বিভিন্ন দলিলে গোয়েন্দা ব্যর্থতার চিত্র
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তর পিলখানায় যে নৃশংস ও বর্বর ঘটনা ঘটেছিল আদালতের ভাষায় তা ছিল ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতার এক বিশেষ নজির’। ওই ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন প্রাণ হারান যাদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ।খবর চ্যানেল আই’র।
হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এ ঘটনার জন্য প্রধানত গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাকে দায়ী করেন। আদালতের পর্যবেক্ষণেও গোয়েন্দা ব্যর্থতার চিত্র উঠে এসেছে।
প্রায় চার বছর পর এ ঘটনার বিচারে গঠিত বেসামরিক বিশেষ আদালতের রায়ে মোট ১৫২ জনকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ২৭৭ জনের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস দেওয়া হয় তাদের। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আখতারুজ্জামান ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর রায় দিয়েছিলেন।
পিলখানা ট্র্যাজেডির ঘটনা তদন্তে তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব আনিস-উজ্-জামান খানের নেতৃত্বে গঠিত সরকারি কমিটির প্রতিবেদনে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পেশাগত অদক্ষতা ও সাংগঠনিক ব্যর্থতাকে বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটনে অন্যতম সহায়ক কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা রাইফেলস্ সিকিউরিটি ইউনিটের (আরএসইউ) বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল বলেও মন্তব্য করা হয় প্রতিবেদনে।
এ প্রতিবেদনে সরাসরি বলা হয়, ‘বর্ণিত অবস্থাগুলো জাতীয় দুর্যোগকালে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অদক্ষতা, অপেশাদারি ও অমার্জনীয় ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরেছে।’
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাগুলোর দিকে সুনির্দিষ্টভাবে ইঙ্গিত করে আনিস উজ জামানের ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘ঘটনার শুরু থেকে বিভিন্ন বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্যের কোনো বিকল্প নেই। আলোচ্য ক্ষেত্রে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও বিডিআরের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটগুলোর ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নীতিনির্ধারণী অথবা কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসার ক্ষেত্রে এবং সর্বোপরি, সরকার প্রধানের সঙ্গে বিদ্রোহী দলের নেতাদের বৈঠকের আগে আলোচনায় সহায়ক তথ্য কি সরবরাহ করা হয়েছিল? বিদ্রোহের পরপরই কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেছিল কি না, যাদের জিম্মি করা হয়েছে, তাদের কোথায় ও কী অবস্থায় রাখা হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে সংগৃহীত তথ্য সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সংস্থার সরকারপ্রধানের কাছে অবশ্যই উপস্থাপনীয় ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি বা এ ধরনের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
এ ট্র্যাজেডির কারণ হিসেবে গোয়েন্দা ব্যর্থতার কথা বলেছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনও। তিনি সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনে ঢেলে সাজানোর কথাও বলেছিলেন।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না রাখতে পারা গোয়েন্দা ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন পিলখানা ট্র্যাজেডি নিয়ে ‘আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক একটি নিবন্ধে বলেন: বিভিন্ন বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভেতরে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে সমন্বয় করার জন্য একটি শীর্ষ সংগঠনের। আরও প্রয়োজন পেশাদারিত্ব বাড়ানোর। জাতীয় নিরাপত্তার অন্যতম অঙ্গ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না রাখতে পারায় গোয়েন্দা ব্যর্থতার মুখোমুখি অতীতেও হতে হয়েছে, হয়তো ভবিষ্যতেও হতে হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অবশ্যই রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।’
২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি বাংলাদেশ রাইফেল থেকে ৮ম বারের মতো নাম পরিবর্তন করে দাপ্তরিকভাবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) করা হয় আধাসামরিক এ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর নাম।বদলে ফেলা হয় পোষাকও (ইউনিফর্ম)। প্রায় সোয়া দুই শ’ বছরের এ বাহিনীতে পিলখানা ট্র্যাজেডির মতো এত বড় বিদ্রোহ আগে কখনও সংঘটিত হয়নি। যে বিদ্রোহের নৃশংসতা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় ভুক্তভোগী পরিবারসহ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে।
মন্তব্য চালু নেই