বলিউডের ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
মুক্তবাজার অর্থনীতির এ যুগে মুক্ত আকাশ সংস্কৃতি আর বাজার দখলের লড়াইতে ভারতীয় পণ্য ও সংস্কৃতির আগ্রাসনের শিকার এ বদ্বীপ ভূমির সৃষ্টির লগ্নটা অনেকাংশেই ভারতের প্রতি ধন্যবাদে অবনত। বিশেষ করে যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ অনেকটাই সহজতর করে দেয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রামের বিষয়টিকে।
ষাটের দশক থেকে একাত্তর পর্যন্ত পর্যায়ক্রমিক যে কয়েকটি যুদ্ধ হয় পাক-ভারত সীমান্তে তাদের অনেকই বিষয় করে বেশ কয়েকটা ছবি হয়েছে বলিউডি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। আর সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও স্থান পেয়েছে বেশ কয়েকটি ছবির মূল বিষয়বস্তু হিসেবে। কেবল মুক্তিযুদ্ধের সময়কে কেন্দ্র করে নয়, পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সে সময়ের নানা গল্প।
তৎকালীন ইন্দো-পাক ভারত যুদ্ধনির্ভর প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে বেশ সফল ছবি নির্মাণ করা হয়েছে। জেপি দত্তের বর্ডারের মতো বিশাল বাজেটের ছবি যেখানে মূল ঘটনাই ছিল যুদ্ধক্ষেত্র আর সেখানে পরিবার-পরিজন ফেলে ছুটে যাওয়া ভারতীয় জওয়ানদের জীবন বিসর্জন করার গল্প।
অন্যদিকে কিছু দুর্লভ ফুটেজ আর বঙ্গবন্ধুর চিত্রায়ণের মাধ্যমে ১৯৭১ শিরোনামের ছবির গল্প স্থাপনের শুরুই রয়েছে বাংলাদেশের যুদ্ধের সময়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পরবর্তী সময়ে গল্পটা পাক-ভারত সীমান্ত আর ভারতে পাকিস্তানি গুপ্তচরদের নানা ফন্দি-ফিকিরের দিকে ঝুঁকে সিনেমার কাহিনী। আরও কয়েকটি সফল ছবির মধ্যে যেটির নাম অবলীলায় উঠে সেটির নাম হচ্ছে ‘চিল্ড্রেন অব ওয়্যার’। এটি পরিচালনা করেছেন মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত। বলিউডের সিনেমার ইতিহাসে এটি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধঘেঁষা সিনেমা।
যদিও প্রথমদিকে ‘দ্য বাস্টার্ড চাইল্ড’ নামে পরিচয় হলেও শেষ দিকে বিতর্কের রেশ টানতে নামই পরিবর্তন করতে হয় পরিচালককে। ১৯৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ধর্ষকাম নীতি আর এর নেপথ্যের কুচক্রী ভাবনাকে অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে উঠিয়ে এনেছেন পরিচালক। ছবিটি ট্রেলারের মাধ্যমে আলোচনা তৈরি করলেও শেষ অব্দি ঠিক একটা বাণিজ্যিক সফল হয়নি। তবে এদিক থেকে হতাশা নিমজ্জিত ছবি বলা চলে ‘গুণ্ডে’কে। বাঙালির কাছে মাফ পর্যন্ত চাইতে হয়েছে খোদ আদিত্য চোপড়া আর তার ফিল্ম নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে।
১৯৭১-এর যুদ্ধে শরণার্থী শিবির থেকে পরিবারহারা দুই শিশুর পালিয়ে কলকাতায় গিয়ে আসর জমানোর জমজমাট গল্প নিয়ে ছবির উপজীব্য বিষয় নেহাৎ মন্দ ছিল না; কিন্তু ছবির শুরুর প্রেক্ষাপট নির্মাণকারী নেপথ্য ভাষ্যের ছোট্ট দুটি কথাই পাল্টে দেয় প্রেক্ষাপট। সেখানে বলা হয়, ‘১৯৭১-এর পাক-ভারত ৯ মাসের ভয়ংকর যুদ্ধ। যার পরিণতিতে জন্ম নেয় ছোট্ট এক রাষ্ট্র বাংলাদেশ’।
বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসে ভারত সরকার ও সেনাবাহিনীর অবদান ধন্যবাদের যোগ্য বটে; কিন্তু তাই বলে খোদ বাংলাদেশকে পাক-ভারত যুদ্ধের ফসল হিসেবে মাথা পেতে নেয়াটা সহজভাবে নিতে পারেনি বাংলাদেশের তরুণ সমাজ। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল মুভি ডেটাবেজের ওয়েবসাইটে ওঠে নিন্দার ঝড়।
আলোড়ন তুলতে সক্ষম একটি ছবি রাতারাতি পরিণত হয় বিতর্ক আর তিরস্কারের লক্ষ্যবস্তুতে। শেষ অব্দি মান বাঁচাতে ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় ছবির নির্মাতা। এমনকি মূল ছবিটি তাৎক্ষণিকভাবে বাজার থেকে তুলে নিয়ে সেই নেপথ্য ভাষ্যে পরিবর্তনও আনা হয়। এ ভুলটুকু না করলে হয়তো পুরো উপমহাদেশে অসাধারণ ব্যবসা করে নিতে পারত ছবিটি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আরও বেশ কয়েকটি ছবি নির্মাণের কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে তার কোনো অগ্রগতি আর দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, শেখ মুজিবকে নিয়েও নাকি ছবি বানাতে বেশ আগ্রহী বলিউডের অনেক নির্মাতা। যদিও সব আগ্রহ বাস্তবে কার্যকর হয়নি এখনও। তবে সময়ের অপেক্ষা করছেন অনেকে।
মন্তব্য চালু নেই