বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ‘নিরব বিপর্যয়’
তারা বলে, হত্যা ও নিপীড়ন থেকে দৌড়ে পালিয়ে এসেছে। তাদের এ দৌড় এসে শেষ হয়েছে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে মাটির ঘরে। এখন প্রবল বর্ষণের মৌসুম সমাগত, রয়েছে সাইক্লোনের হুমকি ও বন্যায় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা। এসব দুর্যোগই রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যারা বাংলাদেশের জনাকীর্ণ শরণার্থী শিবিরে নিরাপত্তাহীন অনিশ্চিত জীবনের মুখোমুখি অপেক্ষা করছে।
এশিয়া প্যাসিফিক রিজিওনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস’এর এজেকিয়েল সিমপারিংহাম বলছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ইস্যু একটি নিরব বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর এ সংকটে পড়ছে না, অথচ রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত জীবনের সমস্যা কাটাতে তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সবার এগিয়ে আসা জরুরি।
নতুন নতুন ছবিতে দেখা যায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাঁশের খুঁটিতে পলিথিন মোড়ানো ঘরে তাদের আশ্রয় মিলেছে। শক্ত মাটির ওপর মাদুরে তাদের বিছানা পাতা হয়েছে। এজেকিয়েল সিমপারিংহাম বলেন তাদের এ আশ্রয় খুবই দুর্বল প্রকৃতির বিশেষ করে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে মোটেই মোকাবেলা করে টিকে থাকার মত নয়। জাতিসংঘের হিসেবে সর্বশেষ ৭৪ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ শুরুর পর জীবন বাঁচাতে এরা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সাং সুচি রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের কথা বিবিসির কাছে অস্বীকার করেছেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়ার পর বাংলাদেশও নতুন করে রোহিঙ্গ শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে রাজি হচ্ছে না। রাতের আঁধারে পালিয়ে আসার সময় রোহিঙ্গাদের পুনরায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে মিয়ানমারে। সাহায্য সংস্থাগুলো খাবার, তেরপল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র দিয়ে সাহায্য করছে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল। ২২ বছরের এক রোহিঙ্গা মা মোহসেনা বলেন, বেঁচে থাকার জন্যে পর্যাপ্ত খাবার আমাদের কাছে নেই। এক বেলা খাবার পেলে আরেক বেলা খাবার জুটবে কি না আমরা জানিনা। বাচ্চাদের কি খেতে দেবে এটাই আমাদের দুশ্চিন্তা।
এক পরিসংখ্যানে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের উত্তরাঞ্চলে দশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস। বিশ্লেষকরা বলেন, বৌদ্ধ প্রধান দেশটিতে রোহিঙ্গা মুসলমানরা অত্যাচারিত জাতিগত সংখ্যালঘু ও নাগরিক অধিকারবিহীন জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা অধিকাংশ নতুন রোহিঙ্গা জাতিসংঘের উদ্বাস্তু ক্যাম্পের বাইরে আশ্রয় নিয়েছে। ১৮০ জন রোহিঙ্গা মুসলিমের জন্যে বরাদ্দ রয়েছে একটি টয়লেট। তারা রয়েছে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্যে।
তিন মাস আগে মোহসেনা ৪ বছরের ছেলে ও ৩ বছরের মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন। তার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। মোহসেনার ছেলেটি বিকলাঙ্গ। বেঁচে থাকার জন্যে মোহসেনাকে যে কোনো ধরনের কাজ খুঁজতে হচ্ছে। তিনি জানান, আমার ছেলেটি হাঁটতে, বসতে এমনকি খেতে পারে না। ভিক্ষা করে কিছু উপার্জনের চেষ্টা করি। কিভাবে বেঁচে থাকব তা জানিনা। মোসেনার মত হাজার হাজার নারী পুরুষ উদ্বাস্তু ক্যাম্পে বাস করছে। এমনি আরেকজন ২৫ বছরের রাবেয়া জানান, ৪ মাস আগে বালুখালি ক্যাম্পে তিনি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। স্বামী ও সন্তানরাও এসেছেন। মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা রাবেয়াকে নির্যাতন করে। ধর্ষণের পর রাবেয়াকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে তারই এক প্রতিবেশি। এসময় তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। কান্নজড়িত কণ্ঠে রাবেয়া জানান, মিয়ানমারের সেনারা তার পরনের কাপড় ছিড়ে ফেলে। এসময় তার গর্ভপাত ঘটে। এ অবস্থায় বেশকয়েকদিন জঙ্গলে পালিয়ে থাকার পর তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। রাবেয়ার মা ও বোনকে মিয়ানমারের সেনারা হত্যা করেছে। একসময় সম্পদ সহ সবকিছু ছিল আমাদের। রাবেয়া বলেন, আমরা এখন নিঃস্ব। খাবার নেই, টাকাও নেই।
জাতিসংঘ গত ফেব্রুয়ারি মাসে এক প্রতিবেদনে জানায়, রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও বর্বরোচিত হত্যাকা- ঘটাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। মার্চ মাসে জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল মিয়ানমারে জরুরিভাবে তথ্য অনুসন্ধান দল পাঠানোর ঘোষণা দেয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অংসাংসুচি ঘোষণা দেন মিয়ানমার থেকে যারা পালিয়ে গেছে তারা তার দেশে ফিরে নিরাপদে থাকতে পারবেন। তিনি তাদের স্বাগত জানান। কিন্তু বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনিশ্চিত জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। রাবেয়া জানান, আমার পরিবারের নিরাপত্তাই সবচেয়ে জরুরি। আমরা ফিরে যেতে চাই। দেশে ফিরতে না পারলে বাংলাদেশে কিভাবে টিকে থাকব জানিনা। সিএনএন
মন্তব্য চালু নেই