বাঁধনের মতো চাপা পড়বে এবারের যৌন নিপীড়নও?
যৌন হয়রানি প্রতিরোধে গত ১৫ বছরে হাইকোর্ট বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় বাঁধন যেভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। ঘটনা ঘটলে কিছুদিন তোলপাড় চলে; তারপর চাপা পড়ে যায়। এবারের বাংলা নববর্ষের দিন একই এলাকায় কয়েকজন নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ায় বিষয়টি আবারও আলোচনায় এসেছে।
বাঁধনের ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশনা
খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপন করতে গিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে বাঁধন নামের এক তরুণী টিএসসি এলাকায় যৌন নিপীড়নের শিকার হন। গণমাধ্যমে ওই তরুণীর ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আলোচনার ঝড় ওঠে। হাইকোর্ট রুল দেন।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) ২০০০ সালের ১৮ জানুয়ারি জনস্বার্থমূলক একটি রিট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৬ সালের ২৩ মে ঢাকা সিটি বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো নারী যাতে যৌন হয়রানির শিকার না হন, অসামাজিক কাজ যাতে না ঘটে; সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জ্যেষ্ঠ প্রক্টোরিয়াল কমিটির সদস্যদের নিয়ে অপরাধ প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ জানানোর জন্য থানায় ২৪ ঘণ্টা হটলাইন নম্বর চালু করারও কথা ছিল। প্রতিটি কমিউনিটি এলাকায় পুলিশের টহল বাড়াতে বলা হয়েছিল। নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, সরকারের উচিত সব থানায় স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার ও সচেতন নাগরিকদের নিয়ে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক কমিটি গঠন করা। পুলিশের মধ্যে একটি ন্যায়পালের পদ তৈরি করা।
হাইকোর্টের আরও কিছু নির্দেশনা
বিএনডব্লিউএলএ ২০০৮ সালের ৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কর্মস্থলে নারী ও শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানির প্রতিরোধের দিক নির্দেশনা চেয়ে আরেকটি রিট করে।
২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি, বেসরকারিসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দেওয়া নির্দেশনাটি সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ-যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বাধ্যতামূলক কার্যকরতা সম্পর্কে বলা হয়েছে সে অনুযায়ী কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। ২০১০ সালে বিএনডব্লিউএলএ আরও একটি রিট করে। পরে ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দেন তাতে প্রতিটি থানায় যৌন হয়রানি সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্য পৃথক সেল গঠন এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থানে যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ থাকে, সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়।
এবারের যৌন নিপীড়নের ঘটনায়ও রুল এবারের নববর্ষের ঘটনায় ১৬ এপ্রিল হাইকোর্ট রুল দেন। স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার, পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার, শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
বাস্তবায়িত হয়নি নির্দেশনা
হাইকোর্ট একাধিকবার নির্দেশনা দিলেও তা আলোর মুখ দেখেনি বলে জানালেন বিএনডব্লিউএলএর নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী। তাঁর নেতৃত্বে তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা করে যৌন হয়রানিমুক্ত শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ তৈরিতে হাইকোর্টের নীতিমালার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিভিন্ন সময়ের সেই সব নির্দেশনা বাস্তবায়নে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে তা দ্রুত লিখিত আকারে জানাতে হবে। অন্যথায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে সংস্থাটি।
এ ব্যাপারে সালমা আলী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাইকোর্টের নির্দেশনাগুলোর কথা শুনেছেন। এগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা চেয়েছেন।
বদল হয়নি দৃষ্টিভঙ্গি
নারী ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিরা বলছেন, বাঁধনের সময় বলা হয়েছিল, তিনি এত রাতে বাইরে কেন থাকলেন? তাঁর পোশাকটি শালীন ছিল না। এবারও প্রশাসন যৌন নিপীড়নের ঘটনাটিকে হালকা করে দেখার চেষ্টা করছে।
বলা হচ্ছে, নববর্ষের ভিড়ের মধ্যে যেটুকু ঘটনা ঘটেছে তাকে যৌন নিপীড়ন বলা যাবে কি না? যে নারীদের বেলায় ঘটনা ঘটেছে তারা বিষয়টিকে নিপীড়ন হিসেবে দেখছে কি না? অথচ ২০০৯ সালেই হাইকোর্ট এক নির্দেশনায় যৌন হয়রানির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন। জাতিসংঘের সিডও (নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সদন) কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান বলেন, নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটেনি। যৌন হয়রানির পুনরাবৃত্তি ঘটেই চলেছে। ঘটনা যাতে না ঘটে বা ঘটনাটি কেন ঘটল, লিঙ্গ সমতা বা লিঙ্গ অসমতার গভীরে যাওয়া হয় না। তাই দিবালোকে পয়লা বৈশাখের উৎসবে অসংখ্য লোকের সামনে নারী ও শিশু নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে।
প্রশাসনের উদাসীনতা
বাঁধনের ঘটনার পর অভিযোগ উঠেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ দায়িত্ব পালন করেনি। এবারও একই ধরনের অভিযোগ উঠেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে নিপীড়নকারীদের ঠেকাতে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দীর হাত ভেঙেছে। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ ও প্রক্টরকে ঘটনা জানানো হলেও তারা কেউ যথাসময়ে ব্যবস্থা নেয়নি। ৬৮টি নারী, মানবাধিকার ও উন্নয়ন সংগঠনের মোর্চা সামাজিক প্রতিরোধ কমিটির কয়েকজন প্রতিনিধি বর্ষবরণের দিন যৌন নিপীড়নের ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। স্মারকলিপিতে জননিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও তাদের দায়িত্বহীন বক্তব্য বর্তমানে হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। প্রথম আলো
মন্তব্য চালু নেই