বুড়িগঙ্গায় পানি নেই সবটাই বিষ!
খল আর দূষণে ধুঁকছে বুড়িগঙ্গা। নানা রাসায়নিক বর্জ্যে অনেক আগেই বিষাক্ত হয়েছে পানি। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। ঢাকার প্রাণরূপী বুড়িগঙ্গা এখন নগরবাসীর ভাগাড় মাত্র!
আগে শুধু দিনের আলোয় দেখা যেত, এখন রাতের আঁধারেও সহজেই বোঝা যায় বুড়িগঙ্গার নিকষ কালো পানির ওপর ভাসতে থাকা সাদা ফেনার আস্তরণ। সাধারণত লঞ্চ বা নৌকা চলার সময় স্রোতের সঙ্গে বেশি মাত্রায় ভেসে ওঠে এ ধরনের ফেনা। তবে সারাক্ষণই এখানে-সেখানে খণ্ড খণ্ড এমন ফেনা চোখে পড়ে। কখনো হালকা আবার কখনো ভারী স্তর দেখা যায়, যা নিয়ে বুড়িগঙ্গার আশপাশের মানুষের মধ্যেও রয়েছে উত্কণ্ঠা। বুড়িগঙ্গার পানিতে বিষাক্ত দ্রবণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এমন ফেনা উঠছে বলে মত পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের। ভয়ে অনেকেই ওই পানি স্পর্শ করা বাদ দিয়েছেন। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও বিষাক্ত রাসায়নিকের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। শুকনো মৌসুমে এই ফেনার মাত্রা বেশি থাকে বলে জানায় স্থানীয়রা।
পানি বিশেষজ্ঞ ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফিরোজ আহম্মেদ বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা নদীর পানির অবস্থা এখন এতটাই খারাপ যে এটা দূষণ পরিমাপের মাত্রারও নিচে নেমে গেছে। অর্থাৎ দ্রবীভূত অক্সিজেনের মান মাত্রা শূন্য ডিগ্রির নিচে চলে গেছে। ওই তরলকে এখন পানি বলা যায় না; বরং পুরোটাই সেপটিক কন্ডিশনের বিষাক্ত তরল। ফলে ওখানে এখন সব কিছুই বিষাক্ত। নানা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এখন শুধু ফেনাই নয়, নানা রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যেতেই পারে। ’
কেরানীগঞ্জের নৌকার মাঝি মকবুল হোসেন বলেন, ‘আগে এই নদীতেই গোসল করতাম, হাত-মুখ ভিজাইতাম। কিন্তু অখনে নৌকা চালাইলেও ডরে পানি ছুঁইতে চাই না। এমনেই পানি যেমুন কালা ও ঘন, তার মধ্যে পানিতে ফেনা ভাসে। সাবানের ফেনার মতন। ’
আরেক মাঝি আবুল কালাম বলেন, ‘পানিগুলান যেমুন কালা, হেমুনই গন্ধ। মুহে দিলে জিব্বায় জিনজিন করে। গোসলের পর গায়ের মইদ্যে খালি চুলকানি ধরে। ফেনাগুলান গায়ে লাগলেও চুলকায়। ডরে আমরা পানি ধরতে পারি না। ’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন—বাপার সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, ‘ফেনার বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। আমরা প্রতি মাসেই বুড়িগঙ্গার পানিতে দূষণমাত্রা পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা দেখছি, আগের তুলনায় নদীর কোনো কোনো অংশে কেমিক্যাল দূষণের মাত্রা বেড়ে গেছে। যেসব এলাকায় এ ধরনের দূষণ বেশি, সেখানেই ফেনার স্তর বেশি দেখা যায়। ’
নাসের খান আরো বলেন, ‘সাধারণত বুড়িগঙ্গার যে এলাকাগুলোর নালা থেকে বেশি মাত্রায় বিষাক্ত তরল বর্জ্য নির্গত হয়, সেসব এলাকার পানিতে দূষণ বেশি পাওয়া যায়। ওই পানি শুধু মানুষই নয়, পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। তবে বর্ষার সময় পানির প্রবাহ বেশি থাকায় দূষণের মাত্রা কম থাকে। ’
পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বুড়িগঙ্গায় দূষণের মাত্রা কোনোভাবেই কমছে না, বরং বেড়েই চলছে। যেখানে বিওডি ৫০ থাকা দরকার, সেখানে বুড়িগঙ্গার বেশির ভাগ স্থানেই শুকনো মৌসুমে ওই মাত্রা শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। ফলে অক্সিজেন ঘাটতি থেকে এমন ফেনা উঠতে পারে।
পানিতে রাসায়নিক দূষণ নিয়ে কাজ করা আরেক বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, কোনো না কোনো কেমিক্যালের কারণেই এমন ফেনা হচ্ছে, যা আশপাশের কলকারখানা থেকে নির্গত হতে পারে। তবে কোন ধরনের কেমিক্যাল থেকে ওই ফেনা উঠছে তা পরীক্ষা করা জরুরি। পরীক্ষা না করা পর্যন্ত এটা নিয়ে মানুষের আশঙ্কা বা উদ্বেগ দূর হবে না। ’
বিশেষজ্ঞরা জানান, কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিকের পাশাপাশি মানুষের মলমূত্র থেকেও এ ধরনের ফেনার উদ্ভব হতে পারে। বুড়িগঙ্গার অল্প আয়তনের মধ্যেই দুই তীরে অসংখ্য কলকারখানা থেকে বর্জ্য নির্গত হয়। এ ছাড়া রাজধানীবাসীর বাসাবাড়ির তরল বর্জ্য পাইপলাইনের মাধ্যমে নির্গত হয়, একই সঙ্গে শত শত নৌযানের বর্জ্যও নির্গত হয়। ফলে এই নদীর পানি এমনভাবে বিষাক্ত ও দূষিত হয়ে পড়ছে, যা নিরাপদ করা বা রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে সরকারের আগের নানা ধরনের উদ্যোগের পাশাপাশি বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা শহরের চারপাশের নদ-নদীর দূষণ রোধে নতুন নতুন আরো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে দখল রোধেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত দেশের নদ-নদী সুরক্ষা সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ৩৪তম বৈঠকেও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নৌপরিবহনমন্ত্রী ও টাস্কফোর্স সভাপতি শাজাহান খান ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেনসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জানানো হয়, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ রোধ এবং নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কমিটি জোরালোভাবে কাজ শুরু করেছে। ওই কমিটিতে প্রয়োজনীয় অন্যান্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, দপ্তর ও সংস্থাকে কো-অপট করার বিষয়েও আলোচনা হয়। কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২ ফেব্রুয়ারি এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ে। ওই সভায় জানানো হয়, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের ৫০ কিলোমিটার এলাকায় সাড়ে ৯ হাজার আরসিসি পিলার নির্মাণ বা পুনর্নির্মাণ করা হবে। পুনঃ জরিপের কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত নদীর দুই তীরে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ রাখা হবে।
বৈঠকে জানানো হয়, হাজারীবাগ থেকে সাভারে এ পর্যন্ত ৪৩টি বড় ধরনের ট্যানারিশিল্প স্থানান্তরিত হয়েছে। অন্যদিকে নদীতীরে ধর্মীয় স্থাপনা বিষয়ে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হবে। নদী রক্ষা বিষয়ে গৃহীত কার্যক্রম গণমাধ্যমে প্রচার, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং অবৈধ স্থাপনা বন্ধে নিয়মিত পরিদর্শন কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জের জন্য দুই হাজার ৫৮৬টি সিএস জরিপ ম্যাপ এবং দুই হাজার ৭৩টি আরএস জরিপ ম্যাপ সংগ্রহ করা হবে। এর আগে গত ৫ ডিসেম্বর এলজিআরডিমন্ত্রীকে চেয়ারম্যান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালককে (প্রশাসন) সদস্যসচিব করে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়।
আরো আগে ২০১২ সালে নদী সুরক্ষা বিষয়ক ওই টাস্কফোর্সের উদ্যোগে বিশেষ পদক্ষেপের আওতায় নদী দূষণ করেছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা করা হয়। এমনকি তখন মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ১৮৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ৩৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আবার ইটিপি স্থাপন না করায় ২২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিছিন্ন করা হয়েছে। পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ দূষণমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হবে। বিআইডাব্লিউটিএর চেয়ারম্যান এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। কমিটির সদস্য রাখা হয় শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, বুয়েট, পরিবেশ আন্দোলন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একজন করে প্রতিনিধি এবং ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মুন্সীগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসকদের।-কালের কণ্ঠ
মন্তব্য চালু নেই