বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও সামাজিক অবক্ষয়
ভালোবাসা শব্দটি লিখতে, বলতে ও শুনতে সর্বদাই ভালোলাগে। ব্যক্তি বিশেষ এর উপলব্ধি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সুন্দর মন ভালোবাসার পূর্বশর্ত। ভালোলাগা থেকেই ভালোবাসার জন্ম একথা সর্বজন স্বীকৃত। ভালোবাসা শব্দটি পদ হিসেবে একটি ক্রিয়াপদ, যার অর্থ কারো প্রতি অনুরক্ত হয়ে প্রীতিযুক্ত বা আসক্ত হওয়া, পছন্দ করা, শ্রদ্ধা করা, ভক্তি করা। বিশেষ্য হিসেবে অর্থ প্রেম, অনুরাগ, আসক্তি, বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা, ভক্তি, ¯েœহ, প্রীতি, পছন্দ, টান। (বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান)
আগুন ও পানি দুটি শব্দ, যদিও শব্দের মধ্যে গরম বা ঠা-া কিছুই অনুভব করা যায় না। কিন্তু ভালোবাসা শব্দটি যেন তার বিপরীত। শব্দটায় মায়া-মমতায় জড়ানো এমনটিই অধিকাংশের ধারণা। ইসলাম ভালোবাসাকে গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করেছে। পৃথিবীর সব ভালোবাসাই যেন আপনজনকে ঘিরে শুরু হয়। কখনো কখনো ভালোবাসাকে ঘিরে আত্মার বন্ধন তৈরি হয়। যাকে আমরা আত্মীয় বলি। কখনো আত্মীয়তাকে পুঁজি করে ভালোবাসার সূত্রপাত হয়ে থাকে। ভালোবাসা ব্যাপারটি আল্লাহ প্রদত্ত, কেউ চাইলেই ভালোবাসা পান না, আবার কেউ না চাইতেই আশাতীতভাবে পেয়ে যান। ভালোবাসা থাকলেই কেবল জান্নাতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু তা অবশ্যই হতে হবে একমাত্র আল্লাহ ও তার রাসূলের জন্য।
ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু হয় আধুনিক ভ্যালেন্টাইন ডে রীতি। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের একটি নাম ভ্যালেনটাইনেস ডে। তরুণ-তরুণীরা মনের মানুষের কাছে চিঠি, এসএমএস, ভিডিও বার্তায় ভালোবাসার নিমন্ত্রণ পাঠায়। ১৯৩৬ সালের পূর্বে কাগজের কার্ডের পরিবর্তে তামার পাত বা কাঠের ফলকে খোদাই করে মনের কথা পাঠানো হতো। ইউরোপে ১৪ ফেব্রুয়ারি আসার এক সপ্তাহ পূর্ব থেকেই উৎসব শুরু হয়ে যায়।
পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এ দিবস ঘটা করেই পালন করা হয়। শিশুরা স্কুলে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ সঙ্গীত পরিবেশন করে। বিশেষ খাবারের আয়োজন করে ইতালির অধিবাসীরা। আর কাগজের তৈরি লাল ফুল বিনিময় করে ডেনমার্কবাসী। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। রয়েছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদযাপন পরিষদ, ‘যৌতুক নয় ভালোবাসায় জীবন গড়ি’ স্লোগান নিয়ে ১৯৯৮ সালে এ দেশে তাদের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়।
গত কয়েক বছর ধরে অনেক মুসলিম দেশে এই দিবস পালনের রীতি চালু হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন হোক বা না হোক দিবস পালনের নিষেধাজ্ঞা চোখে পড়ে না। বরং কিছু কিছু মিডিয়া এমনভাবে অনুষ্ঠান প্রচার ও লেখালেখি করে যাতে অর্ধ-মৃত মানুষেরও ঘুম ভেঙে যায় এই দিবস পালনের তাড়নায়। কারো কারো কাছে এ দিবস যেন অর্থ উপার্জনের হাতিয়ার। তারা নানাভাবে উপার্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর শুরুর ইতিহাস হিসেবে একাধিক ঘটনা জানা যায়। কোনটি সঠিক বলা মুশকিল। প্রত্যেকেই তার নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেন। প্রাচীন রোমবাসী কুমারী মেয়েরা ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনে ভালোবাসার কাব্য লিখে মাটির পাত্রে জমা করত আর যুবকরা পাত্র থেকে একটি লেখা তুলে নিতো। যুবকের হাতে যার লেখা উঠে আসতো সেই মেয়েটিকেই সে ভালোবাসতো। (বিশ্ব দিবস)।
অপর একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, রোমান সা¤্রাজ্যে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার নিষিদ্ধ হওয়ার পর ধর্ম প্রচারের অভিযোগে ইতালির সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক একজন চিকিৎসক খ্রিস্টান পাদ্রিকে তৎকালীন রোমান স¤্রাট দ্বিতীয় ক্রাডিয়াস বন্দি করেন। বন্দি অবস্থায় কারারক্ষীর দৃষ্টিহীন মেয়েকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলার ফলে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েটির সঙ্গে ভ্যালেন্টাইন ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কারাবন্দি অবস্থায় সে ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়লে রাজা তাকে মৃত্যুদ- দেন (১৪ ফেব্রুয়ারি)। এরপর থেকেই খ্রিস্টান সম্প্রদায় ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে এ দিবসটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করতে থাকে।
ভ্যালেন্টাই দিবসের মতো খ্রিস্টানরা আরো অনেক দিবস পালন করে থাকে। যেমন- সেন্ট এন্ডু ডে (৩০ নভেম্বর), সেন্ট মার্টিন ডে (১১ নভেম্বর), সেন্ট বার্থেলোমিজম ডে (২৪ আগস্ট), সেন্ট জর্জ ডে (২৩ এপ্রিল), সেন্ট পথাট্রিক ডে (১৭ মার্চ)। কিন্তু উৎসবের প্রকাশভঙ্গি গির্জার চেতনাবিরোধী হয়ে পড়ায় ১৭৭৬ সালে ফ্রান্স সরকার কর্তৃক ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ হয়।
আজকাল ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই এক শ্রেণীর প্রেমিক-প্রেমিক দু’জন দু’জনকে একান্তে পাওয়ার ইচ্ছায় নানা কিছু করে। কার্ড, ফুল, চকলেট, লটারি, বিনোদন, ডেটিং, অশ্লীল বৈশিষ্ট্যের পার্টিতে যোগদান, নানা কিছু উপহার দেয়া, মন বিনিময়, মত বিনিময় এ দিবসের মূল লক্ষ্য। উপহারকে যে যত বেশি আকর্ষণীয় করতে পারে তার ভালোবাসা যেন ততই পূর্ণতা লাভ করে। কেউবা তার প্রেমিকাকে এভাবে বলে, পৃথিবীর সকল উপহারই তোমার কাছে তুচ্ছ। তাই তোমার জন্য আমি নিজেই জীবন্ত উপহারের উপকরণ। যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করতে পার। এমন কথা শুনলে একজন প্রকৃত মানুষের বাকশক্তি না হারিয়ে পারে না। কীভাবে মানুষ অবৈধভাবে এমন কার্যে জড়াতে পারে?
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ একটি টিভি চ্যানেলে প্রিয়জনকে আগলে রাখতে, কিংবা ভালোবাসা দিবসকে স্মরণীয় করতে উপহার হিসেবে তালার মালা নিয়ে একজন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন তালা যেমন কোনো কিছু বন্ধ করার উপকরণ, তেমনি তালার মালা উপহারের মাধ্যমে প্রিয় মানুষটিকে চির বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখবেন। ভালোবাসার বিষয়টি এমনভাবে প্রচার করা হয় যাতে সবাই উৎসাহিত হয়ে নতুন করে কারো না কারো প্রেমে পড়তে বাধ্য হবে। কিন্তু অনুষ্ঠানগুলোতে যদি বৈধ সম্পর্কের কথা বলা হতো, বৈধ ভালোবাসার কথা বলা হতো- তাহলে আজকের সমাজ বেশি উপকৃত হতো।
ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো অধিকাংশ সময় বিশেষ সংবাদ, খবর, প্রতিবেদন বিজ্ঞাপনসহ অবৈধভাবে ভালোবেসে একজন আরেকজনকে বিয়ে করেছেন এমন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ প্রচার ও প্রকাশ করে থাকে। যদিও তারা স্বামী-স্ত্রীকে উপস্থিত করে। কিন্তু তাদের বিবাহের সূত্রপাতটা কীভাবে হয়েছিল তা সম্প্রচারের মাধ্যমে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহিত করে, ফলে তারা সেই সকল অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেরা অবৈধভাবে প্রেম-ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে মোবাইল কোম্পানিগুলো সবচেয়ে কম রেটে কথা বলাসহ নানা অফার ঘোষণা করে। ফুলের দাম আর কখনো বৃদ্ধি না পেলেও ফুল ব্যবসায়ীরা যেন ভালোবাসা দিবসে চড়া মূল্যই পেয়ে থাকেন।
ভাষার মাস যেন ভালোবাসার মাসে পরিণত হয়ে যায়। বৈধ কি অবৈধ, ন্যায় কি অন্যায়, কল্যাণ কি অকল্যাণ এ যেন বিবেচনার সুযোগ নেই। ভালোবাসা বললেই যেন বৈধ কথাটা হারিয়ে যায়, কিন্তু কেন? ইসলাম ভালোবাসার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে কিন্তু অবৈধ ভালোবাসাকে কখনো অনুমোদন করেনি। ইসলামে ভালোবাসার রূপরেখার মধ্যে পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন পদ্ধতি। ইসলামী শরীয়তের যথাযথ অনুসরণ, হালাল-হারামের সীমারেখা, শালীন পোশাক-পরিচ্ছেদ, আত্মিক ও দৈহিক সৌন্দর্যবোধ, সুস্থ বিনোদনমূলক কর্মকা- পরিচালিত বিষয়াবলী। (বাংলাদেশের মুসলিম সংস্কৃতি)।
ভালোবাসাই হলো ইসলাম। ভালোবাসাই শান্তি ও সম্মান। হজরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলে খোদা (সা.) বলেছেন, ‘ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেউ পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি এবং সমস্ত মানুষের তুলনায় অধিক প্রিয় না হই।’ (বোখারি ও মুসলিম)। অন্য এক হাদিসে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে আমার আদর্শকে ভালোবাসলো সে আমাকে ভালোবাসলো। আর যে আমাকে ভালোবাসলো সে জান্নাতে আমার সঙ্গে থাকবে।’ (তিরমিজি)।
একজন মানুষের ভালোবাসা শুরুই হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসার মাধ্যমে। সেটাই হবে প্রকৃত ভালোবাসা। পারস্পরিক ভালোবাসা বৃদ্ধির জন্য অধিক পরিমাণে সালামের প্রচলন করা প্রয়োজন। ভালোবাসার দ্বারা এক ব্যক্তি যদি অন্যের প্রতি আসক্ত হয় তাকে বলে বন্ধু। হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘যার বন্ধু নেই সে গরিব।’ হজরত আবুবকর (রা.) বলেন, ‘সর্বাপেক্ষা দুর্বল ব্যক্তি সে, যার কোনো বন্ধু নেই।’ কিন্তু ভালোবাসার বন্ধু কে হবেন সে সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আবু সাইদ (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘ঈমানদার ব্যতীত কাউকেও সাথী বানিও না।’ (তিরমিজি, আবুদাউদ, মিশকাত)। অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। সুতরাং তোমাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য রাখা উচিত সে কাকে বন্ধু করে নিচ্ছে।’ (আহমদ, তিরমিজি, আবুদাউদ)।
কিন্তু আজকের সমাজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে যে মাতামাতি করছে তা বিজাতীয় সংস্কৃতি। অধিকাংশ মুসলমান অজ্ঞতাবশত অন্ধভাবে অনুকরণ করছে। অথচ রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করল সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য।’ ভালোবাসা দিবস পালন করাও এ নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এটি খ্রিস্টানদের উৎসব। যে মুসলমান আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার জন্য এ দিবস পালন মোটেই বৈধ নয়।
ভালোবাসা হতে হবে জান্নাতে যাওয়ার জন্য, তাই সেভাবে কাজ করাই হবে প্রকৃত মুমিনের পরিচয়। অন্যান্য দিবসের মতো বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে আমরা কি উপকৃত হয়েছি? কেউ কেউ হয়তোবা হ্যাঁ জবাবকে বেছে নেবেন। কিন্তু অধিকাংশ লোকই মনে করেন, ভালোবাসা দিবস সমাজকে অশ্লীল ও অন্যায়ের দিকে ধাবিত করছে। নৈতিক অবক্ষয় দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অভিভাবকগণ সঠিকভাবে সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিলে হয়তোবা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হবে না।
ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও গোটা দেশকে ভালোভাবে গড়তে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তা নাহলে ভালোবাসা দিবস পালনের নামে আমাদের সন্তানরা নৈতিক অবক্ষয়ের অতলে হারিয়ে যাবে। সমাজ পতিত হবে বিশৃঙ্খলার অতল গহ্বরে। যার আলামত আমাদের চারপাশে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজকাল ধর্মের কথা শুনলেই অনেকেই নাক সিটকান। কারণ তাদের কাছে ধর্ম মানেই পশ্চাৎপদতা, মৌলবাদিতা; ধর্ম মানেই সেকেলে বিষয়। তাই তারা নিজেদের এক আধুনিক সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন। কিন্তু বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের নামে যে অশ্লীলতার চর্চা চলছে তা বন্ধ না হলে তাদের সেই তথাকথিত সভ্য সমাজটাও পারিবারিক-সামাজিক কলহ এবং অশান্তির আগুনে পুড়ে ছারখার হতে বাধ্য।
অতএব, আসুন- আগে আমরা অভিভাকরা সচেতন হই, সচেতন করি আমাদের সন্তানদের। বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনের নামে আমাদের সন্তানকে নৈতিক অবক্ষয় থেকে বাঁচাই, সতর্ক হই আমাদের পরিবার ও সমাজকে অশ্লীলতা থেকে বাঁচাতে।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, গজমহল ট্যানারি উচ্চ বিদ্যালয়, হাজারীবাগ, ঢাকা ১২০৯।
মন্তব্য চালু নেই