বাবার কোলে চড়ে এসে পরীক্ষা দিচ্ছে ধুনটের নাইছ
দুটো পা আছে, তবে সেগুলোয় বল পায় না মেয়েটি। ডান হাতেও নেই শক্তি। সম্বল তার বাঁ হাত। এ নিয়ে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চলেছে নিরন্তর লড়াই। সব সময় মা-বাবার কোলে চড়েই ওকে স্কুলে যেতে হয়েছে। এবার এসএসসির পালা। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কাছে হার না-মানা মেয়েটি বাবার কোলে চড়ে এসেছে পরীক্ষা কেন্দ্রে।
প্রতিবন্ধী এই শিক্ষার্থীর নাম নাইছ খাতুন ওরফে হাসি (১৫)। বগুড়ার ধুনট উপজেলার বিশ্বহরি-বহালগাছা উচ্চবিদ্যালয় থেকে চলতি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার পরীক্ষা শুরুর দিন বাবার কোলে এসেছিল নাইছ ধুনট এন ইউ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে। নাইছ মানবিক বিভাগের ছাত্রী। ধুনটের বহালগাছা গ্রামে তার বাড়ি। বাবার নাম নজরুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার পরীক্ষার কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাবা নজরুল ইসলাম তাকে কোলে তুলে নিয়ে ধুনট এন ইউ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় পরীক্ষার কেন্দ্রের এক নম্বর কক্ষের একটি বেঞ্চে বসে দিয়েছেন। শ্রেণিকক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাকেও প্রশ্নপত্র ও খাতা দিয়েছেন। সেখানে বসে সে বাঁ হাত দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই লিখছে খাতায়। নির্ধারিত সময় তিন ঘণ্টা প্রতিবন্ধী হিসেবে অতিরিক্ত ২০ মিনিট পরীক্ষা শেষে আবার একইভাবে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন তার বাবা।
নাইছের বাবা নজরুল ইসলাম জানান, তাঁর মেয়ে জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী। তবে দূর থেকে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। দুটো পা, একটি হাত নিশ্চল। তাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারে না। শুধু বসা অবস্থায় বাঁ হাতটি দিয়ে কলম ধরে লিখতে পারে সে।
নাইছের মা আকতার জাহান গৃহিণী। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে নাইছ ছোট। বড় ভাই রবিউল করিম বগুড়া আজিজুল হক কলেজে অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। জন্ম থেকেই নাইছের ছিল হাসিভরা মুখ। তাই তার মা-বাবা আদর করে নাম রাখেন হাসি। শরীরের এই প্রতিবন্ধিতাকে হাসিমুখেই জয় করেছে মেয়েটি। মনোবল হারায়নি। বাঁ হাতের শক্তি ও মনোবল দিয়ে প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে চায় সে। এ কারণে সে মনোবল আর অদম্য আগ্রহ নিয়েই লেখাপাড়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। রাতদিন নিরলস পরিশ্রম করে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নাইছের চিকিৎসার জন্য তার বাবা অনেক ডাক্তার ও কবিরাজের কাছে নিয়েছেন। কিন্তু ভাগ্য তাদের সহায় হয়নি।
বাবা নজরুল ইসলাম বলেন, ৪০ শতক জমিতে কৃষিবাদ করে চলে সংসার। এর মধ্যে থেকে চলে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ।
মা আকতার জাহান বলেন, ‘বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব প্রায় দেড় কিলোমিটার। প্রতিদিন এই রাস্তা মেয়েকে কলে তুলে নিয়ে হেঁটে যাওয়া-আসা করতে হিমশিম খেতে হয়। উপায় নেই। মেয়ে তো আর একা চলতে পারে না। মেয়ের লেখাপড়ার ইচ্ছা দেখে সব দুঃখ ভুলে যাই।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে পরীক্ষার শেষে কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় নাইছ খাতুন বলে, ‘শরীরে শক্তি নেই, তাই কী হবে? মনোবল আর এক হাতের শক্তি নিয়েই জীবন শুরু করেছি। আমি কারও মাথায় বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। লেখাপড়া শিখে ভবিষ্যতে আমি একজন আদর্শ শিক্ষক হতে চাই।’
বিশ্বহরি-বহালগাছা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেজাব উদ্দিন বলেন, স্কুলে ক্লাস শুরুর আগেই নাইছ খাতুনের মা কিংবা বাবা প্রতিদিন পালাক্রমে কোলে তুলে শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীদের সারিতে বসিয়ে রেখে যান। ক্লাস শেষে তাঁরা আবার তাকে কোলে তুলে নিয়ে যান। মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থী হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
মন্তব্য চালু নেই