বোবাকান্নায় ফুটপাতে চাপা পড়ে ওদের ঈদ
প্রতিবছর ঈদ আসে মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। খুশির জোয়ারে সবাই যখন ভাসে, তখন কান্নায় কেপেঁ ওঠে ওদের বুকটা। নিজেরা আপন ভুবনে হাসি-খুশি থাকার চেষ্টা করলেও কাউকে দেখলেই মুখটা আড়ালে লুকিয়ে নেয়। কারণ, ঈদে কোনো বিশেষ আনন্দই স্পর্শ করে না ওদের। সমাজে ওদের নাম ছিন্নমূল মানুষ কিংবা টোকাই। কেউ বস্তিতে থাকে, কারো আবার ফুটপাতের ওপরই রাত কাটে; সবাই ওদের চোখ-মুখে অসহায়ত্বের ছাপ দেখে নিজের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে কেবল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেও পাশ দিয়ে হেঁটে যায়।
এদের একজন ছয় বছরের মান্না। কাওরান বাজারের ফুটপাতে থাকে। সারা দিন কাঁচাবাজার ও ডাস্টবিন থেকে কুড়ে পাওয়া খাদ্য খেয়েই জীবন ধারণ। জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘ঈদের দিন আসলে কিছু টাকা পাই। তা দিয়ে সারাদিন খেতে পারি। এ ছাড়া বাকি দিনগুলোতে কোনোদিন পেট পুরে খেতে পারি না।’
কারওয়ান বাজারের পেট্রোবাংলার বিপরীত দিকে ফুটপাতে দেখা গেল, প্রায় ৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা কাঁদছেন। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, ‘বাবা ঈদের দিন বইসা আছি, সবাই ভালো খায়, সকাল থেইক্যা শুধু দুই মুঠ খই খাইছি।’ পরিচয় জানতে চাইলে বলেন, ‘বাবা নরসিংদীতে গ্রামের বাড়ি। ব্রিটিশ আমল থেইক্যা কাওরান বাজারের ফুটপাতে থাকি। স্বামী-ছেলে-মেয়ে কেউ বাইছা নেই। বিয়ের পর অল্প বয়সে জামাই মইরা গেছে। নিজেরে আমানত রাখছি, জামাইর লগে ওয়াদা করছি তাই আর বিয়া বসি নাই। বাবা বিয়ে দিতে চাইছে পালাইয়া চইলা আইছি।’
‘শরীরে এখন শক্তি নাই তাই হাঁটতে পারি না, ভিক্ষা কম পাই।’ সারা দিন খেতে পারি না,’ বলেন ওই বৃদ্ধা।
কারওয়ান বাজার রেললাইনের পাশে বসে আছেন আরো কয়েকজন বয়স্ক নারী। পাশেই কিছু শিশু। কথা হয় ছয় বছরের নিমতারার সঙ্গে। গায়ে জামা নেই, পরনে পুরোনো ছেঁড়া প্যান্ট। রেললাইনে বসে হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে। ঈদ কেমন কাটছে? জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ‘ভালো।’
জামা কিনেছো?
নিমতারা বলল, ‘আমার বাপ নাই। মা কইছে পরে আইনা দেবে।’ মেহেদি কোথায় পাইছো? জানতে চাইলে তার জবাব, ‘রাস্তায় পাইছি, হেটা হাতে লাগাইতাছি।’
জাহানারা বেগম নামের আরেক বৃদ্ধা বলেন, ‘স্বামী ছেলে-মেয়ে কেউ নেই; সারা দিন ভিক্ষা কইরা যা পাই, তা খেয়ে পড়ে থাকি। ঈদের দিন সবাই নতুন কাপড় পরে; আর আমরা ছিন্নমূল কাপড় পইরা আছি বাবা। খাওয়ার কিছু নাই। একটা লোকে সকালে দুইটা রুটি দিছে, তা খাইছি। অহন ক্ষিদা লাগছে; কোনো খাওয়ার নাই।’
এভাবেই ঘুরছে ছিন্নমূলদের ‘ভাগ্যচক্র’। কারো বাবা-মা আছে। আবার কারো বাবা-মা থেকেও নেই। আবার কেউ কেউ জানেই না, কে তাদের বাবা-মা। ঠিকানা নেই। পথই ওদের ঠিকানা। দিনভর পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, রাতেও পথেই ঘুমায়।
নতুন জামার বিষয়ে জানতে চাইলে আট-নয় বছরের ফজলু বলে, ‘আমাদের ঈদ নেই। আর নতুন জামা কে দেবে?’
মান্না নামের আরেক ছিন্নমূল শিশু বলল, ‘গেল বছর একটি জামা পাইছিলাম। নতুন জামা দিয়ে কী হইব? রাস্তায় ঘুমাইলে জামা তো আর নতুন থাহে না।’
মন্তব্য চালু নেই