বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিয়ে ও বিয়ের রেওয়াজ সমূহ
বাংলাদেশের বিয়ে বলতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুষ্ঠিত বিয়ে ও এর আনুষঙ্গিক আচারকে বোঝানো হচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্র বিয়েকে “বিয়ে” কিংবা “বিবাহ” নামে সম্বোধন করা হলেও অঞ্চলভেদে আঞ্চলিকভাবে আরো বিভিন্ন উচ্চারণভঙ্গিতে ডাকা হয়, যেমন: বিয়্যা বা বিয়া (বিআ) কিংবা বিহা, হিন্দী ভাষার প্রভাব বা অনুকরণে শাদী। সিলেট অঞ্চলে কখনও বিয়েকে কটাক্ষ করে ডাকা হয় হেঙ্গা। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিয়ে একদিকে যেমন ধর্মীয় মিথস্ক্রীয়ায় পড়ে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষঙ্গ ধারণ করেছে, তেমনি এই নৃতাত্ত্বিক সার্বভৌম এলাকার লোকাচারও ধারণ করেছে।
তবে সর্বক্ষেত্রেই বিয়ে মোটামুটি তিনটি মূল অংশ: গায়ে হলুদ, বিয়ে এবং বৌভাত বা ওয়ালিমা-তে বিভক্ত। তবে ধর্মভেদে এই অংশ বিভাজনে সামান্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
মুসলমানদের বিয়েতে বাড়িতে কিংবা কমিউনিটি সেন্টারে কাজি ডেকে এনে বিয়ে পড়ানো হয়। দুপক্ষের উপস্থিতিতে কাজি, বর-কনের সম্মতি জানতে চান এবং উভয়ের সম্মতিতে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে পুরোহিত মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে বিয়ে পড়ান, তারপর অগ্নিকে বায়ে রেখে তাকে ঘিরে সাতবার চক্কর দেয়ার মাধ্যমে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এছাড়া হিন্দুশাস্ত্রমতে “দৈব বিবাহ”ও হয়ে থাকে, যাতে কন্যার বাবা মন্দিরে গিয়ে ঈশ্বরকে সাক্ষী করে মেয়েকে তার জামাতার হাতে তুলে দেন। বৌদ্ধ ধর্মেও মন্ত্র আউড়ে বিয়ে পড়ান বৌদ্ধ ভিক্ষু। খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের বিয়ে হয় গির্জায়, ফাদারের উপস্থিতিতে। ফাদার, বাইবেল থেকে পাঠ করে দম্পতির সম্মতি জানেন, এবং উভয়ের সম্মতিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বিশ্বের অনেক দেশেই বিয়ের অনুষ্ঠান একদিনের মধ্যে শেষ হয়ে গেলেও বাংলাদেশের বিয়ে এক দিনেতো নয়ই, বরং কখনও এক মাসেও শেষ হয় না। বিয়ের মুখ্য আয়োজনই থাকে কমপক্ষে তিন কি চার দিনব্যাপী।
গায়ে হলুদ
গায়ে হলুদ হলো বিয়ের মূল অনুষ্ঠান বহির্ভুত একটি অনুষ্ঠান, যা সাধারণত বিয়ের আগে অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটির সূচনালগ্নে যদিও বর বা কনের গায়ে হলুদ দেয়ার অনুষ্ঠানই ছিল, কিন্তু সময়ের আবর্তনে অনুষ্ঠানটি এখন অনেক ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। একইসাথে এই অনুষ্ঠান, দেশের বাইরের অনেক সংস্কৃতিও ধারণ করতে শুরু করেছে।
বিয়ে
বিয়ের অনুষ্ঠানটিই বাংলাদেশের বিয়ের মূল অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন কনেপক্ষ এবং বরপক্ষ এখানে অতিথির মতো উপস্থিত হোন। অনুষ্ঠানে বরপক্ষ পরিবার-পরিজন, নিকটাত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সমন্বয়ে গঠিত বরযাত্রী নিয়ে উপস্থিত হন। সাধারণত অনুষ্ঠানে বর ও কনের জন্য আলাদা আলাদা স্থান থাকে। বর গিয়ে তার জন্য নির্ধারিত আসনে আসীন হোন। মুসলমানদের বিয়েতে এসময় একজন কাজীর দ্বারা আক্বদ পড়ানো হয়। আক্বদ হলো বর ও কনের পারস্পরিক সম্মতি জানার সামাজিক প্রক্রিয়া। প্রথমে বর ও কনেপক্ষের মুরব্বিদের উপস্থিতিতে বিয়েতে কনের সম্মতি জানা হয় এবং পরে একই কাজীর দ্বারা বর ও কনেপক্ষের মুরব্বিদের উপস্থিতিতে বরের সম্মতি জানা হয়। এভাবে বিয়ের মূল অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। এরপর শুরু হয় ভোজনপর্ব। বিয়ের ভোজন শুরু করা হয় বরের ভোজন দিয়ে।
বরের জন্য এজন্য বিশেষভাবে আলাদা একটি বড় থালাতে খাবার সাজানো হয়, যাকে কোনো কোনো অঞ্চলে ছদরি (উচ্চারণ: সদ্রি) বলা হয়। এই থালাতে পরিবেশিত খাবার অধিকাংশ সময়েই অপচয় হয় এবং শ্রেফ সৌন্দর্যের জন্য পালন করা হয় এই রীতি। এছাড়া উপস্থিত বর ও কনেপক্ষের অতিথিদের জন্য আলাদাভাবে খাদ্য পরিবেশিত হয়। খাদ্য তালিকায় সাধারণত উচ্চক্যালরিযুক্ত খাবার থাকে, যেমন: পোলাও, মুরগির রোস্ট, কোরমা, কাবাব, রেজালা; মিষ্টিজাতীয় খাবারের মধ্যে থাকে: দই, পায়েশ, জর্দা; হজম সহায়ক খাদ্যের মধ্যে থাকে বোরহানী ইত্যাদি। এছাড়া কোনো কোনো বিয়েতে সাদা ভাত, এবং কোমল পানীয়েরও ব্যবস্থা থাকে। বিয়ের ভোজন পর্ব শেষ হলে বরকে নিয়ে যাওয়া হয় কনের কাছে এবং দুজনকে একত্র করে বসানো হয়। সেখানে আরো কিছু আচার পালন শেষে আসে বিদায় পর্ব। কনেকে বরের হাতে তুলে দেন কনেপক্ষ এবং বরপক্ষ, কনেকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন অনুষ্ঠানস্থল থেকে স্বীয় বাড়ি অভিমুখে। এসময় কনেপক্ষের মধ্যে অশ্রুসজল মুহূর্তের সৃষ্টি হয়।
হিন্দুরীতির বিয়েতে অন্যান্য ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার পাশাপাশি মূল কার্যক্রম হয় সাতচক্কর বা সাতপাক। এজন্য মন্ডপের মধ্যিখানে একটি অগ্নিকুন্ড তৈরি করে বর ও কনে উভয়ের পরিধেয় কাপড়ের একটা অংশ একত্রে গিঁট দিয়ে নেন এবং আগুনকে ডানে রেখে সাতবার চক্কর দেন বা ঘুরে আসেন। এভাবেই বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।
বৌভাত বা ওয়ালিমা
বিয়ের অনুষ্ঠানের এক বা দুদিন পর বরপক্ষের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় বৌভাত বা ওয়ালিমার অনুষ্ঠান। বৌভাতে, কনেপক্ষ তাদের নিকটাত্মীয়-বন্ধুবান্ধব-পরিজনদের নিয়ে গঠিত দল নিয়ে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। কনেপক্ষের দল হলেও এই দলকেও বরযাত্রী বলা হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বৌভাতেও বরপক্ষের অতিথিদের দাওয়াত দেয়া হয়।
বাংলাদেশের বিয়ের বিভিন্ন প্রথা
যৌতুক বা পণ
বাংলাদেশের বিয়েতে যৌতুক বা পণ প্রথা বহু প্রাচীণ। শার্লি লিন্ডেনবম পরিচালিত এক গবেষণা অনুসারে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক ছিল আর তাই বিবাহযোগ্য পাত্রের আয়ের উৎস সচ্ছল ছিল না, অপরদিকে বিবাহযোগ্যা ফর্সা গুণবতী পাত্রী পাওযা যেত হাতেগোণা। তাই সেসময় পাত্রপক্ষ পাত্রীপক্ষকে যৌতুক দিত। এই যৌতুক নগদ অর্থ কিংবা অলংকার কিংবা আসববাবপত্র যেকোনো রকম হতো। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে কৃষিভিত্তিক মানুষ শহরমুখী হওয়া শুরু করে এবং পাত্ররা শহুরে হয়ে পড়ে কর্মক্ষেত্রে সচ্ছলতা অর্জন করতে শুরু করে। অপরদিকে পাত্রীরা আগের অবস্থানে থাকে, গ্রামেই থাকে। তাই পাত্রের কদর বেড়ে যাওয়ায় সেসময় থেকে পাত্রীপক্ষ পাত্রপক্ষকে পণ বা যৌতুক দেয়া শুরু হয়। কিন্তু একসময় শহরমুখী বিপুল জনগণের সবাই চাকরি পেলো না এবং মুষ্টিমেয় চাকরিপ্রাপ্ত পাত্রের দাম আরো বেড়ে গেলে যৌতুক প্রথা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হযে পড়লো।
প্রথমদিকে যখন কনেপক্ষকে যৌতুক দেয়া হতো, তখন শীতল পাটির বয়ন জানা পাইটা কুমারীরা যে যত প্রকারের বুনন শৈলী জানত, সে তত কুড়ি টাকা পণ পেত তার বিয়ের সময়। মণিপুরি সম্প্রদায়ে বিয়ের যৌতুক হিসেবে কনেপক্ষের পক্ষ থেকে প্রতিযোগিতামূলক দামে তাঁত, ববিন এবং আনুষঙ্গিক অন্যান্য বয়নসামগ্রী যৌতুক হিসেবে দেয়া হয়ে থাকে, কেননা বংশানুক্রমে কোমরতাঁতের তাতী হচ্ছেন মেয়েরা।
পরবর্তিতে অবশ্য বাংলাদেশে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে যৌতুক দেওয়া-নেওয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
যৌতুক প্রায় সর্বত্র যৌতুক বা পণ নামে পরিচিত হলেও রাজশাহী-পাবনা অঞ্চলে যৌতুককে নাচারি বলা হয়।
বিয়ের নাচ
বাংলাদেশের সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রাজশাহী অঞ্চলের বিয়েতে বর-কনেকে গোসল করানোর সময় একপ্রকার বিশেষ নাচের প্রচলন দেখা যায়। বর-কনেকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী নারীরা এ নাচের আয়োজন করে থাকেন। তারা ধান, দূর্বা, পান, কড়ি ইত্যাদি দিয়ে বিয়ের নাচে অংশগ্রহণ করেন। এধরণের নাচে বিশেষ গানও প্রচলিত রয়েছে:
একটু ঠিকর করে লাচরে ভাবের মার্যানী,
একটু গিদার করে লাচরে ভাবের মাল্যানী।
তোকে আম বাগানের আম খাওয়াবো এখুনী
তোকে জাম বাগানের জাম খাওয়াবো এখুনী।
বাংলাদেশের বিয়ের আভরণ
পোষাক-পরিচ্ছদ
গায়ে হলুদের পোষাকে বরের ঐতিহ্যবাহী পোষাক হলো পাঞ্জাবী। সুতি পাঞ্জাবির প্রচলন অতীতকাল থেকে চলে এলেও অধুনা (২০১১) সুতির পাশাপাশি খাদি বা অ্যান্ডির প্রচলনও দেখা যায়। অধুনা পুরুষেরা পাঞ্জাবীর সঙ্গে ওড়না বা উত্তরীয় পরার চলও দেখা যায়। অতীতে পাঞ্জাবীর সঙ্গে সাধারণ ঢোলা পাজামা পরার রীতি দেখা গেলেও অধুনা চুড়িদার পাজামা এমনকি জিন্স পরার রীতিও লক্ষণীয়। পায়ে থাকে চটি জুতা।
কনের গায়ে হলুদের ভূষণে হলুদ শাড়ি-লাল পাড়ের প্রচলন যুগ-যুগান্তরের। অধুনা (২০১১) গায়ে হলুদে হলুদ, লাল, সবুজ, নীল, সাদা, বেগুনি ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় রঙের জামদানি শাড়ির প্রচলন লক্ষণীয়। কেউবা বৈচিত্র্য আনতে কাতান, গরদ কিংবা গ্রাফিক্যাল প্রিন্টের শাড়িও পরে থাকেন। চওড়া পাড়ের সুতি শাড়ি বহুযুগ থেকে আধুনিক যুগ অবধি বিরাজমান। কেউ কেউ সিল্ক এমনকি মসলিনও পরে থাকেন। অতীতে কুচি দেয়া ব্লাউজের প্রচলন থাকলেও অধুনা (২০১১) কামিজ কাটের ব্লাউজ, কন্ট্রাস্ট ব্লাউজের প্রচলন দেখা যায়। এছাড়াও শীতকালে অনুষ্ঠিত বিয়েতে ব্লাউজের সাথে কেউ কেউ লং জ্যাকেট পরে থাকেন। ব্লাউজের রং বিভিন্ন রকমের হতে পারে। অন্যান্য অনুষঙ্গের মধ্যে রয়েছে খোঁপার কাঁটা, বিছা, নুপুর; হাতে বটুয়া ইত্যাদি।
বিয়ের দিন বরের পোশাক সাধারণত হয় পাঞ্জাবি-পাজামা আর শেরওয়ানী। মাথায় একটা টুপি পরে তার উপর পাগড়ি পরে থাকেন বর। পায়ে থাকে মোজা আর নাগরা জুতা। পকেটে বা হাতে থাকে রুমাল। পাগড়ি কখনও পাঞ্জাবী ঢঙে বড় রঙীন কাপড় দিয়ে বানিয়ে নেয়া হয়, কখনও বাজার থেকে রেডিমেড পাগড়ি কিনে আনা হয়। পাগড়ি কখনও শ্রেফ সাদা কাপড়ের হয়, তবে অধিকাংশ সময়ই পাগড়ি হয় রঙীন, একাধিক রঙের সম্মিলন, আর থাকে চুমকি-জরির কারুকাজ। ইদানিং কোনো কোনো বিয়েতে বর, কাঁধে শাল কিংবা ওড়না রাখার রীতিও দেখা যায়। কনের বিয়ের পোষাক হলো রঙীন শাড়ি। বিয়ের দিন সাধারণত লাল শাড়ি পরিধান করা হয়, তবে ইদানিং লাল ছাড়াও বেগুনী, সবুজ, গোলাপী ইত্যাদি রঙের শাড়ি পরতেও দেখা যায়। শাড়ি হয় যথেষ্ট কারুকাজমন্ডিত: তার, কারচুপি, চুমকি, পুতি ইত্যাদির মিশ্রণে বেশ জমকালো হয়ে থাকে বিয়ের শাড়ি। শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ, পেটিকোট এবং জুতা পরিধান করে থাকেন কনে। বিয়ের সময় সাধারণত হাই হিল, সেমি হিল, কিংবা ফ্ল্যাট জুতা পরিধান করেন, তবে জুতাও শাড়ির সাথে মিলিয়ে পরা হয়। অনেক সময়ই শাড়ির সাথে মিলিয়ে হাত-ব্যাগ হাতে রাখার প্রচলন দেখা যায়।
অলংকার
বিয়ের অলংকার মানেই স্বর্ণালংকার। কখনও স্বর্ণের দাম বেড়ে গেলে কুলিয়ে উঠতে না পারলে রূপা দিয়েও অলংকারের স্থান পূরণ করা হয়। অতিরিক্ত সামর্থের ভিত্তিতে কেউ ক্রিস্টাল বা হীরার অলংকারও ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও সামর্থের অভাবে কেউ কেউ ইমিটেশনের অলংকার কিংবা স্বর্ণের প্রলেপ দেয়া অলংকারও ব্যবহার করে থাকেন। গহনার মধ্যে টিকলি, টায়রা, বালা, কানের দুল, নাকফুল, নোলক, গলার চেইন, গলার বড় গহনা, নেকলেস, আংটি, পায়েল, নুপুর ইত্যাদির বহুল প্রচলন লক্ষণীয়। পুরুষের জন্য সাধারণত হাতের আংটি এবং গলার চেইনের ব্যবহার দেখা যায়।
এছাড়াও বিয়ের উৎসবে ব্যবহৃত হয় ফুলের অলংকার, বিশেষ করে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নারীর ভূষণ হয় ফুলেল অলংকার। অতীতে ফুলের অলংকারে সাধারণত গাঁদা এবং রজনীগন্ধা ব্যবহৃত হতো, কিন্তু অধুনা (২০১১) সবুজ, বেগুনি, গোলাপি আর সাদা ফুল দিয়ে সাজার রীতি লক্ষ করা যায়। এ ধরণের অলংকার তৈরিতে কাঁচা ফুল যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় শুকনো ফুলও। অলংকার তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ক্রিসেনথিমাস আর বিভিন্ন রঙের অর্কিড। এছাড়া কোথাও ফুলের অলংকার তৈরিতে যোগ করা হচ্ছে মুক্তা, ক্রিস্টাল বা হীরা, পাথর আর বিভিন্ন ধরণের পুঁতি। ফুলের অলংকারের মধ্যে রয়েছে কানের দুল, মাথার টায়রা, টিকলি, রতনচুড়, আংটি, চেইন দিয়ে সংযুক্ত পায়ের পায়েল, গলার বিভিন্ন প্রকারের মালা, সীতাহার ইত্যাদি। এছাড়া তৈরি হয় কন্ঠ চিকও। ঢাকায় এধরণের ফরমায়েশি অংলকার তৈরি করার জন্য রয়েছে বিভিন্ন বিপণী বিতান।
ভূষণ
বিয়ে উপলক্ষে বর-কনে উভয়েরই বিভিন্ন প্রকারের সাজসজ্জার সংস্কৃতি বিদ্যমান। তবে স্বভাবতই কনের সাজ এখানে বেশি গুরুত্ব পায়। তাই এজাতীয় চাহিদা পূরণে শহরের পাশাপাশি মফস্বলেও গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পার্লার, যেখানে অর্থের বিনিময়ে কনেকে সাজানো হয়ে থাকে। পার্লারগুলোও গায়ে হলুদ-বিয়েভেদে ফেয়ার পলিশ, ওয়্যাক্সিং, থ্রেডিং, অ্যারোমা থেরাপিসহ বিভিন্ন প্রকার ত্বকচর্চা ও রূপচর্চার বিবরণ দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এমনকি নামী-দামি পার্লারে সাজানোর জন্য অনেক সময় কনেকে আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখা লাগে। বিয়ের সাজ বিষয়ে পত্র-পত্রিকা বিশেষ ক্রোড়পত্রও প্রকাশ করে থাকে, যেখানে কনের সাজের বিভিন্ন ধরণ, সাজের বিভিন্ন অনুষঙ্গ এমনকি দরদামেরও উল্লেখ থাকে। অতীতে বিয়ের সাজ বলতেই বোঝানো হতো লাল রঙের মেকআপ। কিন্তু অধুনা মেকআপ আর্টিস্টরা বিয়ের সাজে অতীতের লাল, হলুদ আর সোনালির সংস্রব কমিয়ে বিভিন্ন রঙের শ্যাডো ব্যবহার করে সাজানোর পক্ষপাতি। তবে সব যুগেই কনের চুলের সাজে খোঁপাই বেশি প্রাধান্য পায়; যদিও কেউ কেউ চুল বেণী করে তাতে ফুল এঁটে নেয়ার পরামর্শও দিয়ে থাকেন।
অতীতে গায়ে হলুদের আগে কিংবা পরে মেহেদি পরার রীতি ছিল বর-কনে উভয়ের জন্যই। অধুনা (২০১১) ছেলেরা মেহেদি কম পরলেও কনেরা আগের মতই হাত ভরে মেহেদির অলংকরণ করে থাকে। অতীতে মেহেদির নকশায় তেমন বৈচিত্র্য থাকতো না, সাধারণত হাতের তুলতে গোল সূর্য, আর আঙ্গুলগুলোর অগ্রভাগ প্যাঁচিয়ে বেশ কিছু মেহেদি পরার রীতি ছিল, এবং মেহেদি দিয়ে শ্রেফ হাতের পাতাই রাঙানো হতো। কিন্তু অধুনা মেহেদি দিয়ে হাতে বিভিন্ন নকশা করা ছাড়াও হাতের পাতার বাইরে কব্জি পর্যন্ত মেহেদি পরার রীতিও দেখা যায়। এমনকি অনেকে পাও মেহেদি দিয়ে রাঙিয়ে থাকেন। অতীতে কনের পা আলতা দিয়ে রাঙানোর রীতি থাকলেও মাঝখানে তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে পড়ে, তবে অধুনা (২০১১) আবারও এই রীতি কনে মহলে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।
সাজসজ্জা
বিয়ে বাড়ি সাজানোর জন্য অতীতে নানা প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হতো। সেসময় কলাগাছ দিয়ে বাড়ির প্রধান ফটকে বড় তোরণ নির্মাণ করা হতো। কখনও সৌখিনতার মাপকাঠি অনুযায়ী বাড়ির যুবক বয়সীরা বাঁশ কেটে তা দিয়ে সুন্দর করে বেড়া তৈরি করে নকশাদার ফটক তৈরি করতেন। এছাড়া বাড়ি সাজানোর উপকরণ হিসেবে কাগজের ফালি বানিয়ে তা দিয়ে রিং তৈরি করে একপ্রকার কাগুজে-শিকল তৈরি করে তা দিয়ে বাড়ি সাজানো হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে এই আয়োজন বাড়ির গন্ডি ছাড়িয়ে ‘ডেকোরেটর’ নামক বাণিজ্যিক সংগঠনের হাতে ন্যাস্ত হয়েছে। সাধারণত ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠানের লোকজন বাড়ির প্রধান ফটকে বাঁশ ও রঙিন কাপড় দিয়ে একটি গেট বা তোরণ নির্মাণ করেন।
অলংকরণ শৈলী
বিয়ে বাড়ির বিভিন্ন উপাদানে অলংকরণের রেওয়াজ বাঙালি সমাজে বহু প্রাচীণকাল থেকে লালিত। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েতে ঢাকনি সরা অলংকরণ করার রীতি প্রচলিত ছিল, আর সেসব ঢাকনি সরার মূল উপজীব্য হতো পদ্ম ও বিয়ের দেবতা[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] প্রজাপতি। বিয়ে উপলক্ষে অলঙ্কৃত “এয়োসরা”র উপরের অলংকরণে থাকে পেখম ধরা নৃত্যরত ময়ূর আর চারদিকে থাকে বৃত্তাকারে নৃত্যরত চৌদ্দজন বা ষোলজন কুমারী নারী। এছাড়া বিয়ে বাড়িতে আলপনা আঁকার রীতি আজ অবধি প্রচলিত। বিয়ের আলপনার মধ্যে বেশিরভাগই হয় বৃত্তাকার আর কেন্দ্রে থাকে পদ্ম, আর এই বৃহদাকৃতির পদ্ম-কেন্দ্রীক বৃত্তাকার আলপনায় ভারতবর্ষের বাংলা অঞ্চল ছাড়া সারা বিশ্বে স্বতন্ত্র। অবশ্য ইদানিং আলপনায় যুক্ত হয়েছে নানা রকমের মোটিফ। এছাড়া অতীতে বিয়ের সময় যে পিঁড়ি ব্যবহৃত হতো, তাতে নারী প্রত্যঙ্গ তথা উর্বরতার প্রতীকস্বরূপ আঁকা হতো ‘শতদল পদ্ম’। বিয়ের সামগ্রী বহন করার কুলার অলংকরণে থাকে বিভিন্ন জ্যামিতিক নকশা কিংবা ফুল ও প্রতীকের নকশা। বিয়ের কাঁথার অলংকরণে কখনও রাধা-কৃষ্ণের কাহিনীর দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে গোপীরা প্রায়শই বিবস্ত্র কিংবা অর্ধ্বউলঙ্গ অবস্থায় চিত্রীত হতেন।
বাংলাদেশের বিয়ের পক্ষসমূহ
বরপক্ষ
বাংলাদেশের বিয়ের ক্ষেত্রে বরের পক্ষ থেকেই সাধারণত বিয়ের প্রস্তাব, কনেপক্ষের নিকট পেশ করা হয়, তাই বরপক্ষ, বাংলাদেশের বিয়েতে একটি সক্রীয় অংশ। বরপক্ষ, বিয়ের অনুষ্ঠানের মধ্যে বৌভাত বা ওয়ালিমার আয়োজন করে থাকে। সাধারণত বিয়ের পর বরপক্ষের বাড়িতেই কনেকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং কনে ঐ বাড়িতেই আজীবনের জন্য বসত গড়েন।
কনেপক্ষ
কনেপক্ষ বা কন্যাপক্ষ, বাংলাদেশের বিয়েতে একটি নিষ্ক্রীয় অংশ। সাধারণত কনেপক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া হয় না। তবে দেয়ার প্রয়োজন হলে সাধারণত ‘ঘটক’ নামক তৃতীয়পক্ষের শরণাপন্ন হতে দেখা যায়। গ্রামেগঞ্জে, এমনকি শহরাঞ্চলেও কনেপক্ষ অনেকটা কন্যাদায়গ্রস্থ বলে মনে হয়। কারণ অনেকক্ষেত্রেই যৌতুক নামক আপাতবিলুপ্ত একটি সংস্কৃতির নতুন সংস্করণ হিসেবে কনেপক্ষকে, বিয়ের সময় বিপুল পরিমাণ আসবাব-সম্পদ কনের সাথে দিয়ে দিতে হয় বরের বাড়িতে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে কনেপক্ষ যথেষ্ট স্পর্শকাতর। কারণ কোনো কারণে নির্ধারিত বিয়ে ভেঙ্গে গেলে ঐ কনের জন্য, এমনকি ঐ পরিবারের অন্য মেয়ের জন্যও বর পাওয়া বা নতুন বিয়ে ঠিক করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠে, অনেক ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় নিজেদের স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হয় অনেক কনেপক্ষ। শহরাঞ্চলে এই প্রকোপ কম হলেও একেবারে অপ্রতুল নয়।
ঘটক
ঘটক মূলত একজন ব্যক্তি, যিনি বর এবং কনেপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন এবং বিয়েকে শেষাবধি সুসম্পন্ন করার জন্য পরিশ্রম করেন। ঘটকের এই কাজকে ঘটকালি বলা হয়। আঞ্চলিক ভাষায় অনেক সময় ঘটককে রায়বার বা আয়ভারও বলা হয়ে থাকে। ঘটকালি সবসময়ই একটা ব্যবসা নয়, বরং ক্ষেত্রবিশেষে একটি সামাজিক বা পারিবারিক দায়িত্বও হয়ে ওঠে। যদিও অনেকে একে ব্যবসা হিসেবে নিজের পেশা করে নিয়েছেন। বাংলাদেশে, ঘটক পাখি ভাই ঘটকালিতে বিশেষ সুনামধারী একজন ব্যক্তি, যিনি ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই ব্যবসায়ের সাথে জড়িত এবং মার্চ ২০১০ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৮,০০০ বিয়ে দিয়েছেন বলে জানা যায়। তাঁর প্রকৃত নাম কাজী আশরাফ হোসেন হলেও অনেকেই তাঁকে পাখি ভাই নামেই চিনে থাকেন। বাংলাদেশের সমাজে ব্যবসায়িক ঘটকালির ব্যাপারটা ঘটে অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে, গোপনে। তাছাড়া ঘটকালির মাধ্যমে যারা বিয়ে করেন তারা প্রায় কেউই বিয়ের আগে বা পরেও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। ঘটকালির কাজটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘুরে ঘুরে করতে হলেও তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অনেকেই ঘটকালির কাজটিকে ইন্টারনেটভিত্তিক করে নিচ্ছেন।
অঞ্চলভেদে বাংলাদেশের বিয়ে
ঢাকা অঞ্চলের বিয়ে
ঢাকা অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ঢাকার পুরোন বাসিন্দা “ঢাকাইয়াদের বিয়ে। এছাড়াও ঢাকায় আবাস করেছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষেরা, আর তাই তাদের সম্মিলিত সংস্কৃতির মিথষ্ক্রীয়ায় তৈরি হয়েছে একটি মিশ্র সংস্কৃতি। এছাড়াও ঢাকায় বসবাসরত উচ্চবিত্তদের দ্বারা প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে উচ্চবিত্তের, পরম ব্যয়বহুল আরেক ধরণের বিয়ের রীতি, যেখানে বিয়ের ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই শাস্ত্রীয় বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে স্বীয় বৈশিষ্ট্য ধারণ করেছে, এবং বিয়ের রীতিতে ধার করেছে বহির্দেশীয় সংস্কৃতির উপজীব্য।
ঢাকাইয়া বিয়ে
সাধারণত ঢাকা, বিশেষ করে পুরোন ঢাকার বাসিন্দাদের ঢাকাইয়া বলা হয়। ঢাকাইয়া বিয়েতে আনুষ্ঠানিকতার বাহুল্য দেখা যায়। বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পরে, বিয়ে সংক্রান্ত উভপক্ষের যাবতীয় আলোচনার জন্য পানচিনি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন পেশাজীবি ঘটক, যাদেরকে বলা হয় মোতাসা। পানচিনি অনুষ্ঠান থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলে বিয়ের সম্ভাব্য দিনক্ষণ এবং লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য আয়োজন করা হয় মোতাসা-রাই বা ‘পাকাকথা’ অনুষ্ঠানের- এ অনুষ্ঠানে বিয়ের কথা পাকা করা হয়। সব অনুষ্ঠানেই মুখরোচক খাবারের আয়োজন থাকে। এরকম খাদ্যপর্বকে ঢাকাইয়া ভাষায় বলা হয় ‘খাস আপ্যায়ন’। মূল বিয়ে অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে অনুষ্ঠিত হয় হলদি বা তেলাই, যে অনুষ্ঠানে গোসলের আগে বর ও কনের গায়ে হলুদবাটা মাখানো হয়। আয়ুর্বেদিকভাবে বিশ্বাস করা হয় হলুদ, বিয়ের আগে বর-কনের গায়ের রং উজ্জ্বল করবে। বিয়ের প্রথম থেকে শেষাবধি আত্মীয়স্বজনের অংশগ্রহণ আর গান-বাজনার মাধ্যমে এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়।
বর ও কনের বাড়িতে আলাদাভাবে তেলাইয়ের আয়োজন হয়ে থাকে। বরপক্ষ, মিষ্টিসহ বিভিন্ন উপাচার নিয়ে কনের বাড়িতে উপস্থিত হন; তেমনি কনেপক্ষের লোক উপস্থিত হন বরপক্ষের বাড়িতে। এসকল উপাচারের মধ্যে অবশ্যই থাকে দুটি বড় মাছ, যার একটি বরের প্রতীক, অন্যটি কনের। বরের প্রতীক মাছটির মুখে গুঁজে দেওয়া হয় একটি সিগারেট, কখনও মাছের মাথায় পরিয়ে দেয়া হয় গামছা; আর কনের প্রতীক মাছটির মুখ ঢেকে দেওয়া হয় একটুকরো কাপড় দিয়ে। এই মাছগুলো যে কাটে, তার জন্য উপহারস্বরূপ মাছের ভেতর দেওয়া হয় অর্থ। হলুদপর্ব শেষ হলেই শুরু হয় রং ছিটানোর খেলা, যা হিন্দুধর্মের হোলি উৎসবের অনুরূপ। এরপর বর ও কনের বাড়িতে আলাদাভাবে আয়োজন করা হয় আইবুড় ভাত নামের অনুষ্ঠান, যার আরেক নাম কুমারী ভাত। আইবুড় মানে অবিবাহিত অবস্থায় নিজের বাড়িতে বর বা কনের শেষ খাওয়া। উল্লেখ বাহুল্য হলেও বলতে হয়, এ অনুষ্ঠানেও থাকে প্রচুর খাবারের আয়োজন।
এরপর আসে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা। আগে কার্ড ছেপে দাওয়াত পাঠানোর রেওয়াজ ছিল না, এই কাজটি করা হতো লবঙ্গ উপহার দিয়ে। সেসময় কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া করারও কোনো প্রচলন ছিল না। তাই গলির মোড়ে কিংবা এলাকার মসজিদে বিয়ের কাবিননামা লেখার কাজ সেরে নেয়া হতো। এরপর খাওয়াদাওয়া, উপহার প্রদান আর আতশবাজি ফোটানোর উৎসব চলতো বিয়ে বাড়িতে। বিয়ের পরও আরো মাসখানেক রয়ে যায় ঢাকাইয়া বিয়ের উৎসবের এই আমেজ। বিয়ের পর কনের পিতৃগৃহে বর আর কনের বেড়াতে যাওয়াকে বলা হয় ফিরোল্টা (ফির+উল্টা বা শ্বশুড় বাড়িতে আসা কনের উল্টো ফিরে যাওয়া)। সাম্প্রতিককালে (২০১১) কোনো কোনো আচার-প্রথা হারাতে বসলেও অধিকাংশই এখনো টিকে আছে।
অন্যান্য
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিয়ে
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে বাঙালি ছাড়াও বাস করে অনেক অনেক আদিবাসী। মূলত এই অনুচ্ছেদে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙালি বিয়ের রীতি আলোচিত হয়েছে। চট্টগ্রামের বিয়ে সাধারণত হয় বেশ আড়ম্বরপূর্ণ। বিয়ের প্রাথমিক কার্যকলাপ অন্যান্য অঞ্চলের মতোই সম্পন্ন হয়। তবে বিয়ের আগে আয়োজন করা হয় বউ জোড়নি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বর ও কনের মধ্যে আলাপ করিয়ে দেয়াই এর মূল লক্ষ্য। এজন্য বউ জোড়নি অনুষ্ঠানে কনেকে সাজিয়ে বরের সামনে উপস্থিত করা হয়। জোড়নি অনুষ্ঠানটি অনেকটাই “এ্যাঙ্গেজমেন্ট” অনুষ্ঠানের সাথে তুলনীয়। চট্টগ্রামের আরেকটি বিচিত্র আয়োজন হচ্ছে ‘ঘরজামাই বিয়া’। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙালি বিয়েতে বিয়ের পর কনের বাড়িতে বরের থেকে যাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ঘরজামাই বিয়া।
কুমিল্লা অঞ্চলের বিয়ে
কুমিল্লার বিয়েতে গায়ে হলুদ হতো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে। বাড়ির উঠানে চৌকি পেতে তাতে চাদর বিছিয়ে বানানো হতো গায়ে হলুদের স্টেজ, বাঁশ বা কলা গাছ দিয়ে বানানো হতো স্টেজের সম্মুখভাগ। বিয়ে বাড়ি সাজানো হতো রঙিন কাগজের তৈরি রিং জোড়া দিয়ে কিংবা রঙিন কাগজ ত্রিকোণা করে কেটে সুতায় ঝুলিয়ে। গায়ে হলুদের জন্য বরের বাড়ি থেকে কনের জন্য এবং কনের বাড়ি থেকে বরের জন্য হলদে রঙের পোষাক, জুতা, টাওয়্যাল ইত্যাদি পাঠানো হতো। হলুদের দিনে বরের বাড়ি থেকে হলুদের জিনিসপত্রের সাথে আরো পাঠানো হতো বড় মাছ; সেই মাছের মুখে পুরে দেয়া হতো টাকা। রীতি অনুসারে যে মাছ কাটতেন, তিনি এই টাকাটা পেতেন। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে লোকগীতির প্রচলন ছিল। কনের গায়ে হলুদের পরে তার গোসলের পানি বহন করে আনতেন কনের বড় বোনের জামাই বা দুলাভাই। এই পানি দিয়েই কনের গায়ে হলুদোত্তর গোসল করানো হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানে উপহার নামক এক প্রকার রসাত্মক চিঠির প্রচলন ছিল, যা সাধারণত বর-কনের ছোট ভাই-বোনেরা বর-কনের উদ্দেশ্যে লিখে ছাপাতেন। তা আবার ঘটা করে সর্বসমক্ষে পড়ে শোনানো হতো। বিয়ের দিনে, বিয়ের অনুষ্ঠানে বরপক্ষ অংশগ্রহণ করার সময় কনের জন্য বিয়ের পোষাক ও গহনা সাথে করে নিয়ে আসতেন। এই পোষাকের মধ্যে কনের মা, দাদী, নানীসহ কনের ভাই-বোনের জন্যও পোষাক অন্তর্ভুক্ত থাকতো। কনের জন্য আনা আভরণ দিয়ে কনেকে সাজিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা হতো। তারপর ঘরে কনের সম্মতি নেয়া হতো আর বাইরে, বিয়ের স্টেজে বরের সম্মতি নেয়া হতো। বিয়ের সময় যৌতুকের কোনো উল্লেখ না থাকলেও সামাজিক রীতি অনুসারে কনেপক্ষ শোবার ঘর সাজানোর যাবতীয় জিনিসপত্তর (আসবাবপত্র ইত্যাদি) কনের সাথে প্রদান করা হতো। এছাড়াও বরের জন্য কনেপক্ষ থেকে অবশ্যম্ভাবি ঘড়ি, কলম, স্যুট পাঠানো হতো। বৌভাত সাধারণত হতো বিয়ের কয়েকদিন পর, এবং বৌভাতের দিন কনেপক্ষ বরের বাড়িতে দাওয়াত খেতে যেতেন, সেখানে আপ্যায়ন শেষে তাদের সাথেই কনে ফিরানি-তে (ফিরতি যাত্রায়) বাপের বাড়িতে আসতেন। বর্তমানে এই রীতির অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে।
সিলেট অঞ্চলের বিয়ে
সিলেট অঞ্চলের বিয়েতে, বিয়ের দিন কিংবা বিয়ের আগে ধামাইল নামের একটি মেয়েলি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে সাধারণত মহিলারা গীত গেয়ে থাকেন। সিলেটের বেশ কিছু জনপ্রিয় আঞ্চলিক বিয়ের গান রয়েছে, যেগুলো প্রায় সব বাড়ির নারীরাই জানেন। তাই গীতের সঙ্গে প্রায় সবাই গলা মেলাতে পারে। গীতের তালে তালে নারীরা তুলে ধরেন বরের মেজাজ, কনের চালচলন।
সিলেটি বিয়ের গানের একটি নমুনা উল্লেখ করা হলো:
দেখছি কইন্যার মাথা ভালা ডাব নারিকেল জুড়ারে
দেখছি কইন্যার দাঁত ভালা আনারের দানারে
দামান্দেরও সাত ভাই সাত ঘুড়া ছুয়ারী
একেলা দামান রাজা চৌদল চুয়ারী
চৌদলের কিনারে পড়ে হীরা লাল মতিরে
চল যাই চল যাই দামান দেখিবারে।
আবার এই গীতের পাশাপাশি, কখনও কনেকে ঘিরে, কখনও আলাদাভাবে নারীরা একত্রিত হয়ে কোমরে শাড়ি প্যাঁচিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে হাততালি দিয়ে মাটিতে পা দিয়ে তাল ঠুকে ঠুকে নাচতে থাকেন। নাচের তাল কেবল একটিই- একটু সামনে, সকলে একত্রে এগিয়ে গিয়ে একবার হাততালি, আবার পিছিয়ে এসে পরবর্তি হাততালির প্রস্তুতি। তবে অধুনা বিয়েতে এজাতীয় গানের আয়োজন খুব কমে এসেছে, এবং এজাতীয় পারিবারিক আড্ডায় হিন্দী গান ও মডার্ণ ড্যান্সের উপস্থিতি লক্ষণীয়।
সিলেট অঞ্চলের বিয়েতে একসময় মুসলমানী রীতিতে বিয়ের মধ্যেও হিন্দুরীতির অনেককিছুই স্থান পেতো। যদিও সেসময়ে বিয়েতে প্রাকৃতিক উপকরণের প্রাধান্য থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে মনে হতো যে, বিয়ের রীতি হিন্দুরীতির কাছাকাছি, কেননা হিন্দুরীতির অনেকাংশ জুড়েই ছিল প্রকৃতির পূজা আর প্রাকৃতিক উপাদানের প্রাধান্য। তবে এও সত্য যে, ইসলাম ধর্মে উল্লেখ নেই এমন অনেক আচারই হিন্দু ধর্মের প্রভাবে তখনই স্থান করে নেয় মুসলমানী বিয়ের রীতিতেও। এসকল আচারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: গায়ে হলুদের পুরো অনুষ্ঠান; গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বোন কর্তৃক ভাইকে রাখি বন্ধন; বিয়ের দিনে বরের গোসলের আগে কাস্তে দিয়ে পানিতে বিশেষ আচার পালন, মাথার উপর কয়েক টুকরা ঘাস ঘুরিয়ে অজ্ঞাত অশুভ প্রভাব থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি। বর্তমানে (প্রেক্ষিত ২০১১) ধর্মনির্বিশেষে মূলত অর্থের প্রাধান্য থাকে। বিশেষত সিলেট অঞ্চলের লোকেরা বিলেতে এবং মধ্যপ্রাচ্যে থাকার কারণে তাঁদের আনীত রেমিটেন্সের প্রভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানাদি হয় অর্থের জাঁকজমকপূর্ণ। অনেক সময় বাহুল্য আচরণাদি স্থান করে নেয় বিয়ের অনুষ্ঠানে। যেমন: গায়ে হলুদের দিনে বরপক্ষ বা কনেপক্ষের সকল পুরুষ একরঙের পাঞ্জাবি ধারণ, সকল নারী একরঙের শাড়ি বা সালোয়ার কামিজ ধারণ; বিয়ের অনুষ্ঠানে পার্টি স্প্রে’র ব্যবহার ইত্যাদি। সিলেট অঞ্চলের বিয়েতে গাড়ির বহর একটি সাধারণ এবং নৈমিত্তিক অনুষঙ্গ। সাধারণত বরপক্ষ কতটি গাড়ি নিয়ে বরযাত্রী গেলেন, তা আভিজাত্য প্রকাশের একটি মাধ্যম। অনেক ক্ষেত্রে একই এলাকার মধ্যে এক বাড়ির সাথে অন্য বাড়ির বড়ত্ব প্রকাশের মাধ্যমও হয় এই গাড়িবহর।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মঞ্চ সাজানোর ক্ষেত্রে কাঁচাফুল, গাছের পাতা ইত্যাদির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় (প্রেক্ষিত ২০০৯-‘১১)। অধুনা মেঝেতে কার্পেটের বদলে একটি বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে অলঙ্করণ করা হয়। মাটির মেঝেতে কাঠের গুড়া আর আইকা আঠা মিশিয়ে একপ্রকারের মণ্ড তৈরি করা হয়, যার সাথে রং মিশিয়ে মেঝেতে নকশাকারে বসানো হয়। তারপর অতিরিক্ত অনুষঙ্গের প্রয়োজন হলে [সবুজ রং দেখাতে] মটরশুঁটি, [সাদাটে রং দেখাতে] মটর ইত্যাদি বসানো হয়। কিছুক্ষণ উন্মুক্ত অবস্থায় রেখে দিলে এগুলো জমে গিয়ে মাটিতে কার্পেটের মতো আবরণ ধারণ করে। এর দুপাশে ফুল (সাধারণত কাঁচা ফুল) দিয়ে সারি তৈরি করা হয়। এই ফুলবেষ্টিত কার্পেট মাড়িয়ে বর বা কনে গিয়ে গায়ে হলুদের মঞ্চে আসীন হোন।
বরের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কনেপক্ষ, কিংবা কনেপক্ষের অনুষ্ঠানে বরপক্ষ সাধারণত অংশগ্রহণ করেন না। আর বরপক্ষের গায়ে হলুদে কনে, কিংবা কনেপক্ষের অনুষ্ঠানে বরের উপস্থিতি প্রায় নিষিদ্ধ এবং অনেক ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূত এমনকি অমঙ্গল হিসেবেও দেখা হয়। এই অবস্থা ধর্মনির্বিশেষে সকল বিয়েতেই দেখা যায় (প্রেক্ষিত ২০১১)।
সিলেট অঞ্চলের বিয়েতে কন্যাপক্ষ, মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সময় সংসারের প্রয়োজনীয় সকল আসবাব তৈরি করে দিয়ে থাকে। ধারণা করা যায়, একসময় সিলেটে যৌতুক প্রথা হিসেবে এর প্রচলন হয়। তবে এখন আর তা যৌতুক হিসেবে নয়, বরং একটা রেওয়াজ হিসেবেই কন্যাপক্ষের উপর বর্তায়; আবার তা না দিলে অনেক সময় বৌ-কে শ্বশুড়বাড়ির কথা শুনতে হয়, যা অনেকটাই যৌতুকপ্রথার অনুরূপ। তবে সম্ভ্রান্ত পরিবারে বৌ-কে কথা শুনতে না হলেও কনেপক্ষের, আসবাব না দেয়াটাকে সামর্থের অভাব ধরা হয় এবং তা একটা আর্থিক ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
সিলেট অঞ্চলে, মুসলমানী বিয়েতে এই আসবাব বলতে পিঁড়ি, জায়নামাজ থেকে শুরু করে বিছানা, ড্রেসিং টেবিল, সোফা, ফ্রিজ পর্যন্ত সবই বোঝায়; তবে কুসংস্কারবশত ঝাড়ু আর পাটা (শিল-পাটা) সাধারণত দেয়া হয় না। আবার বরপক্ষ থেকে, কনের পিতা, বড় ভাই প্রমুখ বাদে মা, ছোট ভাই-বোন, চাচী, ফুফু, নানা-নানী প্রমুখ সকলকে (মোটামুটি হিসেবে একান্নবর্তী পরিবারের অধিকাংশ মানুষকে) এবং যে মৌলভী কনেকে ইসলাম শিক্ষা দিয়েছেন তাঁকে, ব্যবারী ‘কাপড় (ব্যবহারী কাপড়) দিয়ে থাকেন। এছাড়াও বরের বাড়িতে বিবাহীত আত্মীয়-স্বজন যাঁরা আসেন, সাধারণত বরের আত্মীয় সম্পর্কের ভাই-বোন-শ্রেণীয়দেরকে কাপড় উপহার দেয়া হয়।
সিলেটি বিয়ের ‘উপহার’
‘উপহার’ লেখা হতো কবিতার ছন্দে ভাই-ভাবির উদ্দেশ্যে
উপহার লেখা হতো কবিতার ছন্দে ভাই-ভাবির উদ্দেশ্যে
‘উপহার’ কখনও হতো পুরোন কোনো গৎবাঁধা ফরম্যাটে
উপহার কখনও হতো পুরোন কোনো গৎবাঁধা ফরম্যাটে
অতীতে, সিলেট অঞ্চলের বিয়েতে লাঠালাঠির প্রচলন ছিল বলে জানা যায়। কনের বাড়িতে ঢুকতে বরপক্ষকে লাঠালাঠিতে হারাতে হতো কনেপক্ষকে। এই লাঠালাঠি মোটেই কোনো পূর্বশত্রুতার জের নয়, বরং রীতির বহিঃপ্রকাশ ছিল। এভাবে যতক্ষণ, এমনকি যতদিন বরপক্ষ, কনেপক্ষকে হারাতে না পারে, ততদিন তারা কনেপক্ষের বাড়ির সামনে অপেক্ষমান থাকতেন; তারপর হারাতে পারলেই কনেপক্ষের বাড়িতে প্রবেশের সুযোগ হতো। তখনকার বিয়েতে বর বা কনের চেয়ে বয়সে ছোট সকলের নামে বর বা বধুর উদ্দেশ্যে বিশেষ কবিতা সংকলিত করে প্রকাশের প্রচলন ছিল। এসব সংকলনের নাম দেয়া হতো সুখের বাসর, ঘি চমচম, মিলন বার্তা কিংবা উপহার। এই লেখাগুলো হতো কৌতুকপূর্ণ ও চটকদার।
রাজশাহী অঞ্চলের বিয়ে
রাজশাহী অঞ্চলের বিয়েতে থাকে পিঠার জয়জয়কার। বিয়ের কথাবার্তা ঠিক হওয়ার পর আঞ্চলিক গীতের তালে তালে বর-কনেকে স্ব স্ব বাড়িতে মিষ্টিমুখ করানো হয়, এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় থুবড়া। সাধারণত ক্ষীর ও আন্ধাষা (তেলে ভাজা রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি পিঠাবিশেষ) তৈরি করা হয়। এই মিষ্টি সাধারণত পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে তৈরি করে পাঠানো হয় বর-কনের বাড়িতে।
খুলনা অঞ্চলের বিয়ে
খুলনা অঞ্চলে বর আর কনেপক্ষের মধ্যে বিয়ের সময় অনুষ্ঠিত হয় প্রীতি বাকযুদ্ধ। তাও আবার বাংলায় নয়, এই তর্ক চলে পুরোপুরি ইংরেজিতে। এই ইংরেজি তর্কযুদ্ধই খুলনার বিয়ের স্বকীয়তা। বাড়ির প্রধান ফটকে বরপক্ষকে আটকে কনেপক্ষের লোকজন ইংরেজিতে কথোপকথন শুরু করে। তার জবাবে বরপক্ষকেও উত্তর দিতে হয় ইংরেজিতে। শেষ পর্যন্ত যে পক্ষ তর্ক চালিয়ে যেতে অপারগ হয়, তারা পরাজিত হয়। মূলত একপক্ষ, অন্য পক্ষকে লজ্জা পাইয়ে দেয়ার জন্যই এই প্রীতি বাকযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
উপসংস্কৃতি
আদিবাসীদের বিয়ে
বাংলাদেশে সব মিলিয়ে ৪৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে। তাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বিয়ের রীতি রয়েছে। বিয়ে অনুষ্ঠানে কুলার মধ্যে ধান, দুর্বা, আতপ চাল, মিষ্টি, সিঁদুর ইত্যাদি সহকারে বর-কনেকে বরণ করার রীতি বাংলাদেশের অধিকাংশ আদিবাসী সমাজে প্রচলিত। আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন এ রীতি নতুন দম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন ধন-ধান্যে পরিপূর্ণ করবে। আদিবাসীয় বিশ্বাসমতে, ধান, দুর্বা, আতপ চাল ইত্যাদি বস্তুতে রয়েছে জীবনসার, এবং সিঁদুর হলো আদিবাসীদের যৌনচিহ্ন। আবার বিয়ের আগে বর-কনেকে তেল, হলুদ মেখে স্নান করানোর রীতি প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই পালিত হয়, যাকে বলা হয় ‘তেলাই’। আদিবাসীদের বিশ্বাস তেলাইয়ের মাধ্যমে বর-কনেকে পবিত্র করা হয়। যাতে অপদেবতার কুদৃষ্টি বিনষ্ট হতে পারে। আদিবাসী বিশ্বাসে জল অতি পবিত্র এবং এতে সারবস্তু রয়েছে অধিক মাত্রায়। একারণে চাকমা, মগ, টিপরা, দালুই, সাঁওতাল, ওঁরাও, রাজবংশী প্রভৃতি আদিবাসীদের মধ্যে বিয়ের পর মঙ্গলঘট থেকে আমপাতা-জামপাতা দিয়ে জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করার রীতি প্রচলিত আছে। বর-কনের জীবন যাতে সুখী হয় তা-ই তাদের আশীর্বাদের মূল উদ্দেশ্য।
বিয়েতে নবদম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন কিরূপ হবে চাকমা সমাজে সে পরীক্ষা-রীতি চালু রয়েছে। মহিলারা কলার খোল দিয়ে দুটো নৌকা তৈরি করে একটিতে পান এবং অপরটিতে সুপারি দিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেন। নৌকা দুটি যদি পাশাপাশি ভাসতে থাকে তবে মনে করা হয় নবদম্পতির মিলের সম্ভাবনা। আর যদি বিপরীতমুখো হয়ে ভাসতে থাকে তবে অমিলের সম্ভাবনা। অমিল ঠেকাতে বিপরীতমুখী হয়ে ভাসা নৌকা দুটি টেনে একত্র করে তার নিচ থেকে কলসি ভরে জল এনে নবদম্পতিকে স্নান করিয়ে দেয়া হয়। সাঁওতাল, ওঁরাও, রাজবংশী প্রভৃতি আদিবাসীরাও এই নিয়ম পালন করে থাকেন সামান্য একটু ভিন্ন উপায়ে। বিয়ের পরের দিন বাড়ির আঙিনায় ছোট একটি পুকুর কাটা হয়। তারপর তাতে পানিভর্তি করে বর ও কনেকে সেই পুকুরে পয়সার লুকোচুরি খেলায় নামতে দেয়া হয়। প্রথমে বর একটি পয়সা লুকিয়ে রাখে এবং স্ত্রী তা খুঁজে বের করেন। পরে স্ত্রী তা লুকান এবং বর খুঁজে বের করেন। যদি উভয়েই সফল হন তবে তাদের মধ্যে ভবিষ্যৎ জীবনে দ্বন্দ্ব কলহ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে না। বাংলাদেশের গ্রামবাংলার হিন্দু ও মুসলিম সমাজেও এই পয়সার লুকোচুরি খেলার নিয়ম প্রচলিত আছে।
মণিপুরি
সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন এলাকায় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে মণিপুরি সম্প্রদায়ের লোকেরা বসবাস করে। মণিপুরিদের বিয়ের অনুষ্ঠান ৬ ভাগে বিভক্ত: প্রথমে মাউংকাবা অনুষ্ঠান দিয়ে শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা, এরপর একে একে হাজিবত (মঙ্গলাচরণ), হাইজিং, জামাই বারতন, লুহংরা (বিয়ে) ও মাঙ্গানী চাকখাবা অনুষ্ঠানগুলো ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। মণিপুরি সমাজের বিয়েতে কোনোপ্রকার যৌতুকপ্রথা নেই।
গারো
ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলার গারোদের সমাজে একসময় বাল্যবিবাহের অনুরূপ “ঠ্যাঙ ধরা বিয়ে” নামক একপ্রকারের বিয়ের প্রচলন ছিল। কনে খুব ছোট থাকাবস্থায় এধরণের বিয়ে হতো। বিয়ের দিন কনের মা কনেকে কোলে নিয়ে বিয়ের কুঠিরে বসতেন। বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন বর এবং গ্রাম্য মোড়ল, আর উভয়পক্ষের আত্মীয়-স্বজন। সবার সামনে বর এসে শ্বাশুড়ির পা চেপে ধরতেন, এবং নিজের সম্মতি জানিয়ে কনেসহ কনের মাকে তাঁর ঘরে যাবার অনুরোধ করতেন। এভাবে বিয়ে সম্পন্ন হতো, আর মেয়ে বড় না হওয়া পর্যন্ত বরের বাড়িতে মেয়ের মাও অবস্থান করতেন এবং মেয়ের দেখাশোনা করতেন।
হাজং
আদিবাসী সমাজ হাজং-এ বিয়ে আছে ৪ ধরনের। তবে সবচেয়ে প্রচলিত হচ্ছে স্বাভাবিক বিয়ে, অন্যান্যগুলো হলো হাঙ্গা, দায়মারা ও দায়পোড়া।
খিয়াং
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে অষ্টম সংখ্যাগরিষ্ট আদিবাসীগোষ্ঠী হলো খিয়াং। রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবানে এঁদের বসবাস। খিয়াং সমাজে বিয়ে, জন্ম-মৃত্যুর মতোই একটি অলঙ্ঘনীয় অধ্যায়, যার আচার-রীতিনীতিও বেশ সামাজিক। পরিবারের গণ্যমান্য ব্যক্তি, নিকটাত্মীয় এবং সমাজের প্রবীণদেরকে সাথে নিয়ে বিয়ের আয়োজন করা বর এবং কনে- উভয়পক্ষের অভিভাবকের জন্যই বাধ্যতামূলক। অন্যথায় গ্রামের গণ্যমান্য ও প্রবীণ ব্যক্তিরা বিয়ের কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। এই রীতির সামাজিক উদ্দেশ্য হলো বিবাহ উপলক্ষে পাত্র-পাত্রীর পরিবারে কি ধরণের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন তা নির্ণয় করা। এরপর বরের বাবা-মা নিকটাত্মীয়সমেত কনের বাড়িতে গিয়ে আলোচনার মাধ্যমে বিয়ের দিন-তারিখ নির্ধারণ করেন। সাধারণত খিয়াং সমাজে পূর্ণিমার সময় বুধ ও বৃহস্পতিবারকে বিয়ের শুভদিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
ভাদ্র ও কার্তিক মাসে খিয়াং সমাজে বিবাহ অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ। বিয়ের দিন বরযাত্রীরা কনের বাড়িতে পৌঁছলে তাদেরকে বিয়ের অনুষ্ঠানস্থলে এনে বসানো হয়। আমন্ত্রিত সকল অতিথির সামনে বর-কনেকে বসিয়ে উভয়ের হাতের উপর হাত রেখে ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে বর-কনেকে মুখোমুখি বসানো হয়, অবশ্য বরের আসন, কনের তুলনায় কিছুটা উঁচুতে হয়। বর-কনের মাঝখানে একটি থালায় সিদ্ধ করা আস্ত একটি মুরগী, এক বোতল মদ ও ভাত রাখা হয়। বর প্রথমে মদ পান করার পর সিদ্ধ করা মুরগীর গলার নিচের অংশ টেনে বিয়ের শুভাশুভ যাচাই করেন। এরপর নবদম্পতি উপস্থিত গুরুজনদের প্রণাম করে আশীর্বাদ গ্রহণ করেন। বিয়ে অনুষ্ঠানের পর বরের হাতে একটি দা আর কনের হাতে একটি কাস্তে তুলে দেয়া হয়- একে খিয়াং সমাজে সৎ জীবনযাপনের প্রতীক এবং আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিয়ে অনুষ্ঠানের পর বরযাত্রীরা ফিরে গেলেও বরকে কনের বাড়িতে তিন,পাঁচ কিংবা সাতদিন পর্যন্ত থাকতে হয়। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরতে পারেন বর।
স্ত্রীকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরে আসার পর বরের বাড়িতে একই রকমের আরেকটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। লাইতু-খিয়াংদের বিবাহ-রীতি অনুসারে বর ও কনে বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বরের বাড়িতে ফিরে এলে সেখানে পুনরায় ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠান হয়। ‘শিওরি পই’সহ বিয়ে হলে কনের বাড়ীতে এক রাত অবস্থানের পর সকালে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বর-কনে উভয়ে বরের বাড়িতে ফিরে যান। ‘শিওরি পই’ অনুষ্ঠানে বর ও কনের পাশে মদের (জু) জাবার কলসির ভেতর পানি ঢেলে দিয়ে কলসির মুখে দুটি সরু নল বসানো হয়। অনুষ্ঠানে আগত গণ্যমান্য অতিথিরা নল দিয়ে কলসি থেকে মদের জাবার পানি পান করেন। বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কারণে কনের মায়ের বুকের দুধের দাবিস্বরূপ মূল্যবান কোনো সামগ্রী বা নগদ অর্থ বরপক্ষকে অবশ্যই দিতে হয়; আগে এক্ষেত্রে ২টি রৌপ্য মুদ্রা দেয়ার প্রচলন ছিল; খিয়াং ভাষায় এই প্রথাকে ‘চিই মন’ বলা হয়। ‘চিই মন’ বাবদ ১০১ টাকা পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া যে গ্রাম বা পাড়ায় বিয়ে হয় সেই গ্রাম বা পাড়ার হেডম্যান/কারবারীকে বর-কনে উভয়পক্ষকে ‘চিরিপেইলা’ বাবদ (পূর্বে ৭ টাকা) বর্তমানে (২০১১) ১২ টাকা প্রদান করতে হয়। অবশ্য লাইতু-খিয়াংদের সমাজে ‘চিরিপেইলা’ রীতির প্রচলন নেই। ‘লাকশোঙ’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিবাহিত দম্পতি খিয়াং সমাজের স্বীকৃতি লাভ করেন। খিয়াং সমাজের আদি বিবাহ-রীতির বাইরে বর্তমানে (২০১১) বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্ম অনুসারী খিয়াংরা স্বীয় ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করেন এবং পাশাপাশি কিছু সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানও পালন করেন। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী খিয়াং সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠান চার্চের পুরোহিতের মাধ্যমে চার্চের রীতি অনুসারেই হয়ে থাকে।
সাঁওতাল
সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত আছে একপ্রকার জোরজবরদস্তিমূলক বিয়ে, যাকে বলা হয় “হুরকাটারা” বা “ইতুত”। তবে এই বিয়ে পাশ্চাত্যের আদিবাসীদের মতো অতোটা বলপূর্বক বিয়ে নয়। আবার সাঁওতালদের মধ্যে আরেক প্রকারের বিয়েরও প্রচলন রয়েছে: তাদের বিশ্বাস, ছোটবেলায় কোনো শিশুর যদি প্রথম দাঁত উপরের মাড়িতে উঠে, তাহলে তার উপর দেবতার কুনজর পড়েছে। এক্ষেত্রে দেবতার কুনজর থেকে বাঁচাতে তাকে কুকুর অথবা শেওড়া গাছ অথবা মহুয়া গাছের সাথে বিয়ে দেয়া হয়; বিয়ের ধরণ অনুসারে এই বিয়েকে ডাকা হয় যথাক্রমে শেতা বাপলা, দাইবান বাপলা, মাতকোম বাপলা।[১৫] সাঁওতালদের অনেকেই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী হয়ে যাওয়ায় গীর্জাতে গিয়ে পাদ্রির উপস্থিতিতে বিয়ে করে থাকেন। তবে ধর্মান্তরিত সাঁওতালরা গীর্জা থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে সনাতনী নিয়ম-রীতি পালন করেন।
ম্রো
ম্রোদের স্বগোত্রের মধ্যে বিয়ে নিষিদ্ধ। তবে অন্যান্য উপজাতির কোনো ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক কদাচিৎ ঘটে থাকে। ম্রো সমাজে দুই প্রকার বিয়ে প্রচলিত:
১. ছেলে-মেয়ের পালিয়ে বিয়ে
২. আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিয়ে
বিয়ের সময় স্বামী কিছু জিনিসপত্র দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে আসেন, স্ত্রীকেও তাঁর বাপের বাড়ি থেকে গয়নাপাতি দিয়ে বিবাহ দেয়া হয়, এবং ম্রো সমাজ পিতৃতান্ত্রিক বলে স্ত্রীকে স্বামীর বাড়ি গিয়ে উঠতে হয়। কোনো কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে স্বামীর দেয়া সব জিনিসপত্র ফেরত পান তিনি, তেমনি স্ত্রীর গয়নাপাতিও বাবার বাড়িতে ফেরত নিতে পারেন। নারীদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ে দেখা না গেলেও স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী নতুন বিয়ে করতে পারেন। ম্রো সমাজে বহুবিবাহ বা বহুস্বামী গ্রহণের কথা জানা যায় না, বাল্যবিবাহও সচরাচর ঘটে না।
হিজড়াদের বিয়ে
হিজড়ারা সাধারণত বিয়ে করতে পারেন না, কারণ তারা নপুংশক থাকেন। তবে অপারেশনের মাধ্যমে যেসকল হিজড়াকে নারী বানানো সম্ভব হয়, তারা সম্পূর্ণ নারী হলেও গর্ভধারণে অক্ষম বলে সন্তানহীন ক্লেষাচ্ছাদিত বিবাহিত জীবনের চেয়ে অবিবাহিত থাকাটাই পছন্দ করেন।
বাংলাদেশের আইনে বিবাহ
বাংলাদেশের সংবিধান ও আইনের দৃষ্টিতে প্রত্যেক সাবালক নাগরিকের বিয়ে করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। আইন অনুযায়ী বিয়ের জন্য বিয়ের সাবালকত্য ধরা হয় পুরুষের জন্য নিম্নে ২১ বছর, আর নারীর জন্য নিম্নে ১৮ বছর। এর কম বয়সে বিয়ে করাকে আইনী সমর্থন দেয়া হয় না এবং তা “বাল্যবিবাহ” হিসেবে পরিগণিত হয়। ক্ষেত্রবিশেষে বাল্যবিবাহ আইনত অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হয়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ সংক্রান্ত প্রচলিত আইনটি হলো “বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইন ১৯২৯”, যেখানে এজাতীয় বিয়ে সংঘটিত হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে ইউপি চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে। ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অফ হিউমান রাইটসের ১৬(এ) অনুচ্ছেদের বিধানমতে, বিয়ে ও বিয়ে বিচ্ছেদ নারী ও পুরুষের একটি অধিকার৷
মুসলিম আইন
বাংলাদেশে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন, ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইন প্রভৃতি আইনের সমন্বিত নিয়ম-ধারার অধীনে মুসলমান সমাজে আইনী বিয়ে ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। অবশ্য এই যাবতীয় আইনই ইসলামী শরীআতের অন্তর্বর্তি এমনটা বলা যায় না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াহ পরিপন্থি অনেক বিধানও এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ে একটি ধর্মীয় দায়িত্বই কেবল নয়, একটি দেওয়ানী চুক্তিও। এই আইন অনুসারে একটি পূর্ণাঙ্গ বিয়ের জন্য কতিপয় শর্ত পূরণ করতে হয়:
* উভয়পক্ষের ন্যুনতম বয়স
* পারস্পরিক সম্মতি
* দেনমোহর
* সুস্থ মস্তিষ্কের প্রাপ্তবয়স্ক ২ জন সাক্ষী
* আইনী নিবন্ধন
এই শর্তানুসারে বরের বয়স কমপক্ষে ২১ এবং কনের বয়স কমপক্ষে ১৮ হওয়া বাধ্যতামূলক। এছাড়া বর-কনেকে সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে। অতঃপর নারী ও পুরুষকে ইসলামী বিধান অনুসারে উভয়পক্ষের সাক্ষীর সামনে একজন উকিল বা কাজি’র উপস্থিতিতে সম্মতি জানাতে হয় (মুসলিম আইন ও ইসলামী শরীয়াতে কনের প্ররোচনাহীন স্বেচ্ছা-সম্মতি বাধ্যতামূলক)। দুজন সুস্থ মস্তিষ্কের প্রাপ্তবয়স্ক সাক্ষী উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক এবং একজন পুরুষের সাক্ষ্য দুজন নারী সাক্ষ্যের সমান নয়। একজন নারীকে বিয়ে করতে হলে “দেনমোহর” দেয়া বাধ্যতামূলক। দেনমোহর হলো একটি আর্থিক নিশ্চয়তা (কিছু পরিমাণ অর্থ কিংবা সম্পত্তি), যার বিনিময়ে একজন নারী তার বিবাহিত পুরুষ সঙ্গীর জন্য হালাল বা সিদ্ধ হোন।
ইসলাম ধর্মমতানুসারে এই দেনমোহর সম্পূর্ণ আদায় করে দিতে হয়, দেনমোহর মাফ হয় না। মুসলিম আইন অনুসারে বিয়ের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক এবং এই দায়িত্ব পুরুষের। এই দায়িত্বের অন্যথায় ২ বছর পর্যন্ত বর্ধনযোগ্য মেয়াদের বিনা শ্রম কারাবাস, বা ৩,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। একজন বিবাহিত নারী তার স্বামীর সেবা এবং আনুগত্য করবেন, আর বিবাহিত পুরুষ তার স্ত্রীর সম্পূর্ণ দেখভাল করবেন, যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবেন এবং স্ত্রীর সুখ-শান্তি নিশ্চিত করবেন।
ইসলামে, পুরুষ এবং নারী উভয়েই পরষ্পরকে তালাক দেবার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন, তবে এজন্য বিয়ের সময় কাবিননামায় তালাকে তাওফিজ-এর ক্ষমতা স্ত্রীকে দিতে হয়। তালাক দেবার জন্য মুখে “তালাক” শব্দটি উচ্চারণ করাই যথেষ্ট হলেও আইনীভাবে তা স্বীকৃত হয় না, বিধায় তার লিখিত চুক্তির বিধান রয়েছে। কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে একত্রে কিংবা বিভিন্ন সময়ে তিনটি তালাক দিয়ে দিলে সেই স্ত্রী তার জন্য হারাম বা নিষিদ্ধ হয়ে যান এবং স্বামীকে যাবতীয় দেনমোহর আদায় করে দিতে হয়। অবশ্য ঐ নারী যদি অন্যত্র বিয়ে করেন এবং সহবাসের পর এই নতুন স্বামী যদি স্বেচ্ছায় তালাক দেন বা মৃত্যুবরণ করেন, তাহলেই শুধু তিনি পূর্ববর্তি স্বামীর সাথে পুণরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে যদি এভাবে বিয়ে দেয়া হয় তাহলে তাকে “হিলা বিয়ে” (আঞ্চলিকভাবে কোথাও “হিল্লা বিয়ে”) বলা হয়। মুসলিম আইনে খানিকটা ছাড় থাকলেও ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী তালাক একটি ঘৃণিত কাজ এবং তা যেন না হয়, সেব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন অপরিহার্য। এজন্য শরীয়াতে তিন মাসে তিনবার তালাক দেবার বিধান রাখা হয়েছে, যাতে অন্তর্বর্তি সময়ে উভয়ে, প্রয়োজনে মীমাংসা করে নিতে পারেন।
হিন্দু আইন
হিন্দুশাস্ত্রমতে, বিয়ে শুধুই চুক্তি নয়, বরং একটি ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা। হিন্দু আইন মূলত হিন্দু ধর্মশাস্ত্রেরই প্রতিরূপায়ন। শাস্ত্রানুযায়ী পুরুষদের অবশ্য পালনীয় ১০টি ধর্মীয় কর্তব্যের (Ten sacraments) অন্যতম হলো বিয়ে। হিন্দু আইনের দৃষ্টিতে বিয়ে হলো, ধর্মীয় কর্তব্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র মিলন। হিন্দু বিয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়া, কেননা শাস্ত্রানুযায়ী পুত্রসন্তানই বংশের ধারা বজায় রাখতে ও পিণ্ড দান করতে পারে। হিন্দু আইনানুযায়ী কনের বাবা-মা বরের হাতে কনেকে সম্পূর্ণভাবে ন্যস্ত করেন। সনাতন হিন্দু আইনে কনের সম্মতি কিংবা অসম্মতি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয় না এবং বিবাহ-বিচ্ছেদ ও পূণর্বিবাহ স্বীকৃত নয়, এমনকি ধর্ম পরিবর্তন, বর্ণচ্যুতি, ব্যাভিচার কিংবা বেশ্যাবৃত্তিও বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে না।
হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী যেহেতু বিয়ে কোনো চুক্তি নয়, তাই বিয়ের জন্য সাবালকত্ব বিবেচিত হয় না- এই নিয়ম সনাতন হিন্দু আইনে অনুসৃত এবং বাংলাদেশী হিন্দুগণ এই আইন মেনে চলেন। হিন্দু আইনে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের কোনো বিধান নেই। হিন্দু আইন অনুযায়ী একজন নপুংসকও বিয়ে করতে পারে। বাংলাদেশের হিন্দু আইনে বর্ণপ্রথা রয়েছে অর্থাৎ আইনগতভাবে বর-কনেকে অবশ্যই সমগোত্রীয় হতে হবে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশে হিন্দু আইনে ‘বিধবা বিবাহ’ আইনসম্মতভাবে স্বীকৃত, তবে বাস্তবে এর প্রয়োগ সচরাচর দেখা যায় না।
হিন্দু আইনানুযায়ী স্ত্রীর, স্বামীর প্রতি অনুগত থাকতে হবে, আর স্বামীকে তার স্ত্রীর সঙ্গে বাস করতে ও ভরণপোষণ দিতে হবে। বাংলাদেশের হিন্দু নারীরা ‘হিন্দু ম্যারিড উইমেনস রাইট টু সেপারেট রেসিডেন্স অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স অ্যাক্ট ১৯৪৬’ অনুযায়ী কিছু কিছু ক্ষেত্রে পৃথকভা বসবাস করার ও ভরণপোষণ পাবার অধিকার পান, যেমন: যদি স্বামী কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন এবং ঐ রোগ স্ত্রীর দ্বারা সংক্রমিত না হয়ে থাকে, কিংবা যদি স্বামী তার স্ত্রীর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন এবং ঐ খারাপ ব্যবহার এমন হয় যে, তা স্ত্রীর জীবনের প্রতি হুমকিস্বরূপ হয়; কিংবা স্বামী যদি দ্বিতীয় বিয়ে বা পুনরায় বিয়ে করেন; কিংবা স্বামী যদি স্ত্রীকে তার সম্মতি ছাড়া ত্যাগ করেন; কিংবা স্বামী যদি অন্য ধর্ম গ্রহণ করেন অথবা অন্য কোনো আইনগত কারণে স্ত্রী পৃথকভাবে বসবাস ও ভরণপোষণ লাভ করার অধিকারী হন।
বিশেষ বিবাহ আইন
বাংলাদেশে, “বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২” অনুযায়ী বিশেষ বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। যেসকল ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেননি, তাদের মধ্যে এই বিয়ে হতে পারে। এছাড়া যেসকল ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছেন, এই আইনের মাধ্যমে তাদের জন্য বিয়ের বিকল্প একটি ধরণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও যেসকল বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, সেসব সুনির্দিষ্ট বিয়ের বৈধতাও নিশ্চিত করা যায় এই আইন দ্বারা। বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনে বিয়ের একপক্ষ মুসলমান হলে, অপরপক্ষ যদি মুসলমান হতে রাজি হয়, তাহলে তা বৈধ বিয়ে; কিন্তু অপরপক্ষ মুসলমান হেত অস্বীকৃত হলে তা “অনিয়মিত বিয়ে”। খ্রিস্টান আইনেও একই বিধান রাখা হয়েছে। এসকল বিয়েকে বৈধতা দেয়া হয় বিশেষ বিবাহ আইন অনুসারে, তবে এই আইন অনুসারে উভয় পক্ষকেই স্বীয় ধর্ম ত্যাগ করতে হয় এবং তা বাধ্যতামূলক। এক্ষেত্রে এই আইনের অধীনে বিয়ে হলে [“জাতিগত অসামর্থ্যতা দূরীকরণ আইন, ১৮৫০” অনুসারে] হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো পরিবারের উক্ত সদস্য স্বীয় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন বলে গণ্য হবেন।
অপসংস্কৃতি
“অপসংস্কৃতি” শব্দটি মূলত আপেক্ষিক। তবুও বিয়ের ক্ষেত্রে যে সংস্কৃতি সমাজ-রাষ্ট্র, কিংবা বর বা কনে যেকোনো এক পক্ষের জন্য কল্যাণকর নয়, সেসকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডকে অপসংস্কৃতি আখ্যা দেয়া হচ্ছে। যেমন: বাংলাদেশের কতিপয় অঞ্চলে প্রবাসী বর বা কনের সাথে বিয়ে দেয়ার একটি রীতি প্রচলিত। এছাড়াও কোনো কোনো সমাজে ব্যবসায়ী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার প্রভৃতি পাত্রের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তড়িঘড়ি করা হয়। সাধারণত প্রবাসী পাত্র/কন্যা; ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী পাত্রের খোঁজ পেলে অপরপক্ষ অনেকসময় মেয়েকে বলপূর্বক বিয়ে দেয়া হয়। এশিয়ার অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে বহির্দেশে ইমিগ্র্যান্ট পাত্রীর সাথে ছেলের বিয়ে দেয়ার একটি প্রচলন রয়েছে, যার মূল উদ্দেশ্য থাকে মেয়ের মাধ্যমে ছেলেকে ঐ দেশটির স্থায়ী বাসিন্দা করানো, বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি। কখনও কখনও এজাতীয় বিয়েতে বহির্দেশে ইমিগ্র্যান্ট মেয়ের আপত্তি থাকলেও তাকে জবরদস্তিমূলক রাজি করানো হয়। কখনও ঘটে চরম অপ্রীতিকর ঘটনা, এমনকি মেয়েকে জিম্মি করে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। তাই এজাতীয় অঘটন রোধে ব্রিটেন সরকার আইন পর্যন্ত তৈরি এবং ব্যবহার করেছে। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটেনের “ফরেন এ্যান্ড কমনওয়েল্থ অফিস”-এর “ফোর্স ম্যারেজ ইউনিট”-এ আসা জবরদস্তিমূলক বিয়ের ১৩০০ অভিযোগের অন্তত ১০%-ই ছিল বাংলাদেশী-ঘটিত ঘটনা।
এছাড়াও আছে “প্রতারণামূলক বিয়ে”। প্রতারণামূলক বিয়ের ক্ষেত্রে হয়তো বহির্দেশ-ইমিগ্র্যান্ট প্রতিবন্ধি ছেলে/মেয়ের জন্য মিথ্যে কথা বলে বর-কনে নিয়ে যাওয়া হয়, কিংবা বহির্দেশ সম্বন্ধে উচ্চধারণা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে মেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে যাওয়া হয় বহির্দেশস্থ কোনো নীচ জীবনে। সাধারণত বহির্দেশে বেড়ে ওঠা অভিবাসীদের দ্বিতীয় প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদেরকে ছুটি কাটানোর নাম করে বাংলাদেশে এনে এজাতীয় জবরদস্তিমূলক কিংবা প্রতারণামূলক বিয়ে দেয়া হয়। তবে প্রতারণামূলক বিয়েতে কোনোপ্রকারের সৎ উদ্দেশ্য না থাকলেও জবরদস্তিমূলক বিয়েতে অভিভাবকদের মনে যে সৎ উদ্দেশ্যটি কাজ করে তা হলো: বহির্দেশে বেড়ে ওঠা সন্তানাদিকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি-ঘেঁষা রাখার অভিপ্রায়। কিন্তু বাংলাদেশ আর বহির্বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংস্কৃতিতে যে বিস্তর ফারাক, তাতে এজাতীয় বিয়ে খুব কমই টিকে থাকে।
আরো একপ্রকারের বিয়ের ঘটনা ইদানিং দেখা যাচ্ছে, যেসব বিয়ের মূল উদ্দেশ্য হয় বহির্দেশে পাড়ি জমানো। এজাতীয় বিয়েকে “চুক্তিভিত্তিক বিয়ে” বলা যেতে পারে। এরকম বিয়ের ক্ষেত্রে বহির্দেশস্থ কোনো নারী কিংবা পুরুষের সাথে রেজিস্ট্রি করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি। অনেক ক্ষেত্রে বিবাহিত ব্যক্তি, স্ত্রী’র অসম্মতি কিংবা অনেক ক্ষেত্রে স্ত্রী’র সম্মতিতেও এমন চুক্তিভিত্তিক বিয়ে করে থাকেন। চুক্তির অংশ হিসেবে বহির্দেশস্থ ঐ নারী কিংবা পুরুষ একটা নির্দিষ্ট অংকের অর্থ পান এবং তার বিনিময়ে যার সাথে বিয়ে হয়েছে, তাকে বহির্দেশে যাবার প্রয়োজনীয় দলিলাদি তৈরিতে সহায়তা করেন। এজাতীয় বিয়েতে দৈহিক সম্পর্কের ঘটনা প্রায় থাকেই না। যদিও এজাতীয় বিয়েতে উভয়পক্ষ সন্তুষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে, তবুও এজাতীয় বিয়ের চুক্তির অন্যথা হলেই তা আর শুভ সমাপ্তি টানেনা বলে সমাজের দৃষ্টিতে তা অপসংস্কৃতিই বলা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাল্যবিবাহ একটি সাধারণ ব্যাধি। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী নারীদের বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর হলেও ৭৫% নারীর বিয়ে হয় ১৫-১৯ বছর বয়সে। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রাজশাহীর তিনটি বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্যমতে ১ বছরে (নভেম্বর ২০১০-নভেম্বর ২০১১) সেখানকার তিন উপজেলায় ৬১২টি বাল্যবিবাহ অনুষ্ঠিত হয়েছে: চারঘাট উপজেলায় ১০০টির বেশি, পুঠিয়া উপজেলায় ৪৮৩টি এবং বাঘা উপজেলায় ২৯টি। এছাড়াও অনেক জায়গায়, ইসলাম সম্পর্কে হীনজ্ঞানীদের হস্তক্ষেপে শাস্ত্রীয় “হিলা বিয়ে”কে ভুল পথে চালিত করে নারীদের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়, যা চরম অবমাণনাকর এবং ভ্রান্তিমূলক।
বিচিত্র বিয়ে
বাংলাদেশে, মানুষ ছাড়াও পশু-পাখি কিংবা গাছের বিয়ে দেয়ার রীতি খুব প্রাচীন নয়। ২০০৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে এরকমই বিচিত্র এক বিয়ের আয়োজন করা হয় উত্তরবঙ্গে। বিয়েটি ছিল ব্যাঙের। বিয়ের বর-কনে দুজনই ব্যাঙ। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড তাপে জর্জরিত গ্রামবাসী বৃষ্টির আশায় ব্যাঙের বিয়ের আয়োজন করে। ঐ অনুষ্ঠানের বর-কনে উভয়ের জন্য ছিল বিশেষ ধরণের পোষাক। বিয়ের পর্ব শেষ হলে বর-কনেকে ছেড়ে দেয়া হয় নিকটবর্তি পুকুরে। সেদিন রাতেই সে অঞ্চলে বৃষ্টি হয়। সাধারণত ভারতে হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের কতিপয় এজাতীয় বিয়ের আয়োজন করে থাকেন প্রায়ই। বাংলাদেশে, ছড়া-কবিতায় ব্যাঙের বিয়ের উল্লেখ থাকলেও এজাতীয় ঘটনা ছিল এটাই প্রথম।
জনপ্রিয় মাধ্যমে বাংলাদেশের বিয়ে
বাংলাদেশের সংস্কৃতির যেহেতু একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বিয়ে, তাই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বিয়ের উল্লেখ একটি সাধারণ বিষয়। যেকোনো গণমাধ্যমেই বাঙালির সাধারণ জীবনযাপনকে ফুটিয়ে তোলা হলে তাতে স্বাভাবিকভাবেই বিয়ের উল্লেখ থাকে। বাংলাদেশের নাটক, সিনেমা কিংবা তথ্যচিত্রেও বিয়ের উল্লেখ এসেছে বহুবার। বিভিন্ন গণমাধ্যম কখনও বিয়ে বিষয়ে আলাদা আয়োজনও রাখে- দৈনিক পত্রিকাগুলো বিয়ের উপর আলোকচিত্র সম্বলিত বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে, ম্যাগাজিনগুলো বিয়ে বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা ছাপায়, ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলো বিয়ে বিষয়ক বিশেষ ব্রাইডাল সংখ্যা প্রকাশ করে। এছাড়াও ইন্টারনেটে বিয়ে বিষয়ক অনেক ওয়েবসাইট রয়েছে, যেগুলো বিয়ের নানাবিধ আয়োজনকে সফল ও সুন্দর করার পরামর্শ দিয়ে থাকে।
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইউনিসেফ প্রকাশিত “Adolescent Girls in Bangladesh” শিরোনামের আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে বাংলাদেশের নারীদের, বিশেষত অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে স্থান পায়।
বাংলাদেশের বিয়ের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক বিদেশী নাগরিকও এদেশের রীতিতে বিয়ের আয়োজন করেন। তবে সেক্ষেত্রে আয়োজন খাঁটি গ্রাম্য রীতিতে হয়ে থাকে।
মন্তব্য চালু নেই