বেশি কথা বলবি না- এমপি বানাইয়া দিমু!

ঘটনার দিন আমি কি মনে করে যেন গাড়ি ছাড়াই বের হলাম। আমার অফিস থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে প্রেসক্লাবের সামনে চলে গেলাম। রোজার মাসের ক্লান্ত বিকাল। শত শত লোক দাঁড়িয়ে আছেন বাস বা রিকশার জন্য। লক্ষণ দেখে মনে হলো দুই-তিন ঘণ্টা দাঁড়ালেও একটা রিকশা হয়তো পাওয়া যাবে না। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। প্রেস ক্লাবকে বাঁয়ে রেখে ফুটপাত ধরে আমি হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে মনের আনন্দে একদম শিক্ষা ভবনের কাছাকাছি চলে এলাম। আমার মনে আনন্দ হচ্ছিল এ কারণে যে, তোপখানা রোডের অফিস থেকে শিক্ষা ভবন পর্যন্ত হেঁটে আসতে আমার সময় লাগল সাকুল্যে ১১ মিনিট। অথচ যারা গাড়ি, বাস বা রিকশায় বসেছিল তারা এ ১১ মিনিটে হয়তো ১১ গজও অতিক্রম করতে পারেনি ট্রাফিক জ্যামের কারণে। আমার এ সফলতায় মনে মনে আমি ভীষণ পুলক অনুভব করলাম এবং পদচালনায় নতুন মাত্রা যোগ করলাম। আমি ধীরে ধীরে চ্যাগাইয়া ব্যাগাইয়া হাঁটতে থাকলাম এবং আশপাশে কে কি বলছে এবং কে কি করছে তা দেখা এবং শোনার জন্য চোখ-কানকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখলাম।
আমি দেখলাম প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়েও মানুষ বিরক্ত হচ্ছে না। রিকশার আরোহীরা মজা করে নানান কথা বলছে। এক রিকশাওয়ালা আরেক রিকশাওয়ালার সঙ্গে গায়কী ভঙ্গিতে রঙ্গ রসের কথা বলছে। বাসের কন্ডাক্টররা বাস থেকে একে অপরের হাত ধরে কি সব যেন বলাবলি করছে। অন্যদিকে দুটি বাসের ড্রাইভার গলা বাড়িয়ে নিজেদের বউ আর শালীদের নিয়ে কিছু দুষ্ট দুষ্ট কথা বলল। ঠিক এ সময়ে দুই রিকশাওয়ালা একজন আরেকজনের সঙ্গে মৃদু খটমটানী লাগিয়ে দিল- একজন আরেকজনকে বলছে, আমারে চিনসনি! বেশি বাড়াবাড়ি করবি না। শরীরে রক্ত টগবগ করতাছে। অন্যজন একটু বয়স্ক এবং রসিক বলে মনে হলো। সে বলল, আরে তোমারে চিনব না ক্যান, তুমি তো আমাদের এমপি সাব! সালাম এমপি সাব! আমার ভুল হইয়া গ্যাছে, মাফ কইরা দিয়েন। অন্যজন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না। বলল এই শালা ঠাট্টা মারো কোথাকার! বয়স্ক রিকশাওয়ালা এবার সত্যিই মজা পেল। সে বলল, ও মামা রাগ কর ক্যান। আমি কি মন্দ কিছু বললাম? আমি কি তোমারে বাপ-মা বা বউয়ের নাম তুইল্লা গাইল দিচ্ছি! তোমারে এমপি সাব কইছি। তরুণ রিকশাওয়ালা এবার তেড়ে এলো এবং বলল আর একবার যদি এমপি বইল্যা গাইল দ্যাস তোর মাইরে…। বয়স্ক লোকটি খুব দক্ষতার সঙ্গে অতি দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিল। সে তরুণ রিকশাওয়ালার কলার চেপে ধরে কষে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল। তারপর বলল- ‘এই ব্যাটা! বেশি কথা বলবি না, তাইলে এমপি বানাইয়া দিমু। এমন সিল পিডা দিমু যে সারা জীবন সুইয়া সুইয়া এমপিগিরি করন লাগব।’
উল্লিখিত ঘটনা ওখানেই শেষ হলো সম্ভবত দুটি কারণে। প্রথমত সিগন্যালের কারণে, গাড়ি চলতে শুরু করল। দ্বিতীয়ত সিল পিটানোর ঝক্কি ঝামেলায় তরুণ রিকশাওয়ালাটি হয়তো জড়াতে সাহস পাচ্ছিল না। সে লেজ গুটিয়ে তার রিকশার নিকট ফিরে এলো এবং মুদ্রণের অযোগ্য কিছু গালাগাল করতে করতে চলে গেল। তারা তো চলে গেল কিন্তু সমস্যা হলো আমার। আমি এতক্ষণ মনের আনন্দে যেভাবে চ্যাগাইয়া-ব্যাগাইয়া হাঁটছিলাম তা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো বয়স্ক রিকশাওয়ালাটি যেন প্রকারান্তরে আমার কান মলে দিয়ে গেল! সিল পেটানোর কথার অন্তরালে আমার পিঠে ও পাছায় ছ্যাঁচা দেওয়ার হুমকি দিল। আমি আনমনে আমার কানে হাত দিলাম এবং পিঠ ও পাছায় হাত বুলিয়ে ওখানকার গরম গরম ভাবসাব বোঝার চেষ্টা করলাম।
এমপিজাতীয় শব্দটির সঙ্গে প্রায় পাঁচটি বছর আমার এক ধরনের আত্দিক সম্পর্ক ছিল। এমপি হওয়ার স্বপ্ন আমি লালন করছিলাম ১৯৮৬ সাল থেকে। এমপি হওয়ার যুদ্ধে অবতীর্ণ হই ২০০১ সালে। আট বছরের মাথায় নমিনেশন পাই ২০০৮ সালে। ২০ বছরের লালিত স্বপ্ন এবং আট বছরের নির্বাচনপূর্ব মনোনয়নযুদ্ধে আমার জীবনের অনেক স্বর্র্ণালি সময় এবং শ্রমলব্ধ অর্থ ব্যয় করতে গিয়ে আমি যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম ঠিক তখনই সুযোগ আসে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১১৩ পটুয়াখালী-৩ আসনে আমার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বয়ং আমার মামা শ্বশুর।
সেকি ভয়ঙ্কর অবস্থা, তিন-চারটি ইউনিয়নে প্রায় হাজার চল্লিশেক রক্ত সম্পর্কীয় আত্দীয়স্বজন তাদের শত বছরের পারিবারিক ঐক্য এবং রক্ত সম্পর্ক ভুলে নৌকা এবং ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। আমার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে পর্যন্ত ধানের শীষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে নানাবাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিল। আমার শ্বশুর মহাশয় তার শ্যালকের সঙ্গে নেমে গেলেন আর আমার শ্যালক তার বাবা ও মামার বিরুদ্ধে দুলাভাইয়ের পক্ষে নেমে গেল। চারদিকে টান টান উত্তেজনা। রোজই টুকটাক মারামারি লাগে। সব কিছু সামাল দিতে উভয় পক্ষই দুই হাতে টাকা উড়াতে লাগলাম। এভাবে প্রায় ৫০ দিবস ও রজনী নিদ্রাহীন উৎকণ্ঠা এবং ঘাম ঝরানোর পর যখন জয়লাভ করলাম তখন সত্যিই আনন্দিত হয়েছিলাম। এমপি পদটিকে মনে হয়েছিল আমার পরম পাওনা এবং একান্ত যক্ষের ধন। সেই সম্মানিত পদটি যখন একজন রিকশাওয়ালার তাচ্ছিল্যের বস্তু হয়ে যায় তখন নিজের কাছে কেমন লাগে সেই অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমি এখনো রপ্ত করতে পারিনি কিংবা সেই অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মতো শক্তি আমার কলম এখনো অর্জন করতে পারেনি।
একজন লুটেরার দ্বারা প্ররোচিত হয়ে আমার দলের প্রভাবশালীরা যখন আমাকে রাস্তার একজন ছিনতাইকারী বা ছিঁচকে চোরের মতো টেনেহিঁচড়ে জেলে নিল তখনো অতটা অপমানিত হইনি। কিন্তু যখন রিকশাওয়ালা আমার এত সাধের অর্জনটি নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করল তখন মনের গভীর থেকে গভীরতম স্থানে প্রচণ্ড আঘাত অনুভব করলাম। শিক্ষা ভবনের সামনের রাস্তা পার হয়ে হাইকোর্ট মাজারের প্রবেশদ্বারের সামনে দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। অনেকে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করলেন। অন্যদিকে যারা চিনলেন না তারা চিন্তায় পড়ে গেলেন এবং ভাবতে থাকলেন অল্প বয়সী লোকটি কে? কেনইবা এত লোকজন তাকে সালাম দিচ্ছে? দু’একজন ফিসফিসিয়ে সালাম প্রদানকারীদের জিজ্ঞাসা করলেন- ভদ্রলোক কে? তারা বললেন এমপি রনি। মাজার গেটের সামনে বাবরি চুলওয়ালা বিভিন্ন ভাবের ফকির ও ভিক্ষুক সারাক্ষণ হল্লা করে। এদের অনেকের মাথার চুল ভীষণ হিজিবিজি এবং ময়লাযুক্ত। অনেকের চুলে আবার লম্বা লম্বা জটও রয়েছে। অনেকের মুখের অপরিচ্ছন্ন লম্বা দাড়ি এবং ঘন মোচে মিতালী করে এমনভাবে জড়াজড়ি করে থাকে যে ওগুলোর ফাঁক দিয়ে তাদের ঠোঁট দেখা যায় না। আমি ওই এলাকা দিয়ে হেঁটে পার হওয়ার সময় প্রায়ই একটু দাঁড়াই এবং মনে মনে ভাবি আহারে বেচারারা এত বড় দাড়ি আর মোচ নিয়ে কীভাবে দই খায়? সেদিনও ওমনটি ভাবতে যাচ্ছিলাম আর তখনই আমাকে শুনতে হলো আরেকটি মন্দ শব্দ। এমপি শব্দটি একজন পথচারীর মুখ থেকে শোনার সঙ্গে সঙ্গে একজন জটাধারী ফকির বলে উঠল- ‘শালা গুয়ামারা এমপিরে আবার সালাম দ্যান ক্যা।’ আমি কথাটি শুনলাম। কিন্তু ভয়ে পেছনে ফিরে তাকাতে সাহস পেলাম না। কেবল শুনলাম পথচারী বলছেন তিনি একজন সাবেক এমপি।
আমি খুব দ্রুত ওই এলাকা পার হয়ে শিশু একাডেমির সামনে দিয়ে ডানদিকে মোড় নিয়ে টিএসসির দিকে এগুতে থাকলাম। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনের ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ নজর পড়ল একটি মোটাতাজা ঘোড়ার দিকে। ওটি তখন পার্কের ভেতর ঘাস খাচ্ছিল। আমার মনটা বেশ ভারি ছিল। তাই একটু হালকা হওয়ার জন্য পার্কের ভেতর ঢুকে ঘোড়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার মনে পড়ল পুরান ঢাকার লোকেরা এক সময় বলতেন- সাব ও কতা আর কইয়্যেন না, ঘোড়ায় হাসব। আমি ঘোড়ার হাসি নিয়ে ভাবছিলাম এবং বেশ মনোযোগ সহকারে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ঘোড়া দেখছিলাম। কিন্তু মনের বেদনা দূর হচ্ছিল না। বারবার মনে পড়ছিল- সিল পিডাইয়া এমন এমপি বানাইয়া দিমু যে সারা জীবন সুইয়া সুইয়া এমপিগিরি করণ লাগব এবং গুয়ামারা এমপিরে সালাম দ্যান ক্যা। আমি ঘোড়ার মুখের দিকে তাকালাম এবং গুয়ামারা কথাটির অর্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। আমি আসলে শব্দটির আভিধানিক অর্থ জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে ওটি সম্ভবত একটি গালি। আমার হঠাৎ প্রচণ্ড হাসি পেল শিশুকালের একটি ঘটনা মনে পড়ার কারণে।
আমার বয়স তখন বড়জোর পাঁচ-ছয় বছর হবে। প্রতিদিন সকালে সূর্য ওঠার আগে গ্রামের অন্যান্য শিশু ও বালক-বালিকার মতো আমিও মক্তবে যেতাম কোরআন পড়া শেখার জন্য। হুজুর বয়স্ক মানুষ। অত্যন্ত রাশভারী এবং রাগী হওয়ার কারণে আমরা তাকে যমের মতো ভয় পেতাম। বাচ্চারা অন্যায় করলে তিনি সপাৎ সপাৎ বেত মারতেন। ফলে প্রায় ২০০ ছেলেমেয়েকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তিনি একাই পড়াতেন। কেউ টুঁ-শব্দটি না করে একসঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে পড়ত আলিফ জবর আ, বা জবর বা ইত্যাদি। সেদিনও আমরা পড়ছিলাম। হুজুর আমাদের সুুর করে একটি নতুন শব্দের বানান এবং উচ্চারণ শেখাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, বাচ্চারা বলো- গাইন পেশ গু, ওয়া নুন জবর ওয়ান- গুয়ান, নুন দুই পেশ নুন- গুয়াননুন। হঠাৎ কি হলো একটি বাচ্চা হেঁচকি তুলে জোরে বলল গুয়াননুন। আর যায় কোথায়! হাসির রোল পড়ে গেল। ২০০ বাচ্চা একসঙ্গে শুরু করল হাসি। হুজুর দুই-তিনবার জোরে ধমক দিলেন। তাতে কাজ হলো না, বরং হাসির মাত্রা বেড়ে গেল। একজন আরেকজনকে খোঁচা দেয় আর বলে ওরে আমার গুয়াননুন রে! হাসতে হাসতে একসময় শুরু হলো ধাক্কাধাক্কি, তারপর গড়াগড়ি। এতে অনেক বাচ্চা ছেলের লুঙ্গি খুলে গেল। অন্যরা সে দৃশ্য দেখে বলল- ও গুয়াননুন, ও গুয়াননুন। শেষমেশ ওস্তাদজী মক্তব ছুটি দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন।
শৈশব স্মৃতি মনে করে হাসছিলাম আর ঘোড়াটির সঙ্গে খাতির জমানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘোড়াটি আমাকে পাত্তা দিচ্ছিল না। আমিও নাছোড় বান্দা, ঘোড়ার কাছ থেকে আমাকে পাত্তা পেতেই হবে। এমন সময় বড্ড ছেলেমানুষের মতো বললাম- এমপি! ঘোড়াটি কিসে কি বুঝল বলতে পারব না, তবে জানোয়ারটি ঘাস খাওয়া রেখে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমার মনে হলো ওটি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা করে মুচকি হাসি দিল এবং চোখ টিপে বন্ধুত্বের ইঙ্গিত দিল। আমি পাত্তা পেয়ে বললাম, অটো এমপি, সিল পিডানো এমপি। এবার ঘোড়াটি মহাবিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে ভুর ভুর, ভ্যার ভ্যার শব্দ করে এমন ভেটকি মারল যে, আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। এরপর জন্তুটি আমার দিকে তার পশ্চাৎদেশ ঘোরাতে আরম্ভ করল। আমি জানি ঘোড়া পেছনে ফিরে দুপা একসঙ্গে করে লাথি মারে। আমি বুদ্ধিমানের মতো পরিস্থিতি অনুমান করে দ্রুত ওই স্থান ত্যাগ করলাম।



মন্তব্য চালু নেই