‘বাবুল-মিতুর ১৪ বছরের সংসারে অশান্তি হয়নি’

রাজধানীর বনশ্রীর মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ার একটি গলি দিয়ে সোজা হেঁটে গেলেই এসপি বাবুল আক্তারের প্রয়াত স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর বাবার বাড়ি। ছোট্ট দোতলা একটি বাড়ি। স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর দুই সন্তানকে নিয়ে বাবুল আক্তার এখানেই থাকছেন।

বাড়ির মধ্যে অনেক লোক, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। থমথমে অবস্থা। বাড়ির দরজা খোলা। ভেতরে ঢোকার পর কেউ নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন না। মাহমুদার মা শাহিদা মোশাররফ এসে বসতে বললেন। জানতে চাইলাম, ‘বাবুল আক্তার কি আছেন? দেখা করতে চাই।’ জবাবে তিনি বললেন, বাবুল কারও সঙ্গে দেখা করেন না, কথা বলেন না।

কাঁদতে কাঁদতে মাহমুদার মা বললেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় কষ্ট—আমার মেয়েটা চলে গেল। এরপর তোরা আমার জামাইকে (এসপি বাবুল আক্তার) প্যাঁচাইলি কেন? বাবুল একটা ফেরেশতা। ওরা আমার মেয়ে জামাইরে নিয়ে আজেবাজে কথা বলছে। আমার ছেলে নেই, ওকে আমরা ছেলের মতো দেখি।’

বাবুলের বিরুদ্ধে পুলিশ ও গণমাধ্যমের বিভিন্ন অভিযোগ বিষয়ে শাশুড়ি শাহিদা মোশাররফ বলেন, ‘যে যা-ই বলুক, আমরা বলি না। আমাদের বাসার কেউ টিভিও দেখে না, পত্রিকাও পড়ি না। শুধু আল্লাহর কাছে বিচার দিই। পরিবারের কারও বাবুলের প্রতি সন্দেহ নাই। ও ফেরেশতা। আমি বুঝি না মানুষ একটা কথা কেন বোঝে না। আশ্চর্য! কেন একজন তার বউরে মেরে ফেলবে? বউ অন্যায় করলেও সন্তানদের জন্য হলেও তো বাঁচায় রাখবে।’ মাহমুদার মা জোর দিয়ে বলেন, ‘মেয়ে-মেয়ে জামাইয়ের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাদের কষ্ট লাগে। কী সব আজেবাজে কথা বলছে লোকজন! আমার মাথায় কাজ করে না।’

দোষী না হলে গভীর রাতে পুলিশ কেন বাবুল আক্তারকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে (ডিবি) নিল? জানতে চাইলে শাহিদা মোশাররফ বলেন, ‘ওরে পুলিশে নিতে আসছে। ও পুলিশে চাকরি করছে। আইজি সাহেব ডাকছেন, তাই গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি আর কারও কাছে বিচার চাই না। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই। আমার মেয়ে খুব সরল-সহজ ছিল। ১৪ বছর বিয়ে দিয়েছি, কোনো দিন অশান্তি হয়নি। মেয়ে সারাক্ষণ আমার খোঁজখবর নিত। সারাক্ষণ বলত, তোমার কিছু হলে আমি তো বাঁচব না। এখন আমি কী নিয়ে বাঁচব? ওর সন্তানেরা কী নিয়ে বাঁচবে?’

শাহিদা মোশাররফ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘বিশ্বাস করি না বাবুল আমার মেয়েকে খুন করেছে বা নির্দেশ দিয়েছে। ওর বয়স যখন ১১ বছর, তখন থেকে তাকে চিনি। সে সময় আমার মেয়ের বয়স ছিল দুই বছর।’ চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘ডিসেম্বরে মেয়ের সঙ্গে শেষ দেখা। বাবুলের পোস্টিং ঢাকায় হওয়ার পর মেয়ে ফোন করে বলল, ও এক মাস ঢাকায় থাকবে; তোমাদের বাসায় রেখো।’

কারা মারল মাহমুদাকে? জানতে চাইলে মাহমুদার মা বললেন, ‘হায়াত–মউত আল্লাহর কাছে। ওর হায়াত নেই, মারা গেছে। আমার আর কোনো ধারণা নেই। আমি যদি কোলে রাখতাম, তবুও মারা যেত। ওর ওই দিন পর্যন্ত হায়াত ছিল। আমার দুইটা মেয়ে, এখন একটাই আছে।’ মেয়ের হত্যাকারীর বিচার চান না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কারও কাছে বিচার চাই না, আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাইব।’ বাবুলের মা-বাবা রোজ আসে, দেখে যায় সন্তান ও নাতি-নাতনিদের।

বাবুল আক্তারের শ্বশুর সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন এখনো বিশ্বাস করেন যে বাবুল এ হত্যায় জড়িত নন। হত্যায় বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে যেসব প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তার সবই অপ্রাসঙ্গিক বলে মন্তব্য করলেন তিনি। যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবুল একজন চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা। অনেক সূত্রবিহীন মামলাও খুঁজে বের করে ফেলেছে। সেই বাবুল যদি তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কি সরাসরি জড়িত হবে? নিজের সোর্সকে দিয়ে খুনটি করাবে? তা-ও বাড়ির কাছে, ছেলের সামনে? বিষয়গুলো ভেবে দেখা উচিত।’

মোশাররফ মেয়ে হত্যার বিচার চেয়ে বললেন, ‘হত্যার বিষয়টিকে ছাপিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে হইচই চলছে। মূল কথা হচ্ছে, খুনি কে? বাবুল যদি মাহমুদাকে হত্যা করে থাকে, এটা প্রমাণ হলে তার শাস্তি হবে।’ হত্যার তদন্ত বিষয়ে তিনি বা তাঁর পরিবারের সঙ্গে পুলিশের তদন্তকারীদের কেউ যোগাযোগ করেননি বলেও দাবি তাঁর।

৫ জুন সকালে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রামের জিইসি এলাকায় গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা। হত্যাকাণ্ডের পর বাবুল আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় তিন ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা করেন। সূত্র: প্রথম আলো।



মন্তব্য চালু নেই