বিশ্বের অন্যতম অভিশপ্ত রত্ন কোহিনুরের সেই রহস্য আজও অমীমাংসিত…

ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া কোহিনুরকে তাঁর মুকুটে ধারণ করতে শুরু করেন। এবং আশ্চর্য, সেই সময় থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বৈভবও বাড়তে শুরু করে। মনে রাখতে হবে, সেই অভিশাপ কিন্তু ‘নারী’-কে কোহিনুরের কুপ্রভাবের আওতার বাইরে রেখেছিল।

ভারতের ‘গর্ব’ কোহিনুর হিরে নিয়ে ইতিহাস ও কিংবদন্তি হাতে হাত ধরে চলে। একদিকে বার বার হস্তান্তরিত হওয়া এই রত্নের আশ্চর্য ইতিবৃত্ত, অন্যদিকে সেই হস্তান্তরের কাহিনির সঙ্গে যুক্ত এক অভিশাপের পুনরাবৃত্তি এই রত্নকে তার প্রকৃত মূল্যের চাইতেও দামি করে রেখেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটে তার শোভা পাওয়া, অথবা মাঝে মাঝেই তাকে ভারতে ফিরিয়ে আনার দাবিকে ম্লান করে দেয় এই রত্নের অভিশাপের কাহিনি।

ভারতের গোলকুণ্ডা অঞ্চলের এক খনি থেকে প্রাপ্ত এই হিরের ওজন ১০৮.৯৩ ক্যারাট। কাকোতীয় রাজবংশের আমলে এই হিরে উত্তোলিত হয়। তার পর থেকে কোহিনুর এক রাজবংশ থেকে আর এক রাজবংশে ক্রমাগত হস্তান্তরিত হয়েছে। কোনও বংশ অথবা কোনও মালিকানাই একে স্থিতু করতে পারেনি। এই অস্থিরতার পিছনে নাকি ক্রিয়াশীল রয়েছে এক মারাত্মক অভিশাপ। ১৩০৬ খ্রিস্টাব্দের এক হিন্দু গ্রন্থে উল্লিখিত রয়েছে, এই হিরে যাঁর হস্তগত হবে, তিনি পৃথিবী শাসন করবেন। কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁকে তাড়া করে বেড়াবে চূড়ান্ত দুর্ভাগ্য। একমাত্র ভগবান ও কোনও নারী যদি এই রত্ন ধারণ করেন, তিনি এই অভিশাপ থেকে রেহাই পাবেন।

সেই কাল থেকে কোহিনুরের ইতিহাস রণ-রক্ত-সফলতা-নিষ্ফলতার এক জটিল বুনোট। মহারাণি ভিক্টোরিয়ার অধিকারে যাওয়ার আগে ক্রমাগত হত্যা-ষড়যন্ত্র-সিংহাসনচ্যুতি লিপ্ত হয়ে রয়েছে এর অনুষঙ্গে। এই অবকাশে একটু চোখ বোলানো যেতে পারে কোহিনুরের যাত্রাপথে। ১২০০-১৩০০ সাল পর্যন্ত এই হিরে হাত ঘুরেছে ইলবারি তুর্কিদের, খলজিদের, সৈয়দ এবং লোদিদের। লক্ষ করার বিষয়, প্রত্যেক বংশই মারাত্মক হিংসার মাধ্যমে উৎখাত হয়েছে। ১৩০৬ সালে মালবের রাজা এটি হস্তগত করেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এটি চলে যায় মহম্মদ বিন তুঘলকের হাতে। দিল্লি সুলতানির বিভিন্ন হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত এটি পৌঁছয় মুঘলদের জিম্মায়। গোটা সুলতানি পর্ব জুড়ে লেগে ছিল নিরন্তর যুদ্ধ, গুপ্তঘাত, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি।

১৫২৬-এ কোহিনুর এসে পৌঁছয় মুঘল সম্রাট বাবরের হাতে। মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসেও গোড়া থেকেই রক্তপাত নৈমিত্তিক হয়ে রয়েছে। সম্রাট শাহজাহান তাঁর বিখ্যাত ‘ময়ূর সিংহাসন’-এর শোভাবর্ধনে কোহিনুরকে ব্যবহার করেন। শাহজাহানের শেষজীবন কতটা দুর্বিষহ ছিল, তা কারোর অজানা নয়। তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে মুঘল রাজপরিবারে শুরু হয় ভ্রাতৃঘাত। শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব সব বাধা উৎপাটন করে সিংহাসনে বসেন। ১৭৩৯ সালে মুঘল সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত করেন পারসিক সম্রাট নাদির শাহ। তিনি কোহিনুর লুঠ করে দেশে নিয়ে যান। কিন্তু ১৭৪৭-এর মধ্যেই নাদির শাহের সাম্রাজ্যও ভেঙে পড়ে। নাদির শাহও নিহত হন। ১৮০০ সালে কোহিনুর আশ্চর্যভাবে ভারতে ফিরে আসে। পঞ্জাবের মহারাজা রঞ্জিৎ সিংহ এর অধিকারী হন। কিন্ত তাঁর রাজ্যও অল্প সময়ের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। কোহিনুর গিয়ে পড়ে ব্রিটিশদের হাতে। যে জাহাজে কোহিনুর ভারত থেকে ইংল্যান্ড পাড়ি দিয়েছিল, সেই জাহাজটিও বিপদে পড়ে। ‘এইচএমএস মেদেয়া’ নামের সেই জাহাজে কলেরা দেখা দেয়।

ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়া কোহিনুরকে তাঁর মুকুটে ধারণ করতে শুরু করেন। এবং আশ্চর্য, সেই সময় থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বৈভবও বাড়তে শুরু করে। মনে রাখতে হবে, সেই অভিশাপ কিন্তু ‘নারী’-কে কোহিনুরের কুপ্রভাবের আওতার বাইরে রেখেছিল। ব্রিটিশ শাসকরা এই অভিশাপের কথা জানতেন, তাই তাঁরা কোহিনুরকে ‘স্ত্রীধন’ হিসেবেই রেখে দেন। কোনও রাজপুরুষ একে ধারণ করতে চাননি।

তুল্যমূল্য বিচারে কোহিনুর নাকি অশুভের থেকে শুভ প্রভাবই দিয়েছ— একথা অনেকে বলে থাকেন। তা হতেও পারে। কোহিনুর-মালিকদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছিলেন, একথা অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই। কিন্তু সেই সঙ্গে একথাও মনে রাখতে হবে, সেই সাফল্য নেহাতই রক্তপাতহীন ছিল না। অভিশাপ, কি অভিশাপ নয়, সেই প্রসঙ্গে তর্ক বহমান থাকবে নিরবধিকাল। কোহিনুর থেকে যাবে তার কার্বন-কাঠিন্যের গাম্ভীর্যে নিরুত্তর।



মন্তব্য চালু নেই