বিদ্যুৎ সঞ্চালনেও এবার বেসরকারি কোম্পানি
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি অংশগ্রহণ থাকলেও সঞ্চালন বিতরণ পুরোটাই সরকারি কোম্পানির নিয়ন্ত্রণাধীন। এবার সঞ্চালন কার্যক্রমও বেসরকারি খাতে ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রাথমিকভাবে এজন্য তিনটি স্থানও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে। বেশ কিছু বেসরকারি কোম্পানিও ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ সঞ্চালনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, ‘উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঞ্চালন ব্যবস্থায় সরকার মুনাফা করছে। এ মুনাফায় ভাগ বসাতেই ব্যবসায়ীদের ডেকে আনা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সম্প্রতি বলেছেন, ‘দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চালন এবং বিতরণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা চিন্তা করছি।’ ভারতের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে সঞ্চালন ব্যবস্থায় বেসরকারি কোম্পানি কাজ করছে। আমরাও এ নিয়ে আলাপ আলোচনা করছি। সঞ্চালনের কিছু অংশ বেসরকারি কোম্পানির কাছে দেয়া হতে পারে।’
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বলেন, ‘দেশের বর্তমান চাহিদায় সঞ্চালন ব্যবস্থা ভালোই বলতে হবে। কিছুটা ঘাটতি আছে সেটা সরকারেরই দুর্বলতা। কারণ এ খাতে অর্থ সুযোগ সব রয়েছে, এরপরও কেনো উন্নয়ন হবে না?’ প্রশ্ন রাখেন তিনি।
সঞ্চালনে সরকারি কোম্পানি মুনাফা করছে জানিয়ে শামসুল আলম বলেন, ‘এ মুনাফার লোভেই একটি দুর্নীতিবাজ চক্র সঞ্চালন ব্যবস্থাকে বেসরকারি খাতে নেয়ার ষড়যন্ত্র করছে।’
পিজিসিবি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪১.৬৫ কোটি টাকা কর পরবর্তী মুনাফা করেছে। এবছর (২০১৫-১৬) মুনাফা আরো বাড়বে। কারণ গত বছরের অক্টোবর থেকে সঞ্চালন মাশুল (হুইলিং চার্জ) ৫ পয়সা বেড়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ‘পিজিসিবি সঞ্চালন ব্যবস্থার সঠিক উন্নয়ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির শত কোটি টাকা ফেরত যাচ্ছে। তাই এ খাতে সংস্কার আনতে চায় সরকার।’
সূত্র জানিয়েছে, এ সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গত বছরই পিজিসিবি ভেঙ্গে ‘ইন্ডিপেনডেন্ট ট্রান্সমিশন কোম্পানি’ নামে একটি পৃথক সঞ্চালন কোম্পানি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রণালয়। পিজিসিবির কর্মীদের বিরোধিতায় ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পিজিসিবি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জানায়, পৃথক কোম্পানি গঠন করলে সঞ্চালন ব্যবস্থায় অরাজকাতার সৃষ্টি হবে। এরপর মন্ত্রণালয় সঞ্চালনের কিছু অংশ বেসরকারি কোম্পানির কাছে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য পিজিসিবিকে ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
পিজিসিবি ইতোমধ্যে প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুম আল বেরুনী।
প্রতিবেদনে পিজিসিবি বেসরকারি উদ্যোগে সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রাথমিকভাবে তিনটি স্থানকে চিহ্নিত করেছে। এগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে বিশেষায়িত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের লাইন, পটুয়াখালী থেকে বরিশালের ভাণ্ডারিয়া এবং মাদারীপুর থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সঞ্চালন লাইন।
এদিকে কনফিডেন্স গ্রুপ ৬০ থেকে ৮০ কিলোমিটারের একটি সঞ্চালন নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা ৪০০ কিলোভোল্টের ডাবল সার্কিট লাইন নির্মাণ করবে; যা দ্বারা ৫৪০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। কোম্পনিটি নিজেরাই এ লাইন নির্মাণ ও পরিচালনা (বিওও) করতে চায়। প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) বিদ্যুৎ সঞ্চালনে পিজিসিবির কাছে ১৮ পয়সা চার্জ দাবি করেছে কনফিডেন্স। এর মধ্যে ৯ পয়সা ক্যাপাসিটি চার্জ আর ৯ পয়সা হুলিংই চার্জ। সরকার চাইলে তারা পিজিসিবির পছন্দ মতো যেকেনো এলাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের মেয়াদ হবে ২২ বছর। কনফিডেন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান করিম স্বাক্ষরিত আবেদনটি গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে।
আগে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ পুরো বিষয়টির দেখভাল করতো বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। নব্বইয়ের দশকে দাতা গোষ্ঠীর পরামর্শে বিতরণ ও সঞ্চালনের জন্য পৃথক পৃথক কোম্পানি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১০ বিলিয়ন টাকা অনুমোদিত মূলধন নিয়ে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে গঠিত হয় পিজিসিবি। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুসারে পিডিবি ও তৎকালীন ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই অথরিটি (ডেসা, বর্তমানে ডিপিডিসি নামে পরিচিত) এর সঞ্চালন অংশ পিজিসিবিকে হস্তান্তর করে। ২০০২ সালের ডিসেম্বর থেকে পিজিসিবি পূর্ণাঙ্গভাবে কাজ শুরু করে। পিজিসিবি’র ৭৫ ভাগ শেয়ারের মালিক পিডিবি। ফলে এ কোম্পানির লাভের অংশ পিডিবিও পায়।
বর্তমানে দেশে সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ৯ হাজার ৬৯৫ কিলোমিটার। যার পুরোটাই পিজিসিবির অধীন।
উৎপাদন খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ১৯৯৬ সালে প্রণীত হয় ‘বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতিমালা’। এর অধীনে প্রথম খুলনার খালিশপুরে ১১০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র স্থাপন করে দেশীয় সামিট এবং ইউনাইটেড গ্রুপ। কেন্দ্রটি ১৯৯৮ সালের ১২ অক্টোবর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। এরপর বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। ২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৭৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি হয়েছে, যার মধ্যে ৪২টিই বেসরকারি কেন্দ্র। বর্তমানে উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় অর্ধেক সরবরাহ করে বেসরকারি কোম্পানিগুলো।
বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট হলেও এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ৮ হাজার ১৭৭ মেগাওয়াট। বাংলামেইল
মন্তব্য চালু নেই