বেড়েই চলেছে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের মৃত্যুর মিছিল
বেড়েই চলেছে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের মৃত্যুর মিছিল। সাম্প্রতিক সময়ে গহীন জঙ্গলে গণকবর আর সমুদ্রে নৌকাডুবিসহ না খেয়েও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হয়েছে অভিবাসন প্রত্যাশী কয়েক শতাধিক বাংলাদেশি। আর কোনমতে জীবন বাঁচিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেছেন ও ফিরছেন অনেকে। সর্বশেষ লিবিয়া ও অস্ট্রিয়ায় ফের মৃত্যুর মিছিলে যোগ হলো আরো প্রায় অভিবাসন প্রত্যাশী প্রায় ৩০জন বাংলাদেশি!
শনিবার লিবিয়া উপকূলে অভিবাসন প্রত্যাশীবাহী দুটি নৌকা ডুবির ঘটনায় অন্তত ২৪জন বাংলাদেশির মৃত্যুর আশংকা করা হচ্ছে। উদ্ধার করা হয়েছে ৫৪বাংলাদেশিকে। নৌকা দুটিতে কমপক্ষে ৭৮জন বাংলাদেশি ছিলেন বলে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাস জনিয়েছেন।
আর মধ্য ইউরোপোর দেশ অস্ট্রিয়ায় একটি লরি থেকে শিশুসহ ২৬ অভিবাসী প্রত্যাশীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন বলে পুলিশের বরাত দিয়ে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে ২৪জন বাংলাদেশির মৃত্যু!
ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় আরও ১৬ বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর জানিয়েছে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস। এ নিয়ে এ ঘটনায় মোট ২৪ জন বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেল।
শনিবার (২৯ আগস্ট) লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর আশরাফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে শুক্রবার (২৮ আগস্ট) আট বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাস।
২৭ আগস্ট ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূলের কাছে চার শতাধিক অভিবাসন প্রত্যাশী নিয়ে পৃথক দু’টি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। ইউরোপ পাড়ি জমানোর উদ্দেশে অভিবাসন প্রত্যাশীরা বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সিরিয়া, মরোক্ক ও আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি এলাকা থেকে এসেছিলেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ।
আশরাফুল আলম জানান, দূতাবাস কর্তৃপক্ষকে এখনও মৃত বাংলাদেশিদের মরদেহ দেখানো হয়নি। লিবিয়ার প্রথা অনুযায়ী মরদেহ দেখানোর নিয়ম নেই।
নৌকাডুবির প্রায় দু’দিন পর উদ্ধার হওয়ায় বেশিরভাগ মরদেহই বিকৃত হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, তাদেরকে লিবিয়ায়ই দাফন করা হবে।
দূতাবাসের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, নৌকায় মোট ৭৮ জন বাংলাদেশি ছিলেন। এদের মধ্যে ৫৪ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে, শ্রম কাউন্সিলর আশরাফুল আলম জানিয়েছেন, জীবিত উদ্ধার হওয়া বাংলাদেশির মধ্যে শুধুমাত্র চার পরিবারের তিন নারী ও কয়েকটি শিশুকে মুচলেকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। তাদেরকে লিবিয়ায় অবস্থানরত কয়েকটি বাংলাদেশি পরিবারের জিম্মায় রাখা হয়েছে। এছাড়া নৌকাডুবির ঘটনায় ওই চার পরিবারের এক নারী ও দুই পুরুষ সদস্যের মৃত্যু হয়েছে।
তিনি জানান, যাদেরকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে, তাদেরকে লিবিয়া পুলিশ নিজেদের হেফাজতে রেখেছে। বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহ করা হয়েছে।
এখন পর্যন্ত জীবিত উদ্ধার ২০ বাংলাদেশি দেশে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন জানিয়ে আশরাফুল আলম বলেন, তাদেরকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মাধ্যমে ফিরিয়ে আনা হবে।
তিনি আরও জানান, যেসব বাংলাদেশির কাগজপত্র ঠিক আছে, তারা লিবিয়াতেই থেকে পারবেন। তবে যাদের কাগজপত্র ঠিক নেই, তাদেরকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। তবে তার আগে প্রয়োজনীয় কিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
এখন পর্যন্ত প্রথম দফায় যে আট বাংলাদেশির মরদেহ উদ্ধার করা হয়, তাদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় জানা গেছে। এরা হলেন- রমজান আলী ( ৫৮), সানোয়ারা খাতুন (৪২), ইউসুফ (৭), রিমা আবদুল আজিম (২), রাইসা আবদুল আজিম (৮ মাস), আবুল বাশার (৪৭) ও তার মেয়ে।
অস্ট্রিয়ায় লরি থেকে বাংলাদেশিসহ ২৬ অভিবাসী উদ্ধার
এদিকে, মধ্য ইউরোপোর দেশ অস্ট্রিয়ায় একটি লরি থেকে শিশুসহ ২৬ অভিবাসীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছেন বলে পুলিশের বরাত দিয়ে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
স্থানীয় সময় শুক্রবার (২৮ আগস্ট) অস্ট্রিয়ার ব্রাউনাউ জেলায় লরিটি আটক করা হয়। এ ঘটনায় পালিয়ে যাওয়ার সময় লরির চালককে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, উদ্ধার অভিবাসীদের মধ্যে তিনটি শিশুর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লরির মধ্যে গাদাগাদি করে রাখায় শিশুগুলো প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে। তাদের বয়স ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে।
থামতে সিগন্যাল দিলে তা উপেক্ষা করে চালক লরিটি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় পেছনে ধাওয়া করে চালককে আটক করে ও এর ভেতর থেকে বাংলাদেশিসহ ২৬ অভিবাসীকে উদ্ধার করে পুলিশ।
উদ্ধার অভিবাসীদের মধ্যে বাংলাদেশি ছাড়াও আফগানিস্তান ও সিরিয়ার নাগরিক রয়েছেন। জামার্নি যাওয়ার উদ্দেশ্যে তারা লরিটিতে চেপে বসেন বলে অভিবাসীদের বরাতে জানিয়েছে পুলিশ।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার (২৭ আগস্ট) অস্ট্রিয়ায় একটি কাভার্ড ভ্যানের ভেতর থেকে অর্ধশতাধিক লোকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়। এদের প্রায় সবাই মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়া কোনো দেশের শরণার্থী। অর্ধশতাধিক ওই মরদেহের মধ্যে কোন বাংলাদেশি ছিলেন কিনা তা জানা যায়নি।
দেশটির সবচেয়ে পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বারগেনল্যান্ডের একটি মহাসড়কের পার্কিংস্থল থেকে ৫০ মরদেহবাহী ওই ভ্যানটি পাওয়া যায়। ভ্যানটির নম্বরপ্লেটটি হাঙ্গেরির। তবে হতভাগ্য মৃত লোকগুলোর জাতীয়তা বা পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।
অস্ট্রিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোহানা মিকল-লেইতনার ও পুলিশের মুখপাত্র হ্যান্স পিটার দোসকোজিলের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এ খবর দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যম বলছে, জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মারকেলসহ ইউরোপীয় নেতারা যখন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় অভিবাসী সংকট নিরসনে করণীয় নির্ধারণে আলোচনায় বসেছেন, তখন এ ৫০ শরণার্থীর মরদেহ উদ্ধারের খবর এলো।
ভ্যানটি উদ্ধারের পর আয়োজিত জরুরি সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মুখপাত্র হ্যান্স পিটার দোসকোজিল বলেন, আমরা ধারণা করছি, ভ্যানে রাখার কারণে শরণার্থীদের দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে। তারা কোনো মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়েছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জোহানা মিকল-লেইতনার বলেন, এটা আমাদের সবার জন্য দুঃখের সংবাদ। আমরা জানি, মানবপাচারকারীরা কতো ভয়ংকর অপরাধী।
সরকারি হিসাব মতে, অস্ট্রিয়ায় চলতি বছর সোয়া ২৮ হাজারেরও বেশি শরণার্থী আশ্রয় চেয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে আসা।
উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের দূর্গম পাহাড়ি-বনাঞ্চলে সন্ধান পাওয়া অসংখ্য গণকবরে পাওয়া গিয়েছে শত শত লাশ। গহীন জঙ্গলের পাশাপাশি বিশাল সমুদ্রেও নৌকা ডুবি ও না খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েছে এমন শতশত অভিবাসন প্রত্যাশী। অর্থনৈতিক ভাগ্যোন্নয়নের অভিপ্রায়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে বাধ্য হওয়াদের মধ্যে বহু বাংলাদেশিও আছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
আর কোনরকম জীবন বাঁচিয়ে মৃত্যুর ছোবল থেকে ফিরেছেন ও ফিরছেন হাজারো অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশি।
দেশব্যাপী সক্রিয় মানবপাচার চক্রের মূল উৎপাটন করা না গেলে অবৈধ পন্থায় অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশিদের মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনা যেমন দূষ্কর তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও তেমনটি করা জরুরী বলে মনে করছেন অনেকে।
মন্তব্য চালু নেই