বড় ধরণের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেলো দেশ
সারাদেশে শনিবার দুপুরে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার তীব্র ভূকম্পন অনুভুত হয়েছে। এর উৎপত্তিস্থল ঢাকা থেকে ৭৪৫ কিলোমিটার দূরে নেপালে হওয়ায় এ যাত্রায় বড় ধরণের বিপর্যয় থেকে দেশ রক্ষা পেলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক শাহআলম বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে ৭৪৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে এর উৎপত্তিস্থল ছিল। ফলে এর প্রভাব এ দেশে পড়তে পড়তে খানিকটা দুর্বল হয়েছে।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এর আগে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভুত হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে ৬.৭ মাত্রার, ১৯৫৪সালে ৭.৪ মাত্রার, ১৯৫০ সালে ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভুত হয়েছিল। রিখটার স্কেলে ৫ মাত্রার ভূমিকম্পকে মাঝারি মাত্রার ধরা হয়। আর এর বেশি মাত্রা হলে শক্তিশালী বা তীব্র ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়। শনিবারের ভূমিকম্প ছিল শক্তিশালী।
এই ভূমিকম্পে নেপালে শতাধিক এবং বাংলাদেশে তিনজন নিহত হয়েছে। ভূমিকম্পের সময় রাজধানী ঢাকার বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। নগরবাসী ঘর ছেড়ে বাইরে বের হয়ে আসেন। গার্মেন্টস কর্মীদের পাশাপাশি বেসরকারি অফিসে কর্মরতরাও রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে অফিস ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন এবং ছুটোছুটি করতে থাকেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতেই আমাদের দেশে শক্তিশালী ভুমিকম্পের জন্য ভূতাত্বিক পরিবেশ বিদ্যমান। রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। দেশের অভ্যন্তরে যে চারটি ফল্ট রয়েছে তাতে শক্তিশালী ভূমিকম্পের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত থাকায় যে কোন সময় বড় ধরণের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব ফল্টে অতীতে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে তা ৭ মাত্রার বেশি ছিল। ডাউকি ফল্টে ১৮৯৭ সালে ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। মধুপুর ফল্টে ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ওপরে ভূমিকম্প হয়েছিল।
১৭৬২ সালে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল সীতাকুন্ড-মিয়ানমার ফল্টে। আসাম-সিলেট ফল্টে শক্তিশালী ভূমিকম্প হয়েছিল প্রায় ৪শ বছর আগে। অর্থাৎ এসব ফল্টে গড়ে একশ বছর পূর্বে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। এখন বড় ধরণের ভূমিকম্পের জন্য যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন তা এসব ফল্টে সঞ্চিত আছে। এতে করে যে কোন সময় বড় ধরণের ভূমিকম্পের আশঙ্কায় রয়েছে বাংলাদশে।
যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের রজার বিল হাম তার গবেষণায় বলেছেন, হিমালয়ের পাদদেশে মেইন বাউন্ডারী ট্রাস্ট (এম বি টি) রয়েছে যা বাংলাদেশ থেকে ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে। এখানে ইউরেশিয়া প্লেটের নিচে ইন্ডিয়ার যে প্লেটটি তলিয়ে যাচ্ছে সেটি লক হয়ে আছে। তবে তা খুলে গেলে বাংলাদেশ ভুটান ও নেপালে ৮ মাত্রার ভুমিকম্প হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৫০ বছরে বাংলাদেশে ৭টি বড় আকারের ভূমিকম্প হয়েছে যার মধ্যে দুটির কেন্দ্র ছিলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। এর মধ্যে একটি ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প যার কেন্দ্র ছিলো সিলেটের শ্রীমঙ্গলে। আর ১৮৮৫ সালের ১৪ জুলাই একই মাত্রার ভূমিকম্প হয় যার কেন্দ্র ছিলো মানিকগঞ্জে। আরো কয়েকটি ভূমিকম্প বাংলাদেশের কেন্দ্রে না হলেও রেখে গেছে ধ্বংসের স্বাক্ষর। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ৮.৭ মাত্রার ভূমিকম্প যার কেন্দ্র ছিলো ভারতের শিলং শহরে। সে সময় বহুতল ভবন না থাকায় তেমন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
কিন্তু এখন রাজধানীসহ সারাদেশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেছে হাজারো ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন।
রাজউক সূত্রমতে, ঢাকা মহানগরীর ৫৯০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় মোট ১২ লাখ ৫০ হাজার ভবন রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান শহরেই রয়েছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবন। আর ঐতিহ্যবাহী ভবন রয়েছে ২২৯টি। এছাড়া মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা ৩২১টি। এরমধ্যে নিয়ম বর্হিভুতভাবে গড়ে ওঠা প্রায় ৫ হাজার বহুতল ভবনকে চিহ্নিত করেছে রাজউক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনগুলো একটু বড়ধরনের ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করতে পারবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তাই এখনই যথার্থ পদক্ষেপ না নিলে যে কোনও সময় মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে রাজধানীবাসী। দেখা দিতে পারে মানবিক বিপর্যয়। এছাড়া ভুমিকম্পের সচেতনতা আমাদের একেবারে নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে সরকারের প্রস্তুতিও তেমন চোখে পড়ার মত নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলেছেন, পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ঢাকা। সেইসঙ্গে ঢাকায় রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। স্বাভাবিকভাবেই যেখানে ঘনবসতি বেশি সেখানে ঝুঁকিও বেশি। শক্তিশালী ভূমিকম্পে রাজধানীতে ধসে যেতে পারে ১০ শতাংশ ভবন। আর এতে কমপক্ষে ২ লাখ মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। ধসে যাওয়া ভবনে অবরুদ্ধ হবে ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষ। নগরবাসীদের উদ্ধারে যথাযোগ্য প্রস্তুতি না থাকায় গ্যাস লাইন ফেঁটে, বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হয়ে ও অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভুমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলেন, ‘সরকারকে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে রেট্রোফিটিং করার পাশাপাশি হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি জরুরী প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভুমিকম্পের পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যাপক প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির ব্যবস্থা করতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে জনসচেতনা বৃদ্ধিতে।
মন্তব্য চালু নেই