটি এখন আর কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর একার ব্যাপার নয়। তবে কী কারণে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে সে ব্যাপারে দুই পক্ষের ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ আলাদা।

আওয়ামী ঘরানার লোকজন বলছে চারদলীয় জোটের লোকরা জঙ্গিবাদকে লালন করছে বলেই বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে চারদলীয় জোট বিশেষ করে বিএনপির বক্তব্য হলো দেশের তাবত্ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে এবং বাংলাদেশকে করদরাজ্যে পরিণত করে ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে দুটি কারণে। প্রথমত: অভ্যন্তরীণ এবং দ্বিতীয়টি হলো বহির্দেশীয়। দুর্নীতি, অনাচার, অপশাসন ও বিশৃঙ্খলার ফলে একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এছাড়া জাতিগত সংঘাত ও তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটেও একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। অন্যদিকে বৈরী বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ ও কূটচক্রান্তও একটি রাষ্ট্রকে ব্যর্থতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দুটি কারণই বেশ প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। সেটাই হলো চরম উদ্বেগের বিষয়।

কেননা, সাম্প্রতিককালে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে রাজনীতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহল। দুই মাস ধরে দেশব্যাপী অবরোধ-হরতাল করছে সরকারবিরোধীরা। এতে প্রতিনিয়ত পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহত হচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। অথবা পেট্টোল বোমা, ককটেল হামলায় হতাহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বিরোধীদের দমন নিপীড়নে এমন কোনো কৌশল নাই যে তা সরকার প্রয়োগ করছে না। ফলে বিভিন্ন মহলের পক্ষ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য সংলাপের আহ্বান জানালেও তা সরকারের পক্ষ থেকে নাকচ করে দিয়েছে।ফলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা আরো ভেঙে পড়তে পারে, আর এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়বে। তাই রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে, তা দেশের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার জন্য খুবই হুমকির মুখে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জনগণ নিরুপায়, তাদের বা কী করার আছে? ফলে এই পরিস্থিতিতে ১৬ কোটি বাঙালী বনি আদমের একমাত্র ভরসা হতে পারে জাতিসংঘ ও ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর প্যারিসের ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা’।

এতে মানবাধিকারের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার প্রতিটি মানুষের এক ধরনের অধিকার যেটা তার জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য । মানুষ এ অধিকার ভোগ করবে এবং চর্চা করবে । তবে এ চর্চা অন্যের ক্ষতিসাধন ও প্রশান্তি বিনষ্টের কারণ হতে পারবে না । মানবাধিকার সব জায়গায় এবং সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য । এ অধিকার একই সাথে সহজাত ও আইনগত অধিকার।স্থানীয়, জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যতম দায়িত্ব হল এসব অধিকার রক্ষণাবেক্ষণ করা ।’
বলা যায়, বিশ্বের সর্বত্র কমবেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে । তবে ক্ষেত্র বিশেষে যেখানে পূর্ণ গণতন্ত্র এবং পরমত সহিষ্ণুতার চর্চা হয় সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মাত্রা অনেক কম।বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষার স্লোগান বিরাজমান থাকার পরেও সর্বত্রই শক্তিমান কর্তৃক দূর্বলের অধিকার খর্বিত হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর চেয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বেশি ।আবার কখনো কখনো বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর দ্বারা অনুন্নত কিংবা উন্নয়ণশীল দেশগুলোর জনগণ অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের হিড়িক চলছে। সংখ্যাগুরুদের দ্বারা সংখ্যালগুরা প্রতিনিয়ত অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে । সবল প্রতিবেশী রাষ্ট্র দ্বারা দূর্বল প্রতিবেশি রাষ্ট্রের অধিকার হরণ তো নিত্য-দিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছে ।
মানবাধিকার যেন আজ স্লোগান সর্বস্ব পড়েছে।দেশের শাসকগোষ্ঠী ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা বাংলাদেশের মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে । অথচ বিশ্বে যারা মানবাধিকার রক্ষার স্লোগান দেয় তারাও চুপ থাকছে।ফলে আন্তর্জাতিক সংবাদ ও মানবাধিকার সংস্থা মতে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আজ অত্যন্ত নাজুক ।

সাধারণ মানুষের মানবাধিকার তো রক্ষা পাচ্ছেই না বরং বিভিন্ন বেসরকারি মানবাধিকার ও সংবাদকর্মীদের উপরও নেমে এসেছে জুলুম নির্যাতন।
অথচ মানবাধিকার সনদে লিপিবব্ধ ৩০টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ১ম অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘যেহেতু বন্ধনহীন অবস্থায় এবং সম-মর্যাদা ও অধিকারাদি নিয়ে সকল মানুষ জন্মগ্রহন করে । সুতরাং ভ্রাতৃত্বসূলভ মনোভাব নিয়ে তাদের একে অন্যর প্রতি আচরণ করা উচিত’ ।

সনদের ২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘যে কোন প্রকার পার্থক্য যথা- জাতি, গোত্র, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা, ধর্ম, রাজনৈতিক বা অন্য মতবাদ, জাতীয় বা সামাজিক উৎপত্তি, সম্পত্তি, জন্ম বা অন্য মর্যাদা নির্বিশেষে কোন পার্থক্য করা চলবে না’ ।

৩য় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই জীবন-ধারন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে’ ।

সনদের ৭ম অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আইনের কাছে সকলেই সমান এবং কোনরূপ বৈষম্য ব্যতিরেকে সকলেরই আইনের দ্বারা সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার রয়েছে’।

সনদের ৯ম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কাউকে খেয়াল-খুশিমত গ্রেফতার, আটক অথবা নির্বাসন দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে না’ ।

১৪নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্যাতন এড়ানোর জন্য প্রত্যেকেরই আশ্রয় প্রার্থনা ও আশ্রয় লাভ করার অধিকার রয়েছে’।

১৯তম অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই মতামতের ও মত প্রকাশের স্বাধিকার রয়েছে’।

বাংলাদেশে মানুষ কি আন্তর্জাতিক সনদের এসব অধিকারের নিশ্চয়তা পাচ্ছে? প্রতিদিন মানুষ মরছে, শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, রাজনীতিক, মজুরসহ অসংখ্য মানুষ গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছে । গুম যেন ট্রাডিশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে রক্ষকরাই এখন ভক্ষকের ভূমিকায়।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ধারাসমূহ যেন প্রায় সম্পূর্ণটাই উপেক্ষিত । সবমিলেই বাংলাদেশে আজ মানবাধিকার ভুলুণ্ঠিত।
এমতাবস্থায় ‘সার্বজনীন মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা’ অনুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের অধিকারসমূহ রক্ষায় জাতিসংঘ এগিয়ে আসবে এমনটি প্রত্যাশা বঞ্চিত-নিপীড়িত জনগণের।

জাতিসংঘ কী ভুমিকা রাখতে পারে?
আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণের অধিকার রক্ষায় জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় সংকটের সমাধান হতে পারে। এরপরও সমাধান না হলে জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।তাতেও কাজ না হলে জাতিসঙ্ঘের চ্যাপ্টার ৭ অনুযায়ী সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ ও প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমেও মানুষের অধিকার রক্ষা করতে পারে জাতিসংঘ। ফলে সংকট নিরসনে জাতিসংঘকেই আজ আরো জোরালো ভুমিকা রাখতে হবে। অন্যথা বাংলাদেশে যেসব মানবাধিকারের ঘটনা ঘটছে এর জন্য একদিন জাতিসংঘকেই দায় নিতে হবে।

লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক



মন্তব্য চালু নেই