বিবিআইএন : অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির নতুন দিগন্ত
দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সড়ক নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে চলতি বছর একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর আওতায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে সড়কপথে পণ্য ও যাত্রীবাহী মোটরযানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত যানবাহন নিয়েও চলাচল করা যাবে। এর নামকরণ করা হয়েছে বিবিআইএন।
এ লক্ষ্যে গত ৮ জুন বিবিআইএন এমভিএর (মোটর ভেহিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট) খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা।
এরপর ১৫ জুন ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে চার দেশের সড়ক পরিবহনমন্ত্রীদের সম্মেলনে ‘বিবিআইএন মোটর ভেহিক্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট (এমভিএ)’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই অ্যাগ্রিমেন্ট বা চুক্তি চারটি দেশের যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যুগোপযোগী পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। চুক্তির এ প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়িত হলে এসব দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক তথা দেশের বাণিজ্যিক অবস্থার আরো উন্নতি হবে।
প্রস্তাবিত চুক্তি থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। এ জন্য চুক্তিটি বাংলাদেশ এবং উল্লিখিত চারটি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
চুক্তিটির আওতায় কোনো বাধা ছাড়াই এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্যবাহী গাড়ি (ট্রাক, টেইলার), যাত্রীবাহী বাস বা ব্যক্তিগত মোটরযান প্রবেশ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি গাড়ির জন্য পৃথক ট্রানজিট ফি দিতে হবে। পাশাপাশি পণ্যবাহী গাড়ির জন্য পৃথক কর ও শুল্ক দিতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি পণ্যবাহী গাড়ির ট্রানজিটের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আর্থিক গ্যারান্টিও দিতে হবে।
চুক্তিতে আরো বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশে গাড়ি প্রবেশের ক্ষেত্রে নিজ নিজ কাস্টমস নীতিমালা অনুসরণ করা হবে। এসব শর্ত রেখেই বিবিআইএন এমভিএর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়।
এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে মালামাল ও যাত্রী পরিবহনে খরচ কমবে। পণ্য খালাসে সময় কম লাগবে। এতে সীমান্ত বাণিজ্য আরো কার্যকর হবে। সীমান্ত বাণিজ্য ও পরিবহন সুবিধা আরো কার্যকর করতে, চারটি দেশকে অর্থনৈতিক করিডরে যুক্ত করবে। এসব দেশের পরিবহনসচিবদের বৈঠকে এরই মধ্যে উপ-আঞ্চলিক সমঝোতামূলক আলোচনা হয়েছে।
এ ছাড়া দুর্ঘটনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে গাড়ির আঞ্চলিক বিমার বাধ্যতামূলক শর্ত রাখা হয়েছে।
বিবিআইএন মোটর ভেহিক্যাল চুক্তি নামে এই চুক্তির খসড়ায় আরো সার্কভুক্ত দেশ এই ফ্রেমওয়ার্কে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
গত বছর নভেম্বরে সার্ক সম্মেলনে আট দেশের মধ্যে সইয়ের জন্য সার্ক এমভিএ উত্থাপন করা হয়। তবে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার প্রস্তুতির অভাবে তা অনুমোদন হয়নি। চুক্তির ভিত্তিতে বিবিআইএম এমভিএর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ জন্য গত ২ থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের কলকাতায় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মোটরযান চলাচলে অন্য দেশকে সুযোগ দিতে চার দেশ একমত হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ এপ্রিল ভারতের চেন্নাইয়ে দ্বিতীয় দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভুটান ছাড়াও মালদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কায় পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের বিধানও রাখা হয়েছে।
চার দেশের মধ্যকার এই চুক্তি (এমভিএ) অনুযায়ী জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে যাত্রী, কার্গোসহ সব ধরনের যান চলাচল শুরু হবে।
এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে নির্ধারিত চার্জ পরিশোধ সাপেক্ষে বন্দরে পণ্য খালাস বা লোডের অনুমতি দিতে হবে। নিয়মিত যাত্রী ও অনিয়মিত যাত্রীদের জন্য পৃথক ছাড়পত্র অনুমোদন করবে সদস্যদেশগুলো। এ জন্য চুক্তির সঙ্গে ফরমের ছকও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে বলে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
এ ছাড়া বিবিআইএন মোটরযান চুক্তির আওতায় বাংলাদেশে গাড়ি প্রবেশ ও প্রস্থানের সম্ভাব্য রুটগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে।
প্রথম রুটটি হলো কলকাতা থেকে পেট্রাপোল, বেনাপোল, ঢাকা হয়ে আখাউড়া দিয়ে আগরতলা।
দ্বিতীয় রুট হিসেবে রয়েছে আগরতলা, আখাউড়া হয়ে চট্টগ্রাম বন্দর। তৃতীয় রুটটি ভারতের শিলচর থেকে সিলেটের সুতারকান্দি, পাটুরিয়া ফেরি পার হয়ে বেনাপোল দিয়ে কলকাতা। রুটগুলোতে ভারত-বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত হবে।
ভুটান-ভারত-বাংলাদেশ রুটে হবে দুটি। প্রথমটি ভুটানের সামদ্রুপ জংখার থেকে ভারতের গোয়াহাটি, শিলং, সিলেটের তামাবিল হয়ে চট্টগ্রাম এবং দ্বিতীয়টি থিম্পু থেকে ফুয়েন্টশোলিং, ভারতের জাইগাও হয়ে বুড়িমারি স্থলবন্দর দিয়ে চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর যাবে।
কাঠমান্ডু থেকে কাকরভিটা হয়ে ফুলবাড়ী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মংলা বন্দর পথে অথবা বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে চট্টগ্রাম যাবে।
চারটি দেশের মধ্যে মোটরযান চলাচল চুক্তির আওতায় ৩ নভেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবারের মতো কলকাতার পণ্য কাভার্ড ভ্যানে করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে (ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর) ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পৌঁছায়। ভ্যানটিতে ভারতের মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ভোডাফোনের ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম ছিল।
এর আগে, ১ জুন কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা সড়কপথে যাত্রীবাহী বাস চলাচল শুরু হয়।
এ ছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে যাত্রী পরিবহনের সঙ্গে সঙ্গে গত ১৪ নভেম্বর থেকে কার্গো ভেহিক্যালস ট্রায়াল রান অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতের ওডিশা প্রদেশের ভুবনেশ্বর থেকে শুরু হয়ে বিহারের রাঁচি, পাটনা, নেপালের কাঠমান্ডু, বিরাটনগর, ভুটানের ফুয়েন্টসোলিং, থিম্পু, ভুমথাং, মঙ্গার, ভারতের আসামের গোয়াহাটি, শিলচর, ত্রিপুরার আগরতলা পর্যন্ত ফ্রেন্ডশিপ মোটরর্যালি হয়। ২৮ নভেম্বর ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্ত হয়ে র্যালিটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ৩০ নভেম্বর ঢাকায় একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। আজ মঙ্গলবার সকালে ঢাকা থেকে যশোর হয়ে ভারতের কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে র্যালিটি। ২ ডিসেম্বর বেনাপোল সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় গিয়ে এই র্যালি শেষ হবে।
মন্তব্য চালু নেই