বক্তব্য প্রত্যাহারের প্রশ্নই আসে না: বিবিসিকে লতিফ সিদ্দিকী

ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হজ ও সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়ে সদ্য মন্ত্রীসভা থেকে অব্যহতি পাওয়া আবদুল লতিফ সিদ্দিকী জানিয়েছেন, তিনি তার বক্তব্যে অনড়।

মেক্সিকো থেকে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একজন স্বাধীন ও আধুনিক মানুষ হিসেবেই তিনি হজ সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন বলে দাবি করেন।

তবে শুধুমাত্র তার দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেই তিনি তার সম্মানে মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিতে পারেন বলেও জানান এসময়।

চাপের মুখে তার পদত্যাগ করার কোনো প্রশ্নই আসে না জানিয়ে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি কিছুই করবো না। প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দেবেন আমি সেটা প্রতিপালন করবো।

তিনি জানান, তার এই মন্তব্যকে ঘিরে বিভিন্ন দলের নেতারা যেসব কথাবার্তা বলছেন, তার অপসারণের যে দাবি উঠেছে, সেসব বিষয়ে তিনি জানেন।

আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি শুধু আমার বিশ্বাসের কথা বলেছি। এতে কারো কারো আঘাত লাগতে পারে। এবং তারাও আমাকে আঘাত করে মতামত প্রকাশ করছে।

সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তার বক্তব্যের ব্যাপারে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, যা রেকর্ড করা আছে, সেটা ঠিকই আছে। আমি ওই কথার ১০০ ভাগ দায়িত্ব নিচ্ছি।

নিজ বক্তব্যের জন্য অনুতাপ করার কিছু নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্র পরিচালনায় আমাকে কিছু দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি যেটা ভালো মনে করবেন সেটা তিনি করবেন। আমি যদি তার বোঝা হয়ে যাই তাহলে তার বোঝা রাখবেন কেনো?

এসময় আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি ভাবছিলাম মুক্ত পৃথিবীতে আসছি, যেখানে সবাই মুক্ত বিহঙ্গ, কোনো কিছুতেই বাধা নাই। এখানে যে কালো বিড়াল এতো রয়ে গেছে তাতো আমি জানি না।
বিবিসিকে দেওয়া আবদুল লতিফ সিদ্দিকী’র সাক্ষাৎকার হুবহু প্রিয়.কম পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল:

বিবিসি: আপনার সঙ্গে কী প্রধানমন্ত্রীর দলে নিউইয়র্কে যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: না, আমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।

বিবিসি: কথা হয়নি?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: না।

বিবিসি: প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: আমি সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি না। কারণ তিনি আমাকে একটা সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়েছেন। সেই দায়িত্বটা আমি নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে পালনের চেষ্টা করি।

বিবিসি: আপনার বক্তব্য নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা ইতিমধ্যে প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা করছেন-সেটার ব্যাপারে আপনি কী জ্ঞাত?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: হুম, জ্ঞাত।

(এ সময় লতিফ সিদ্দিকীকে নিউইয়র্কে তাঁর দেওয়া বক্তব্য শোনাতে চায় বিবিসি)
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: আমাকে শোনাতে হবে না। যা রেকর্ড করা আছে ওটা ঠিকই আছে। আমি বলেছি।

বিবিসি: তাহলে আপনি দায়িত্ব স্বীকার করছেন?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: আমি ১০০ ভাগ দায়িত্ব নিয়েছি। দায়িত্ব নেব মানে, আমি যা বলব-তার দায়িত্ব নেব না, কে বলল আপনাকে? আমি একজন দায়িত্বশীল লোক।

বিবিসি: আপনি কী সেই বক্তব্য পরে আবারও শুনেছেন?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: আমার শোনার দরকার নেই। আমি শুনতে পারছি যে, জটিলতা…কেউ কেউ … কারও অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে।

বিবিসি: সেটা নিয়ে এখন আপনার অনুভূতি কী, আপনার কী মনে হচ্ছে?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: আমার কোনো অনুভূতি নেই। আমার বিশ্বাসের কথা আমি বলেছি। কারো কারো আঘাত লাগতে পারে। এখন তারাও আমাকে আঘাত করে মতামত প্রকাশ করছে। তাতেও আমি বিরক্ত হচ্ছি না।

বিবিসি: কিন্তু এই মন্তব্যেকে কেন্দ্র করে মন্ত্রিসভা থেকে আপনাকে বিদায় নিতে হতে পারে-এটাই জানবার পরে আপনি কী দুঃখিত বা অনুতপ্ত?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: না, আমার অনুতাপ বা দুঃখের কোনো কারণ নেই। আমার প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাষ্ট্রপরিচালনে তিনি যেটা ভাল মনে করবেন, সেটা করবেন। আমি যদি তাঁর জন্য বোঝা হয়ে যাই, তিনি তাঁর বোঝা রাখবেন কেন?

বিবিসি: আপনার বক্তব্যে যেটা সমালোচনা হয়েছে, আপনার বক্তব্যে ইসলাম ধর্মে যারা বিশ্বাসী তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। আপনি কী এটার সঙ্গে একমত?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: তারা হাজার হাজার কোটি কোটি মানুষ মেরে ফেলতেছে, ওটা করতেছে সেটা করতেছে। তাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। আমি একটা…এই হজ তো মোহাম্মদের (হযরত মোহাম্মদ স.) জন্মের আগেও প্রচলিত ছিল। এটা কী মোহাম্মদ প্রচলন করেছে? আর তাবলিগের তো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তাবলিগের মাধ্যমে আমি মনে করি, ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির করার জন্য একেবারে….ওদিকে হলো সংঘ পরিবার এদিকে তাবলিগ পরিবার। এ নিয়ে এতো কথার দরকারটা কী আছে?

বিবিসি: কিন্তু যারা বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বা তাতে আহত হয়েছেন তারা বলছেন…ইসলাম ধর্মের অন্যতম স্তম্ভকে আপনি আঘাত করেছেন, এ কথা দ্বারা?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: এটা তাদের অধিকার। আমি কাউরে…আমি ইসলাম ধর্মের কোনো স্তম্ভকে আঘাত করি নাই। আমি আমার মতামত প্রকাশ করেছি।

বিবিসি: ইসলাম ধর্মের নবীকে নিয়ে আপনি যে মন্তব্য করেছেন…
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: আমি কোনো কিছুকেই নিয়ে মন্তব্য করি নাই। আমি যা করেছি, আমার বিশ্বাসের কথা বলেছি। আমি ব্যক্তি স্বাধীন হিসেবে, আমি একজন আধুনিক মানুষ হিসাবে, আমার মতামত আমি প্রকাশ করতে পারি। ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য এতো বড় বড় কথা বলা হয়। তাহলে আমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় কেনো হস্তক্ষেপ করা হবে?

বিবিসি: কিন্তু আপনার কী মনে হয় না, ব্যক্তি হিসেবে আপনি যে মন্তব্য করতে পারেন-সরকারের মন্ত্রী হিসেবে সে বক্তব্য বলার ক্ষেত্রে আপনার কিছু বিধি-নিষেধের অধীনে থাকতে হতে পারে?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: হ্যাঁ, বিধি-নিষেধ আছেই। সেটাতো আমি আমার দেশে করি নাই। আমি ভাবছিলাম মুক্ত পৃথিবীতে আসছি, যেখানেই সবাই মুক্ত বিহঙ্গ, এখানে কোনো কিছুতেই বাধা নাই। এখানে যে কালো বিড়াল এতো রয়ে গেছে, তাতো আমি জানি না।

বিবিসি: সুতরাং আপনি কী তাহলে পদত্যাগ করবেন?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: আমিই কিছুই করব না। আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশ দেবেন আমি শুধু তাই প্রতিপালন করব।

বিবিসি: আপনি ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলছেন, বাংলাদেশে অনেকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য শাস্তি হয়েছে…
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: এটা যদি আইনের মধ্যে পড়ে, তাইলে আমার যে শাস্তি হবে, আমি আনন্দের সঙ্গে মেনে নেব।

বিবিসি: কিন্তু আপনি আপনার বক্তব্য প্রত্যাহার করছেন না বা সেখান থেকে সরে আসছেন না?
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী: প্রশ্নই ওঠে না। একমাত্র…এখানে একটা কথা আছে, আমার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার নেতা যদি আমাকে আদেশ করেন যে- আপনি এটা প্রত্যাহার করেন। তাঁর সম্মানে আমি এটা প্রত্যাহার করতে পারি। তা ছাড়া কোনো কিছুতেই আমি প্রত্যাহার করব না।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রীর সাথে জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইর্য়ক সফরকালে গত ২৮ সেপ্টেম্বর একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী বলেন, আমি কিন্তু হজ আর তাবলিগ জামাতের ঘোরতর বিরোধী। আমি জামায়াতে ইসলামীরও বিরোধী। তবে তার চেয়েও হজ ও তাবলিগ জামাতের বেশি বিরোধী। এ হজে যে কত ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়। হজের জন্য ২০ লাখ লোক আজ সৌদি আরবে গিয়েছে। এদের কোনও কাম নাই। এদের কোনও প্রডাকশন নাই। শুধু রিডাকশন দিচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, তাবলিগ জামাত প্রতি বছর ২০ লাখ লোকের জমায়েত করে। নিজেদেরতো কোনও কাজ নেই। সারা দেশের গাড়িঘোড়া তারা বন্ধ করে দেয়।

তিনি তার বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তনয় সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিষয়েও বিরূপ মন্তব্য করেন। তিনি প্রবাসী বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্যে বলেন, কথায় কথায় আপনারা জয়কে টানেন কেন। ‘জয় ভাই’ কে। জয় বাংলাদেশ সরকারের কেউ নয়। তিনি কোন সিদ্ধান্ত নেয়ারও কেউ নন।

প্রবাসীদের সম্পর্কে এসময় তিনি মন্তব্য করেন, বিদেশে এসেছেন কামলা দিতে। রাজনীতি করার দরকার কী?

মঞ্চে বসা টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধা ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ড. নুরুন্নবীকে উদ্দেশ করে মন্ত্রী বলেন, নির্বাচনের জন্য একবার তাঁর (নুরুন্নবী) কাছে চাঁদা চেয়েছিলাম। তিনি ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এক লাখের কম কারও কাছ থেকে চাঁদা নেয় না।

তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা



মন্তব্য চালু নেই