বিশ্ব, অস্তিত্ব, সময়- যা দেখি তাই কি সত্যি?

অনেক ঘটনা দেখতে যতটা সহজ এবং স্বাভাবিক লাগে বাস্তবে তেমন হয় না। এরকম বিভিন্ন বিষয় আছে যা আমরা সত্য বলে ধরে নিই, কিন্তু পরবর্তীতে গবেষণায় দেখা যায়, তা আসলে সত্য নয়। চারপাশের ঘটনাকে বুঝতে আমরা ব্যবহার করি আমাদের সহজাত বুদ্ধি বা কান্ডজ্ঞান। দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীরা তাদের কান্ডজ্ঞান ব্যবহার করে এমন কিছু এমন কয়েকটি তত্ত্ব নিয়ে জানব আমরা।

বিগ ফ্রিজ
মহাবিশ্বের সৃষ্টি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছে বিগ ফ্রিজ। না, এর মানে মোটেও এরকম নয় যে মহাবিশ্ব ধ্বংসের সময় অনিবার্যরূপে বরফে পরিণত হবে অথবা বিশাল বিশাল বরফ টিউব গজিয়ে উঠবে চারপাশে। এর মানে ভিন্ন। মহাবিশ্বে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার শক্তি সঞ্চিত আছে। এই শক্তি এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একসময় এই শক্তির চলাচল থেমে যাবে এবং যতই কমে আসবে মহাবিশ্বের গতিময়তাও ততই ধীর হয়ে আসবে। অন্যভাবে বলা যায়, ধীরে ধীরে মহাবিশ্ব তার উষ্ণতা হারাচ্ছে। কারণ তাপ বা উষ্ণতা আসে শক্তির কণাদের গতিশীলতা থেকে। এই গতিশীলতা কমে যাচ্ছে এবং সেই অনুযায়ী সব কিছুই একসময় থেমে যাবে। এ সময়ে অ্যাবসলিউট জিরোর মাত্র এক ধাপ ওপরে থাকতে পারে বিশ্বের তাপমাত্রা। এ কারণেও একে বিগ ফ্রিজ বলা হয়। এর আরেকটি নাম হলো বিগ ক্রাঞ্চ।

আত্মজ্ঞানবাদ

এটি একটি দার্শনিক তত্ত্ব যেখানে বলা হয়, মানুষের নিজস্ব চিন্তা ছাড়া আর কোন কিছুর অস্তিত্ব নিশ্চিত করার কোন উপায় নেই। অর্থাৎ, চিন্তাই একমাত্র অস্তিত্বশীল। শুনতে বিষয়টি বোকা বোকা লাগে। কারণ আমরা কেওই আমাদের চারপাশের জগতের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু কোন কিছুর অস্তিত্বকে নিশ্চই নিজস্ব চেতনা ছাড়া প্রমাণ করা সম্ভব নয়, তাই না?
বিশ্বাস হচ্ছে না? একটু সময় নিন আর নিজের স্বপ্নগুলোর কথা ভাবুন যেগুলো সত্যি হবে বলে আপনি বিশ্বাস করেন। এমন কি হতে পারে না, আপনার চারপাশে আপনি যা দেখছেন তা আর কিছুই না আপনার অবিশ্বাস্যভাবে সম্প্রসারিত কোন স্বপ্ন? কিন্তু আমাদের বন্ধুরা, পরিবার, প্রিয়জন তো আমাদের সামনেই আছে, স্পর্শ করলেই তাঁর প্রমান পাই আমরা। তাই না? ভুল। অনেক সময় দেখা গেছে, মানুষ তাঁর সবচেয়ে মনোপুত কাল্পনিক স্বত্তাকে (hallucination) স্পর্শ করে বা দেখে, সে জানতেও পারে না তা সত্যি না মিথ্যা। তাহলে কিভাবে প্রমাণিত হল যে পাশের মানুষটি কল্পনা নয়, সত্যি?
আমরা যা খাই, যা স্পর্শ করি, এই যে চোখের সামনে স্মার্ট ফোন, হাতের নিচে কী বোর্ড কোন কিছুর অস্তিত্বই প্রমাণ সম্ভব নয়। আমাদের চিন্তাই একমাত্র তাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে, সত্যি বলে প্রমাণ করে!

আইডিয়ালিজম

দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আইডিয়ালিজম হল, পৃথিবী এবং বাস্তবতার অস্তিত্ব আছে আমাদের সচেতনতার মধ্যে, প্রকৃতির নিয়ম আর বিমূর্ততাই আসলে মৌলিক এবং অস্তিত্বশীল। বস্তু নয়। জর্জ বার্কলে একজন বিখ্যাত আইডিয়ালিস্ট, তিনি খেয়াল করলেন যে, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মূর্খসুলভ। বিষয়টি এরকম যে, আমি একটি পাথরে চোখ বন্ধ করে আন্দাজে লাথি দিলাম এবং দাবি করলাম আমি সেটি ভেঙে ফেলেছি। এখন পাথরটি যদি বাস্তবেই না থাকে তাহলে চোখ বন্ধ করেও কিভাবে আমি বুঝতে পারলাম আর ভাঙতে পারলাম? তিনি বলতে চাইলেন, নিশ্চই একজন ঈশ্বর আছেন যিনি আমরা যা চিন্তা করি তাকে বাস্তবে নিয়ে আসেন। কোন বস্তুই অস্তিত্বশীল নয়। সবকিছুই ৩য় মাত্রার মানসিক ধারণা।


প্লেটো এবং লোগো

প্লেটো কে আমরা সবাই চিনি। বাস্তবতা সম্পর্কিত এই মহান দার্শনিকের বক্তব্যটিও আসুন জেনে নিই। তিনি মনে করতেন, আমাদের চারপাশের এই পৃথিবী আসলে বাস্তব নয়, বরং অন্য একটি পৃথিবীর অনুরূপ। আমরা যা দেখি তা বাস্তব নয়, বাস্তবের ছায়া। তিনি মনে করতেন, সকল বস্তু একটি মাত্র মৌল দ্বারা গঠিত। অর্থাৎ, হীরা হোক বা স্বর্ণ অথবা হোক কোন প্রাণী সবই একই মৌলের অন্যান্য যৌগের সাথে ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণের ফল। আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে প্লেটোর এই ধারণার পার্থক্য কিন্তু খুব বেশি নয়। লোগোর উপর লোগো সাজিয়ে যেমনি তৈরি হয় একটি বাড়ি বা ট্রেন তেমনিই তৈরি হয়েছে যাবতীয় পার্থিব আপাতদৃষ্ট বস্তুরা !

প্রেজেন্টিজম

দর্শনের এই তত্ত্বে বিশ্বাস করা হয় যে, অতীত বা ভবিষ্যত বলে আসলে কিছু নেই। একমাত্র বর্তমানই বাস্তব। সময় একই সাথে পেছনে বা সামনে পবস্থান করতে পারে না। সময় অবস্থান করে শুধু বর্তমানে। অর্থাৎ, গত বছর আপনি যে জন্মদিন পালন করেছেন তার অস্তিত্ব তখনই শেষ হয়ে গেছে। এই আর্টিক্যালটি ততক্ষণই আছে যতক্ষণ আপনি পড়ছেন বা আবার যখন পড়তে নেবেন তখন আবার অস্তিত্বশীল হবে। এছাড়া ভবিষ্যতেও এর অস্তত্ব আসলে থাকবে না। সেন্ট অগাস্টিন বা বৌদ্ধ ধর্ম বিশেষজ্ঞ ফেয়ডর সেইবাটস্কির ভাষ্য মতে, ‘সমস্ত অতীত অসত্য, সমস্ত ভবিষ্যৎ অসত্য, যা আছে চিন্তায়, অনুপস্থিত, মানসিক … অসত্য… শেষ পর্যন্ত সত্য হল শারিরিকভাবে উপলব্ধ বর্তমান।’



মন্তব্য চালু নেই