বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কি কেবল ভারত?

বিশ্বকাপ ক্রিকেটে কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ কি কেবলই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারত? আপাতদৃষ্টিতে তেমন মনে হলেও বাংলাদেশকে কিন্তু অনেক প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করতে হবে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট এমন এক মঞ্চ, যার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অনেক রহস্য, অনেক লুকোচুরি, অনেক হিসাবের খেলা। আর এখন তো বিশ্বকাপে লাগামহীন অর্থের ছড়াছড়ি। অর্থের উৎস যেখানে অফুরন্ত, সেই সূত্র তো কোনো নাদানও বন্ধ করতে চাইবে না। আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) তো অর্থকড়ি বিষয়টাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ইচ্ছেমতো।

বড় দলগুলোর মর্জিমাফিক চলতে গিয়ে বিপদে ফেলছে ছোট দলগুলোকে। তা ছাড়া যেখানে আছে অর্থের প্রলোভন, সেখানে জড়িয়ে থাকে নানান স্বার্থ, ধূর্ততা ও চালবাজি। যে কারণে বিশ্বকাপ ক্রিকেটেও অনেক কিছু নির্ধারিত হয় পর্দার অন্তরালে। গ্রুপ পর্বে হয়তো এই বিষয়গুলো তেমন গুরুত্ব পায় না। একেবারেই যে পায় না, সেটাও বলা যাবে না। এবার যেমন ভারত পেয়েছে ভেন্যু সুবিধা। অস্ট্রেলিয়ায় খেলেছে টানা চার ম্যাচ এবং পরবর্তী দুই ম্যাচ নিউজিল্যান্ডে। বাংলাদেশের মতো অর্থনৈতিকভাবে অনুজ্জ্বল দলগুলোকে যখন এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে ছোটাছুটি করে ক্লান্ত হতে হয়েছে, ভারতীয় দলকে তখন ভেন্যু নিয়ে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। তবে এই কৌশল, চাতুর্যতা ও সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচ অনেক বেশি দেখা যায় গ্রুপ পর্বের খেলা শেষ হওয়ার পর। যে সব দল আইসিসির হিসাবের খাতায় গুরত্ব পায় না, সে দলগুলো কোনোভাবে গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করতে পারলেও চারপাশের নেপথ্যের ছলাকলার সঙ্গে পেরে উঠা সহজ নয়। সময় মতো একটি চালেই মাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এমন কঠিন প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও বাংলাদেশের মতো দলকে মুখোমুখি হতে হবে বিভিন্ন প্রতিপক্ষের। প্রথমত, বাংলাদেশ কখনো কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেনি। এ রকম একটা অভিজ্ঞতা ভড়কে দিলেও দিতে পারে। এ ম্যাচে জিতলে সেমি-ফাইনালে খেলবে বাংলাদেশ! দূর থেকে এমনটি কল্পনা করলে কি কেমন কেমন লাগে না? এটা কি চাপ তৈরী করবে না? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যে কোয়ার্টার ফাইনালে খেলবে, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশীরা বোধকরি একদমই ভাবতে পারেননি। এ কারণে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচের টিকিট সংগ্রহের ব্যাপারে তাদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। যে জন্য ৯০ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বাংলাদেশের সমর্থকদের উপস্থিতি খুব একটা থাকবে না। এ মাঠে সে দিন উপস্থিত থাকবেন প্রায় ৮০ হাজার ভারতীয় সমর্থক। অনেকটা হোম গ্রাউন্ডে খেলার অনুভূতি হবে ভারতের। এটাও তো বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়াবে বড় প্রতিপক্ষ। তৃতীয়ত, আইসিসি’র কাছে ভারত তো সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস।কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মতো একটি দল বিদায় নেবে, এটা কি আইসিসি সহজে মেনে নিতে পারবে? ভারতকে সেমি-ফাইনালে নেওয়ার ব্যাপারে তাদের পক্ষ থেকে কোনো কার্পণ্য থাকবে বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো পুঁচকে একটা দেশকে উড়িয়ে দিতে বড় কোনো চালাকিরও প্রয়োজন হবে না। তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা মুশকিল, তারপরও এই বিষয়গুলো বাংলাদেশ দলকে হিসাবে রাখতে হবে। টিম ম্যানেজমেন্টকে এ ব্যাপারে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। থাকতে হবে সতর্ক। তবে এটাও ঠিক, মাঠের খেলাটাই হলো আসল। এ কথা তো বলার অবকাশ রাখে না, বাংলাদেশ দলকে খেলায় প্রাপ্ত সুযোগগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে। ‘ডিসিশন রিভিউ সিস্টেম’ অর্থাৎ ডিআরএস-এর যেন অপচয় না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। নিশ্চিত হয়ে যদি ডিআরএস নেওয়া হয়, তাহলে আম্পায়ার ভুল সিদ্ধান্ত দিলেও কোনো সমস্যা হবে না। এটা হতে পারে তুরুপের তাস। ভারতের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিপক্ষে জিততে হলে চোখ-কান-নাক খোলা রাখতে হবে। সামান্যতম ভুল করার সুযোগ নেই।

02

তারমানে এই নয় যে, ভারতের সঙ্গে ম্যাচে বাংলাদেশই ফেভারিট। সেটা কেউ বলবে না। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এটা শুধু এই অধমের কথা নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি সুনীল গাভাস্কার, সৌরভ গাঙ্গুলিসহ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অনেক ব্যক্তিত্বই বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশকে নিয়ে যে ভারতীয়রা খুব একটা স্বস্তিতে নেই, সেটাও বেশ ভালভাবেই অনুধাবন করা যাচ্ছে। বিশ্বকাপে অতীতেও বাংলাদেশ অনেক ম্যাচ জিতেছে, কিন্তু এবারের দলের মতো আত্মবিশ্বাসী আর কখনো দেখা যায়নি। টিম স্পিরিটের পাশাপাশি প্রত্যেক ক্রিকেটারের শরীরী ভাষায় যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ। কাউকে পরোয়া করছেন না। এমনভাবে খেলছেন যেন মনে হচ্ছে, এটাই তো স্বাভাবিক। স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডকে যেভাবে হারিয়েছে এবং নিউজিল্যান্ডকে যেভাবে চেপে ধরেছিল, তাতে দেখতে পাওয়া গেছে লড়াকু অন্য এক বাংলাদেশকে। তবে আমার কেন জানি মনে হয়, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জিততে চাইলে বাংলাদেশ জিততে পারত। টাইগাররা পুরো অ্যাফোর্ড দিয়ে খেলেনি। এ কারণে ম্যাচ নিয়ে করা হয় অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। দক্ষিণ আফ্রিকার তুলনায় ভারতকেই হয়তো মনে হয়েছে সহজ প্রতিপক্ষ। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটা যদি বাঁচা-মরার লড়াই হতো, তাহলে জয়ী দলের নাম হতে পারতো বাংলাদেশ।

আত্মপ্রত্যয়ী এই বাংলাদেশ দলকে নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী হওয়া যায়। এ আশাবাদের কারণ, পূর্ণ শক্তির বাংলাদেশকে এখনো দেখতে পায়নি ক্রিকেটদুনিয়া। দলের সামগ্রিক যে মনোভাব ও মনোবল, তাতে করে ভারতের সঙ্গে খেলায় টাইগাররা যদি রুদ্র রূপে দেখা দেয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অতীতে দু’দলের ২৮টি ওয়ানডে ম্যাচের যে তিনটিতে বাংলাদেশ জয়ী হয়েছে, সেই জয়ের নায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, নাসির হোসেনরা এখন বড় কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন। সেইসঙ্গে আছেন মাহমুদউল্লাহ, রুবেল হোসেন, সৌম্য সরকার, সাব্বির রহমান, তাসকিন আহমদের মতো পরীক্ষিত সৈনিকরা। বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই দলটির অসম্ভবকে সম্ভব করার শক্তি ও সামর্থ্য দুইই আছে। টাইগাররাও এটা ভালো করে জানেন। বাংলাদেশের ৩০০তম ম্যাচটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে যাওয়ার এরচেয়ে বড় সুযোগ আর হতে পারে না।

01

ইংরেজিতে ‘ল অব এভারেজ’বলে একটা কথা আছে। নিয়তির ওপর নির্ভরশীল এমন কথার অবশ্য সব সময় প্রতিফলন ঘটে না। তবে কখনো-সখনো ঘটে যায়। এখন মনে হচ্ছে, তেমন কিছু ঘটারও একটা প্রেক্ষাপট বোধকরি তৈরী হয়েছে। টানা ৬ ম্যাচ জিতে অপরাজিত আছে ভারত। তা ছাড়া এই দলটিকে এখনো বড় কোনো পরীক্ষা তেমনভাবে দিতে হয়নি। একেবারে পরীক্ষা ছাড়া বিশ্বকাপের মতো আসরে বড় কিছু করার খুব বেশি দৃষ্টান্তও নেই। ভারতীয় দলের পরীক্ষার সেই দিনটি তো বাংলাদেশের সঙ্গে হতেই পারে বলেই মনে হচ্ছে। বাদবাকি ইচ্ছে ক্রিকেট বিধাতার।



মন্তব্য চালু নেই