অভিজিৎ হত্যা

বুয়েট শিক্ষকের দিকে ইঙ্গিত অজয় রায়ের

একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বুয়েটের তারিক ফারসীম মান্নান নামের এক শিক্ষক জড়িত বলে সন্দেহ করছেন তার বাবা অজয় রায়। এছাড়াও তিনি কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতাসহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজের অনুসন্ধানের সার্বিক চিত্র গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তুলে ধরেছেন বলেও দাবি করেন। অথচ একমাস পেরিয়ে গেলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই বলে তার অভিযোগ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরসি মজুমদার মিলনায়তনে শুক্রবার আয়োজিত এক নাগরিক সমাবেশে এমনটাই জানান তিনি। ‘অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের ক্ষমা নেই’ এ স্লোগানে নাগরিক কমিটির উদ্যোগে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা বক্তব্য রাখেন।

অভিজিৎের বাবা অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, ‘আমরা বিধ্বস্ত, আমাদের পরিবার বিধ্বস্ত। অভিজিৎের মতো একজন বিজ্ঞানমনস্ক লেখক, আমি মনে করি কিছু ক্ষেত্রে সে তার বাপকেও ছাড়িয়ে গেছে। তার দর্শন ছিল প্রথাবিরোধী। তার দেয়ার অনেক ছিল, কিন্তু মৌলবাদীরা তাকে বাঁচতে দিল না।’

তিনি বলেন, ‘তাকে হত্যার পর আমি এ ব্যাপারে খোঁজখবর নিই। যেদিন তাকে হত্যা করা হয় সেদিন হাসিন মান্নান নামের বুয়েটের একজন শিক্ষক তাকে মেসেজ করে। সেদিন অভিজিতের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। অনুষ্ঠানের পর তারা বইমেলায় অনেকক্ষণ আড্ডা দেয়। হাসিন মান্নান নামক ওই শিক্ষকের ডাকা আড্ডায় উপস্থিত ছিল “জিরো টু ইনফিনিটি” ও “পাই” নামের দুটি বইয়ের (ম্যাগাজিন) লেখক-সম্পাদকরা। অভিজিৎকে হত্যা করার পর আমি ওই দুটি বইয়ের ব্যাপারে খোঁজখবর নিই। “জিরো টু ইনফিনিটি” বইটির সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, যে একসময় শিবিরের উঁচুমানের নেতা ছিল। আড্ডার পর সস্ত্রীক বেরিয়ে আসার পর তাকে হত্যা করা হয়। এসব তথ্য আমি আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে দিয়েছি। কিন্তু প্রায় মাসখানেক হতে চলেছে, এ ঘটনার আমরা কোন দৃশ্যমান ফল পেলাম না।’

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘পুলিশের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন, তারা কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিল? না করলে, কেন? কাদের চক্রান্তে তারা সহায়তা করেছিল?’

তিনি বলেন, ‘দানবের সঙ্গে মানবের সংগ্রাম চলছে। মানবীয় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে নাগরিক সমাজকে সংঘবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করতে হবে।’

সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল শওকত আলী বলেন, ‘যারা অভিজিৎদের হত্যা করতে চায় তারা মোটেই সাহসী নয়। সেজন্যেই তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালায়। এদের প্রতিহত করার জন্য শুধু সরকারের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে হবে না, এ জন্য নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের স্বাধীনতা আছে, এখন শুধু তা রক্ষা করতে হবে। শত্রু খুবই দুর্বল, আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিহত করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শুধুমাত্র মুক্তচিন্তা দর্শনের কারণে অভিজিৎকে হত্যা করা হয়েছে। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের উপর আঘাত। যারা এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনাগুলো ঘটায়, সেসব মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবেলা করার জন্য আমাদের গ্লোবাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে। আমাদের অস্তিত্বের সংগ্রামে টিকে থাকার জন্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’

নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর আনিসুজ্জামান বলেন, ‘আমরা যে মুক্তবুদ্ধির কথা বলি তা আর থাকবে না, আমরা যে স্বাধীন দেশের কথা বলি তা আর থাকবে না যদি এভাবে অভিজিৎরা খুন হতে থাকে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে, আগামীতেও চলবে।’

সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, ‘প্রতিক্রিয়াশীল জোটের সঙ্গে আমরা আপোষ করে চলছি। এভাবে চলতে পারে না। একাত্তরে আমরা যুদ্ধ করেছি, এখন আমাদের শেষ যুদ্ধটি করতে হবে।’

ন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল একুশের পরিশীলিত ভক্তগণ। নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল রাষ্ট্র, রাষ্ট্র তার কর্ম ক্ষমতা দেখাতে পারেনি। আমরা বিচারহীনতার মধ্যে আছি। অঘোষিত দায়মুক্তি বিচারহীনতার কারণ।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফরিদউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ কামনা করেছিলাম। যুদ্ধাপরাধের বিচার চলাকালীন এ ধরনের আঘাত হতেই পারে তা আমাদের মাথায় রাখা উচিৎ ছিল। তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। তাই কথার ফুলঝুড়ি না ছুটিয়ে আমাদেরও প্রতিঘাত করতে হবে।’

বিশিষ্ট কলামিস্ট ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘যুক্তির বিরুদ্ধে হিংস্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং যুক্তির শক্তি লোপ পাচ্ছে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব মুক্তচিন্তার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সমৃদ্ধির চিন্তা করতে হলে এর বিকল্প নেই।’

প্রফেসর আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে সমাবেশে দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশের শুরুতে অভিজিতের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিভিন্ন সংগঠন।



মন্তব্য চালু নেই