বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে দিল পুলিশ

মিজানুর রহমান ওরফে মঞ্জু আলী (৩২)। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবন্ধীর পরিচয়পত্র অনুযায়ী তিনি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী (দীর্ঘস্থায়ী মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা)। স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বারের প্রত্যয়নপত্রে তাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ হিসেবে। আর পরিবার এবং এলাকাবাসীর কারো কাছে ‘পাগল’; কারো কাছে ‘মেন্টাল’। দীর্ঘদিন ধরে তাঁর চিকিৎসা চলছে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে।

মঞ্জু কোনোদিন রাত কাটান কালীমন্দির-শ্মশানে, কখনো বা মসজিদের বারান্দায়। আবার কখনো ব্রিজ-কালভার্টের ওপর খোলা আকাশের নিচে কাটিয়ে দেন পুরো রাত। প্রায় সময়ই একটি কোদাল ঘাড়ে নিয়ে হেঁটে বেড়ান ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বাড়িতে রাখতে চাইলে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়, বড়জোড় দুই-তিন দিন।

স্বীকৃত এই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে আটক রয়েছেন লালমনিরহাট কারাগারে। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, ‘মাদক কেনাবেচার সময় তাকে এক কেজি গাঁজাসহ আটকের পর মাদকদ্রব্য আইনে মামলা করার পর জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।’

মঞ্জুর পরিবারের ভাষ্যমতে, ১৮ ফেব্রুয়ারি তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি লালমনিরহাট কারাগারে আটক রয়েছেন। অভাবের কারণে বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ বা জামিনের জন্য আদালতে আবেদন করতে পারেননি তাঁরা। তবে বিষয়টি জানিয়ে লালমনিরহাট পুলিশ সুপারের (এসপি) কাছে একটি লিখিত আবেদন জানানো হয়েছে।

মঞ্জু আলীর বাড়ি কালীগঞ্জ উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের শ্রীখাতা গ্রামে। তিনি তাঁর মা মহিলা বেগম মিলির সঙ্গে থাকেন। প্রায় ১২ বছর বয়সে মাথায় আঘাতজনিত কারণে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর দরিদ্র পরিবার দীর্ঘদিন ধরে নানা ধরনের চিকিৎসা করালেও তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেনি। সর্বশেষ তাঁকে রংপুরের একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা করানো হচ্ছিল।

কালীগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা অফিস নিশ্চিত করেছে, মঞ্জু আলী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হিসেবে নিবন্ধিত। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদপ্তরের দেওয়া প্রতিবন্ধীর পরিচয়পত্র অনুযায়ী তিনি একজন ‘বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী (আইডি নম্বর ১৯৮৪৫২১৩৯৩৫৬২৮৫৪৪-০৩)’। ২০১৩ সালের ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন’ অনুযায়ী গঠিত উপজেলা কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে পাঠানো চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী সমাজসেবা অধিদপ্তর প্রতিবন্ধীদের পরিচয়পত্র দিয়ে থাকে।

এদিকে, তাঁকে গ্রেপ্তারের পর দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার শফিকুল ইসলাম এবং একই ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোফাজ্জল হোসেনের দেওয়া পৃথক প্রত্যয়নপত্রে তাঁকে ‘মানসিক প্রতিবন্ধী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার এজাহারে কালীগঞ্জ থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) বসন্ত রায় উল্লেখ করেছেন, ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে উপজেলার দলগ্রাম ইউনিয়নের কামারপাড়া বাজারের শুভজিৎ এন্টারপ্রাইজের উত্তর গলিতে গেলে মঞ্জু একটি ব্যাগসহ পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় তাকে গাঁজাসহ আটক করা হয়।

মঞ্জুর মা মহিলা বেগম মিলি জানান, ঘটনার দিন সকালে বাড়িতে এসে মঞ্জুকে নিজের বাড়িতে মাটিকাটার কাজ করার জন্য অনেকটা জোর নিয়ে যায় একই গ্রামের রাখি ইসলাম। তাঁকে নিয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি লোকমুখে শুনতে পান, মঞ্জুকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) নিয়ে গেছে রাখির বাড়ি থেকে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘মাথায় আঘাত পেয়েই ১২ বছর বয়স থেকে মঞ্জু মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা করালেও তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেননি। বেশ কিছুদিন ধরে টাকার অভাবে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। তবে মাঝেমধ্যে খুব বেশি সমস্যা হলে টাকা জোগাড় করে ইনজেকশন দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখি।’

মা বলেন, ‘আমি ছাড়া ওর দেখার কেউ নেই। কিন্তু পাগল ছেলেটিকে মাদক ব্যবসায়ী বানিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ।’

প্রতিবন্ধীর ভাই মোস্তাফিজুর রহমান রাজা অভিযোগ করেন, ‘রাখি নিজেই গাঁজার ব্যবসায়ী। অথচ পুলিশ তাঁর মাধ্যমে আমার পাগল ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে। নিয়ে যাওয়ার সময় রাখির বাড়িতে মারধরও করা হয়েছে মঞ্জুকে।’

ওই এলাকারই আরেক বাসিন্দা একটি মসজিদের ইমাম আওলাদ হোসেন বলেন, ‘সে তো কোনোভাবেই সুস্থ মানুষ না। কিন্তু কী কারণে তাকে ফাঁসানো হয়েছে, তা বের করা দরকার।’

দলগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘তিনি ছোটবেলা থেকেই মাথার সমস্যায় ভুগছেন। সবাই তাঁকে মঞ্জু পাগলা বলে চেনে। তিনি কখনো মসজিদে, আবার কখনো কালীমন্দিরে থাকেন। এই প্রতিবন্ধীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে মাদক ব্যবসায়ী সাজিয়ে।’

ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান খন্দকার শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবাই জানে তিনি মানসিক প্রতিবন্ধী। তিনি শুধু ঘুরে বেড়ান, নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। তাঁকে কীভাবে মামলায় জড়ানো হলো, সেটা বুঝতে পারছি না। তাকে নিঃশর্ত খালাস দেওয়া হোক।’

একই ইউনিয়নের কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সভাপতি আলহাজ আবদুল জব্বার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘ঘটনাটি শুনে ওই দিনই আমি ফোন দিয়েছিলাম এএসআই বসন্তকে। কিন্তু তিনি কাউকে ধরে আনেননি দাবি করলেও পরে শুনি, ওই বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীকে মাদক মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।’

এএসআই বসন্ত রায় দাবি করেন, ‘মঞ্জুর কাছে মাদক পেয়েই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী কি না জানি না।’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মকবুল হোসেনও একই দাবি করেন।

লালমনিরহাটে সুইড বাংলাদেশের অর্থায়নে দীর্ঘদিন ধরে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা স্বপ্না জামান জানান, বুদ্ধিপ্রতিন্ধীরা সব সময়ই শিশুর মতো আচরণ করে থাকে, ফলে তাদের দিয়ে কেউ কেউ নিজের স্বার্থ হাসিল করে। এ রকম লোকজনকে আইনের আওতায় এনে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর সঙ্গে পুলিশ এ ধরনের আচরণ করলে আমরা তাকে প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা দেবো।’

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের লালমনিরহাট প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রের প্রতিবন্ধীবিষয়ক কর্মকর্তা ফরমান আলী বলেন, ‘এসব বিষয়ে দেখাশোনা করে সমাজসেবা অধিদপ্তর।’

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা জেলা কমিটির সদস্য সচিব ও লালমনিরহাট সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশারফ হোসেন বলেন, ‘তিনি (মঞ্জু) একজন স্বীকৃত বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, তাই মাদক কেনাবেচার জ্ঞান থাকার কথা নয় তাঁর।’



মন্তব্য চালু নেই