ভিটামিন `এ` ক্যাপসুল খাওয়াবেন যে কারণে…
সারাদেশে আজ উদযাপিত হচ্ছে জাতীয় ভিটামিন `এ` প্লাস ক্যাম্পেইন দিবস। আপনার শিশুকে ক্যাপসুল খাওয়াতে নিকটবর্তী টিকা কেন্দ্রে নিয়ে যান। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ক্যাপসুলটি খাওয়াতে কোনো ভাবেই যেন ভুল না করেন। কারণ, ভিটামিন-‘এ’ এর অভাবজনিত রোগ থেকে আপনার সন্তানকে রক্ষা করবে এই ক্যাপসুল।
দিবসটিতে সারা দেশে প্রায় ২ কোটি ১৪ লাখের বেশি শিশুকে ক্যাপসুল খাওয়ানোর টার্গেট নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে আপনার সন্তানটিও।
পৃথিবীতে অন্ধত্বের চারটি প্রধান কারণের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত কর্ণিয়ার রোগ ও কর্ণিয়ার ক্ষত অন্যতম। বাকী কারণগুলো হচ্ছে- ছানি, ডায়াবেটিসজনিত চক্ষুরোগ ও গ্লুকোমা। সাধারণত: ০-৬ বছর বয়সের শিশুরা ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত চক্ষুরোগে ভোগে। খাদ্যে ভিটামিন ‘এ’ এর স্বল্পতা অথবা পরিপাকতন্ত্রের রোগ- যেমন দীর্ঘমেয়াদী ডায়ারিয়ার কারণে খাদ্যনালীর ভিটামিন ‘এ’ এর শোষণ ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত চক্ষুরোগ দেখা দেয়। শিশুদের জীবনে অন্ধত্বের অভিশাপ নেমে আসে।
এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯০ হাজার শিশু ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবজনিত চক্ষুরোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায়।
দেহে ভিটামিন ‘এ’-এর প্রয়োজনীয়তা এতই যে- ১. দৃষ্টি শক্তি স্বাভাবিক রাখতে ভিটামিন ‘এ’ বিরাট ভুমিকা পালন করে। ২. ত্বক ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য ভিটামিন ‘এ’ প্রয়োজন। ৩. দেহ বৃদ্ধি, বিশেষ করে দেহের অস্থি কাঠামোর বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভিটামিন ‘এ’ এর সংযোগ রয়েছে। ৪. ভিটামিন ‘এ’ জীবাণু সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। ৫. দেহ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় ভিটামিন ‘এ’ এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
অন্যদিকে দৈনন্দিন ভিটামিন ‘এ’-এর চাহিদা একজন সুস্থ মানুষের রোজ ৭৫০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’-এর প্রয়োজন। আবার গর্ভাবস্থায় ও স্তন্যদানকারী নারীর ভিটামিন ‘এ’-এর চাহিদা বেড়ে যায়। শিশুদের রোজ ৩০০ থেকে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’-এর দরকার। বয়:সন্ধিকালেও (১৩-১৯ বছর) ভিটামিন ‘এ’-এর চাহিদা বেড়ে যায়।
ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত চক্ষুরোগকে জেরোফথালমিয়া বলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষ কমিটি ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত চক্ষুরোগকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন-
১. রাতকানা রেটিনা Photorecepter-এর সাহায্যে কোন কিছুর ছবি গ্রহণ করে। Photorecepter দুই প্রকারঃ রড ও কোন্। রড অনুজ্জ্বল আলোতে বা কম আলোতে সক্রিয় হয় এবং কোন্ উজ্জ্বল আলোতে সক্রিয় হয়। উজ্জ্বল আলোতে বা দিনের বেলায় কোন্ কাজ করে। অল্প আলোতে দেখার জন্য রড অত্যাবশ্যক। আলোকিতস্থানে কিছুক্ষণ থাকার পর অন্ধকার স্থানে আসলে প্রথমে প্রায় কিছুই দেখা যায় না। বেশী অন্ধকার মনে হয়। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার ধীরে ধীরে কমে আসে এবং অন্ধকারেও মোটামুটি ভাল দেখা যায়। এই অবস্থায় রড কাজ করে। কোন্ তাৎক্ষণিক ভাবে সক্রিয় হয়। কিন্তু রড সক্রিয় হতে ১০ থেকে ২০ মিনিট সময় লাগে। যদি দেহে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাব হয় তবে রড সক্রিয় হতে অধিক সময় নেয় বা আদৌ পুরোপুরি সক্রিয় হয় না। রডের মধ্যে ভিজুয়াল পারপল রডপসিন থাকে।
ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবে রডের রডপসিন তৈরি হতে পারে না। রডের সুষ্ঠু কার্যকারিতা ব্যাহত হবার ফলে শিশু রাতে ভাল দেখতে পায় না। একেই রাতকানা রোগ বলে। শরীওে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবের এটাই প্রথম উপসর্গ।
২. কনজাংটিভাল জেরোসিস বা কনজাংটিভার শুষ্কতা। ভিটামিন ‘এ’-এর অভাব বেশি দিন চলতে থাকলে কনজাংটিভা শুষ্ক হয়ে যায়। কনজাংটিভা নির্মল ও স্বচ্ছ দেখানোর পরিবর্তে শুষ্ক, অপরিচ্ছন্ন ও কুঁচকানো দেখা যায়। এ অবস্থায় কনজাংটিভা পুরু হতে পারে। প্রথমে সমস্ত কনজাংটিভা শুষ্ক না হয়ে কিছু অংশে শুষ্কতা দেখা দেয়। ক্রমান্বয়ে কনজাংটিভার সকল অংশই শুষ্ক ও অনুজ্জ্বল হয়ে যায়।
৩. বিটট্স স্পট। কনজাংটিভার মধ্য দিয়ে সাদা ফেনার মত লবণদানার মত ত্রিকোণকার ধূসর বর্ণের যে দাগ দেখা যায়, এটাকেই বিটট্স স্পট বলে। এই দাগগুলো সাধারণত: দ্বিপার্শ্বিক হয়ে থাকে। বিটট্স স্পটকে জেরোফথালমিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন বলে মনে করা হয়।
৪. কর্ণিয়ার শুষ্কতা। সাধারণত: কনজাংটিভার শুষ্কতাকেই অনুসরণ করেই কর্ণিয়ার শুষ্কতা দেখা দেয়। কর্ণিয়ার পৃষ্টদেশ শুষ্ক হয়ে যায়। কর্ণিয়ার উজ্জ্বলতা কমে যায় এবং কর্ণিয়া ঘষা কাঁচের মত হয়ে যায়।
৫. কর্ণিয়ার এক তৃতীয়াংশের ক্ষত। প্রথম অবস্থায় কর্ণিয়ার এই ক্ষত বেশ ছোট থাকে এবং সেটি সাধারণত:
গোলাকার থাকে। কর্ণিয়ার বাইরের পরিধিতে এ ক্ষত দেখা যায়। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করতে পারলে দৃষ্টিশক্তির তেমন ক্ষতি হয় না। তবে ক্ষত সেরে গেলেও দাগ থেকে যায়।
৬. কর্ণিয়ার এক তৃতীয়াংশের বেশি ক্ষত। ছোট ক্ষত ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। সময় মত চিকিৎসা না হলে ক্রমে ক্রমে ক্ষত সমগ্র কর্ণিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় কর্ণিয়া ফুটো হয়ে যায়। এ অবস্থায় শিশু স্থায়ীভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে।
৭. কর্ণিয়াতে দাগ। পূর্বে জেরোফথামিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকলে কর্ণিয়ায় দাগ পাওয়া যেতে পারে। রোগের পরিমাণের উপর নির্ভও করে দাগ কম বা বেশি হবে। রোগীর কাছ থেকে ইতিহাস গ্রহণ করার মাধ্যমে বোঝা যাবে যে সে ভিটামিন ‘এ’-এর অভাবজনিত রোগে ভুগছে।
৮. কেরাটোম্যালাশিয়া। এ অবস্থায় চোখের কর্ণিয়া সাদা হয়ে ফুলে যায়, নরম হয়ে যায় ও গলে যায়। শিশুর জীবনে নেমে আসে অন্ধত্বেও অভিশাপ। এ অবস্থায় শিশুরা চরম পুষ্টিহীনতায় ভোগে। গায়ের চামড়া খসখসে হয়ে কুনোব্যাঙের চামড়ার মত হয়ে যায়, চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায় ও পায়ে মুখে পানি আসে।
দিবসটি উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ভিটামিন-‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর হার শতভাগে উন্নীত করা সম্ভব হয়েছে এবং ‘এ’র অভাবজনিত রাতকানা রোগের হার শতকরা ১ ভাগেরও নিচে নেমেছে। এবছর দুর্গম এলাকাগুলোতেও এই ক্যাম্পেইন সফল করার লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ক্যাম্পেইন পর্যালোচনা করতে প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও কেন্দ্রে এ দিবসে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম খোলা থাকবে বলেও জানান তিনি।
তিনি এই কর্মসূচি সফল করতে দেশবাসীর প্রতিও আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের মা-বাবা ও অভিভাবকরা যেন অবশ্যই তাদের শিশুদের এ সেবা নিতে কেন্দ্রে আসেন আনেন। মন্ত্রণালয়, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, ছাত্র-শিক্ষক, সাংবাদিক-সবাই এ কার্যক্রমে অংশ নেবেন।
ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল গ্রহণকারীদেও করনীয় হচ্ছে, ‘শিশুদের অবশ্যই ভরপেটে আসতে হবে। ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুলের মুখ কেটে ভিতরে থাকা তরল ওষুধ চিপে খাওয়ানো হবে। জোর করে বা কান্নারত অবস্থায় ক্যাপসুল খাওয়ানো ঠিক হবে না।
৬ থেকে ১১ মাস বয়সী সকল শিশুকে ১ টি করে নীল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী সকল শিশুকে ১ টি করে লাল রঙের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। দিবসটিতে টিকাদান কেন্দ্রগুলো খোলা থাকবে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। সারা দেশে এক লাখ ২০ হাজার স্থায়ীকেন্দ্রের সঙ্গে আরও ২০ হাজার ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রে এ সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, ব্রিজের টোলপ্লাজা, বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, খেয়াঘাটে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্রগুলো থাকবে। প্রতিটি কেন্দ্রে কমপক্ষে ৩ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী দায়িত্ব পালন করবে।
রাষ্ট্রপতি শুক্রবার বঙ্গভবনে বেশকিছু শিশুকে ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাপসুল খাওয়ানোর মাধ্যমে দেশব্যাপী এ ক্যাম্পেইনের উদ্বোধন করেন। তিনি পিতা-মাতার প্রতি তাদের ৬ মাস থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের এই জীবন রক্ষাকারী ক্যাপসুল খাওয়াতে নিকটবর্তী টিকা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য পিতা-মাতাদের প্রতি আহবান জানান।
আব্দুল হামিদ বলেন, ‘এই টিকাদান কর্মসূচি সফল করতে পারলে আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।’
মন্তব্য চালু নেই