ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি, তিস্তা নিয়ে সংশয় সন্দেহ বিশ্লেষকদের
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর মাত্র একদিন পর শুক্রবার ভারত সফরে যাচ্ছেন। এই সফরে ভারতের সঙ্গে ৩০টির অধিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ভারতের সঙ্গে সামরিক চুক্তি ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে কোনো চুক্তি হচ্ছে কি না এ নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য না থাকায় জনমনে দেখা দিয়েছে সংশয়-সন্দেহ। এসব চুক্তি নিয়ে অনেকেই অন্ধকারে আছে বলেও জানিয়েছেন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে কোনো চুক্তি নানা কারণে স্পর্শকাতর। কাজেই যে কোনো বিষয়ে চুক্তি হলেও সে সম্পর্কে জনগণ বিস্তারিত জানতে চায়। জনগণকে না জানিয়ে কিছু করা হলে তখনই বিভিন্ন ধরনের সন্দেহ-গুজব তৈরি হয়। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে যে চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে সেগুলো সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানে না। সামরিক চুক্তি ও তিস্তার পানি চুক্তি হবে কিনা সে বিষয়টি এখনো দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার নয়।
তবে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফরে ৩৩টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। তবে সামরিক কোনো চুক্তি হচ্ছে না, হবে সমঝোতা স্মারক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে রয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে তিস্তা পানি বণ্টন নিয়ে কিছু না হলেও এই সফরে এর কোনো রকম প্রভাবই পড়বে না।
মন্ত্রী জানান, এ চুক্তি বা সমঝোতা স্মারকের বেশির ভাগই সীমান্ত হাট স্থাপন, তথ্য ও সম্প্রচার, বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট ও মহাকাশ গবেষণা, ভূ-তাত্ত্বিক বিজ্ঞান, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা, ভারত কর্তৃক প্রদেয় তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি), কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্পর্কিত।
বিরল-রাধিকারপুর রুটে মালামাল পরিবহনকারী রেল চলাচল, খুলনা-কলকাতা রুটে যাত্রীবাহী বাস ও রেল চলাচল এবং ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশে অতিরিক্ত ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ প্রক্রিয়ার উদ্বোধন। এ ছাড়াও দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র হিন্দি অনুবাদের মোড়ক উন্মোচন করবেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে ৭ থেকে ১০ এপ্রিল দলটি সফর করবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে দেশটির সঙ্গে সম্ভাব্য চুক্তিগুলোর বিষয়বস্তু জনগণের সামনে প্রকাশের দাবি জানিয়েছে বিএনপি।
মঙ্গলবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরের আগেই তার সফরকালে যে সকল চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তার সবকটি জনগণের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করবে। কারণ জনগণই এদেশের মালিক।’
পানি বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যে সমস্ত চুক্তি হবে, সেগুলো কেবিনেট থেকে অনুমোদন দিয়েছে। তিস্তার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে কর্মকর্তারা সচিব পর্যায়ে একমত হয়ে অনুস্বাক্ষর করেছেন। এখন রয়েছে ফরমালিটি, এটা কবে শেষ হবে কে জানে।’
জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হয়ে আছে। এরপর ভারত উজান থেকে তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে।
এছাড়া পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘বিষয়টা এমন জটিল হয়ে গেছে যে, অনেক কিছু জানা যায়, আবার অনেক কিছু জানা যায় না। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, জানা যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জি আপত্তি জানাচ্ছেন। তাহলে তো কেন্দ্র বলে কিছু থাকল না।’
‘ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা থাকার কথা। এখানে বাংলাদেশের থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের চুক্তি হওয়ার কথা সেখানে জাতীয় পর্যায় আসার কথা নয়। জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে চুক্তি হচ্ছে সেটা কি পানি ভাগাভাগি হবে? এটা তো জানা যায়নি। সিকিম অনেকগুলো বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রাখেছে; কিন্তু তা নিয়ে কোনো কথা নেই,’মন্তব্য করেন তিনি।
প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘দিন দিন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পানির অভ্যাবে শিলিগুড়ি এলাকা উত্তপ্ত। এসবের সমস্যার সমাধান না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।’
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের বিভিন্ন সম্পর্কে জানাতে চাইলে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের এজেন্ডা কী তা জানানো হয়নি। সংসদেও আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিকদলগুলোর সঙ্গেও কোনো কথা হয়নি, জনগণ অন্ধকারেই আছে। দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য হলেও সকলের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার ছিল।’
তিনি বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য শক্তিশালী অবস্থান বলতে যা বুঝায় তা আমরা দেখছি না। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে কেন্দ্র করে ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম যেভাবে খবর দিচ্ছেন তাতে জনগণ সন্তুষ্ট নয় এবং মন্ত্রীরা একেক জন একেক কথা বলছেন। একজন বলছেন তিস্তা এতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে তাদের।’
আন্তজার্তিক পানি চুক্তি অনুযায়ী পানি আসছে না এমনটা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শুধু তিস্তাই নয়, চুক্তি অনুযায়ী অন্য নদীর পানিও আসছে না। টিপাই বাঁধ বন্ধ করল কি না সেটা পরিষ্কার নয়। আন্তঃনদী সংযোগে ব্রহ্মপুত্র নদী থেকে পানি সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বক্তব্য নেই। এবং ৫৪টি নদী পানির ন্যায্য হিস্যা, সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধ হবে কি না তার সঙ্গে আরো অনেক বিষয়ে কথা নাই। এখানে বলা হচ্ছে প্রতিরক্ষা চুক্তি, এটা কি পানির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল। তিন দিকেই ভারত। ফলে ভারতের দিকে থেকে যদি কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করা হয় তাহলে আমাদের নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই।’
জানা গেছে, ২০১০ সালে তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ভারতের সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। ওই চুক্তির খসড়ায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়- তিস্তার ৪০ ভাগ পানি ভারত পাবে এবং ৪০ ভাগ পাবে বাংলাদেশ। আর তিস্তার নাব্য রক্ষার জন্য থাকবে বাকি ২০ ভাগ পানি। বাংলাদেশের এ প্রস্তাব নিয়ে মমতা ব্যানার্জির তীব্র আপত্তি থাকায় ঝুলে যায় বাংলাদেশ-ভারত অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তি।খবর পরিবর্তনের।
মন্তব্য চালু নেই