বিলুপ্তির পথে গরিবের ‘এসি’ মাটির ঘর
ঝিনাইদহ জেলায় হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর। বিলুপ্ত এমাটির ঘর এখন আর তেমন দেখা যায়না। মাটির দেয়াল, ওপরে টিন বা খড়ের চাল। সামনে বড় উঠোন। ঘরের পেছনের দিকে ছোট্ট একটি পুকুর। চারপাশে গাছ-গাছালিতে ভরপুর। এক সময় এমন মনোরম দৃশ্য চোখে পড়তো ঝিনাইদহ এলাকার প্রতিটি গ্রামাঞ্চলে।
কিন্তু এখন আর আগের মতো চোখে পড়ে না মাটির ঘর, হারিয়ে গেছে চিরচেনা সেই মনোরম দৃশ্য। ঐতিহ্যের এই স্থাপনাটি এখন স্থান পেয়েছে হারিয়ে যাওয়ার খাতার পাতায়।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ঝিনাইদহের প্রতিটি উপজেলার গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতে একটি করে হলেও মাটির ঘর চোখে পড়তো। প্রায় প্রতিটি গ্রামেরই ছোট সুন্দর মাটির ঘরগুলো ও ঘরের পরিবেশ সবার নজর কাড়তো। ছোট ছোট মাটির ঘরগুলোর কারণে প্রতিটি গ্রামকে স্বর্গরাজ্য মনে হতো। ঝড়, বৃষ্টি থেকে বাঁচার পাশাপাশি তীব্র গরম ও শীত থেকে বাঁচতেও এই ঘরের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু কালের বিবর্তনে দালানকোঠা আর অট্টালিকার কাছে হার মানতে হয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী চিরচেনা মাটির ঘর।
বর্তমান প্রজন্মের ধনী কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যরা পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য বহনকারী মাটির ঘর ভেঙে লোহা, সিমেন্টের বিলাসবহুল বাড়ি বানানোর দিকে ক্রমাগত ঝুঁকেই চলেছেন। ততোটা সামর্থ্য না থাকলে নিদেনপক্ষে টিনের বেড়া আর টিনের চালা দিয়েও বানানো হচ্ছে ঝকঝকে সুন্দর ঘরবাড়ি। আর তাতেই নাকি তাদের সম্মান আর শান্তির বসবাস!
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মাটির ঘরে বসবাস করে আসছে। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিল। এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হতো। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় অথবা টিনের ছাউনি দেয়া হতো। মাটির ঘর শুধু একতলাই নয়, অনেক সময় দোতলা পর্যন্ত করা হতো। এসব মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের সময় লাগতো দেড় থেকে দু’মাস। সৌখিন গৃহিণীরা মাটির দেয়ালে খাটুনি দিয়ে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে তাদের নিজ বসত ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন।
মাটির তৈরি এসব ঘর এখন আর চোখে না পড়লেও এটা মানতে হবে যে, এই ঘরগুলো শীত বা গরমে থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক। মাটির ঘরে শীতের দিনে ঘর থাকে উষ্ণ আর গরমের দিনে শীতল। তাই মাটির ঘরকে গরিবের এসিও বলা হয়ে থাকে। তবে এখন আর তেমন চোখে পড়ে না গ্রামীণ এই ঐতিহ্য। কারিগররাও এখন এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঝিনাইদহ জেলার গোবিন্দপুর ও আসাননগর গ্রামের মাটির ঘর কারিগর সাব্দার হোসেন ও মুঙলার সাথে।
সাব্দার হোসেন ও মুঙলার বাপ-দাদাও এই পেশায় জড়িত ছিলেন। ওনার বাবা ছিলেন তার দাদার সহযোগী। কয়েকবছর সহযোগী হিসেবে থাকার পর তার বাবাও এক সময় হয়ে যান মাটির ঘরের পাক্কা কারিগর। তখন মাটির ঘরের প্রচুর চাহিদা ছিল। বছরে ১০-১২ ঘরের কাজ পেতেন। তখন তাদের সংসার চলতো ভালোভাবেই।
বাবার সাথে কাজ করতে তিনি একদিন মাটির ঘরের কারিগর হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেন। কিন্তু এখন আর আগের মতো মাটির ঘরের চাহিদা না থাকায় তিনিও দূরে সরে গেছেন এই পেশা থেকে। কত বছর হচ্ছে আপনি এই পেশা ছেড়েছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, ‘গত ৮ বছর ধরে এই কাজ করি না। এই কাজ চালু রাখলে তো পেটে ভাত মিলবে না। তাই এই পেশা ছেড়ে এখন কৃষি কাজ করি।’
আপনি কি এখনো মাটির ঘরে বসবাস করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সাব্দার হোসেন ও মুঙলার বলেন, ‘মাটির ঘর আছে। তবে ওটাতে থাকা হয় না। নতুন টিনের ঘর করছি, এখন ওটাতে থাকা হয়। তবে মাটির ঘরে থাকার আরাম আর কোনো ঘরেই পাওয়া যাবে না।
ঝিনাইদহের সিমান্ত বদরগঞ্জ বাজার (দশ মাইল) জীবনা গ্রামের আব্দুল জলিল বিশ্বাস দির্ঘদিন ধরে মাটির ঘর তৈরির কাজে ব্যাস্ত থাকতো। কিন্তু এখন আর মাটির ঘরের প্রতি মানুষের কোন চাহিদা না থাকায় মাটির ঘর আর তৈরি করতে দেখা যায় না। তিনি আরো বলেন, জীবনা গ্রাম এখন ছোট কুয়েত হয়ে গেছে (প্রতিটা বাড়ি থেকে ২/৩জন কুয়েত প্রবাসী)। এই গ্রামে এখন ইট-বালুর ঘর তৈরীর মহড়া চলছে। তাছাড়াও এই গ্রামের সদ্য বিবাহীত নববধূরা এখন আর মাটির ঘরে থাকতে চায়না। বিয়ের পরপরই তারা স্বামীর কাছে বায়না ধরে ইমারত গড়ে দেয়ার জন্য। এ কারণেই এ এলাকা থেকে হারিয়ে গিয়েছে ঐতিহ্যবাহী মাটির ঘর।
এখনো মাটির ঘরে বসবাস করেন ঝিনাইদহ সদরের গোপিনাথপুর গ্রামের সাগর কর্মকার। কথা হলো তার সাথে। তিনি এখন যে ঘরে থাকেন সেটা তার বাবার হাতে বানানো। বাবার হাতে বানানো হলেও এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার সংস্কার করেছেন তিনি। এখনকার মাটির ঘরের অবস্থা সম্পর্কে তিনি জানান, তাদের পুরো গ্রাম খুঁজলে দু-তিনটির বেশি মাটির ঘর পাওয়া যাবে না।
এখনকার দিনে মানুষ মাটির ঘরে থাকতে চায় না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলে সবাই। কিন্তু খুবই অল্পসংখ্যক মানুষ আছে যারা অর্থের অভাব কিংবা বাপ-দাদার স্মৃতি ধরে রাখতে এখনো বসবাস করেন মাটির ঘরে। আপনি কোন কারণে মাটির ঘরে বসবাস করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাবার দেওয়া ঘর, তাই এখনো রেখেছি। কিছু টাকা-পয়সা জমাতে পারলেই টিনে ঘর দিয়ে দেবো। মাটির ঘরে থাকতে আরাম হলেও সংস্কারের জন্য কারিগর খুঁজে পাই না।’
মাটির ঘর থেকে ইট-পাথরের ঘর বানিয়েছেন ঝিনাইদহ সদরের গোপিনাথপুর গ্রামের দিপক কর্মকার। গত ২ বছর আগেও মাটির ঘর ছিল তার। তার সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, মাটির ঘর কি কারণে ভেঙে ফেললেন? তিনি বলেন, ‘মাটির ঘর থাকলে মানুষ এখন গরিব মনে করে।’ তিনি জানান, মাটির ঘরের চাইতে তিনি এখন অনেক সুবিধা ভোগ করছেন। মাটির ঘরের মতো বিল্ডিং ঘরকে বারবার মেরামত করতে হয় না।
আধুনিকতার খাতিরে বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবনযাপনের চিত্র। বদলে যাচ্ছে থাকার জায়গা, পোশাক-আশাক, যোগাযোগ ব্যবস্থা। বদলে যাচ্ছে সাব্দার হোসেন ও মুঙলার মতো শতশত মানুষের কর্মব্যস্ততা। ঠিক তেমনি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে ঝিনাইদহ থেকে ঐতিহ্যবাহী সব মাটির ঘর।
মন্তব্য চালু নেই