বইয়ের নাম হবে ‘বাংলাদেশে কোথায় মূত্রত্যাগ করা যায়’

ঢাকার মানুষ প্রতিনিয়ত ট্র্যাফিক জ্যামে একেবারে আটকে বসে থাকেন। কেউ নানান ভাবনাচিন্তা করে সময় কাটান, কেউ হালকা ঘুমান, আর কেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিচরণ করে বেড়ান।

আমার মা জ্যামে বসে আমাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠাতেই পছন্দ করেন। ‘এখনো মহাখালিতে আটকা।’ ‘গুলশান থেকে বনানী যেতেই দুইঘণ্টা।’ এমনই সব মেসেজ পাঠান তিনি।

তবে ঢাকার সব বাসযাত্রীর মনে নিশ্চয় একটি কথাই থাকে, বাসে উঠে বসার আগে বাথরুমটা সেরে নিতে হবে। পথে আর কোথাও সে সুযোগ পাওয়া যাবে না যে।

আমি যদি পারতাম, তাহলে একটা বই লিখতাম ‘বাংলাদেশে কোথায় মূত্রত্যাগ করা যায়’। খুবই ছোট কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বই হতে পারতো এটি। ২০১১ সালের একটি গবেষণা বলছে, ১৫ মিলিয়ন জনগোষ্ঠির ঢাকা শহরে গণশৌচাগারের সংখ্যা মাত্র ৬৭। তার মধ্যে আবার অনেকগুলোতে নেই পানি ও বিদ্যুতের সুবিধা।

২০০৫ স্যানিটেশন প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা সিটি কর্পোরেশনে কতোগুলো গণশৌচাগার তৈরি করা হয়েছিলো। সেগুলো লিজ দেওয়া হয়েছিলো ব্যক্তি খাতে। কারণ কর্মসূচির কর্তারা চাইছিলেন এসব শৌচাগারের রক্ষণাবেক্ষণ খরচটা যেনো বাইরের কোনো উৎস থেকেই আসে। পদ্ধতিটি মোটেও ফলপ্রসূ হয়নি। লিজ গ্রহীতারা ওইসব গণশৌচাগারকে পানি বিক্রি এবং গাড়ি পরিস্কার করার ঘর বানিয়ে ফেলেন। কখনো কখনো দেখা গেছে, এসব জায়গা মানুষকে ঘুমানোর জন্য ভাড়াও দেওয়া হয়েছে। মাত্র কয়েকটি গণশৌচাগার অবশিষ্ট থাকলেও সেসব মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।

গণশৌচাগারের এই অপর্যাপ্ততা নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই সমান সমস্যার হলেও পুরুষের তো রাস্তা ব্যবহারের সুবিধা আছে। অনেক পুরুষকে রাস্তার পাশেই পেসাব করতে দেখা যায় যেনো সবগুলো দেয়ালই প্রস্রাব করার জন্য উপযুক্ত জায়গা।

বাংলা হরফে ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’ লেখা সবাই উপেক্ষা করেন। এমনকি ‘জরিমানা দিতে হবে’ এমন কথাও বিকার আনে না তাদের আচরণে।

নৃতত্ত্ববিদ ম্যারি ডগলাস অবশ্য সেটাকেই ময়লা বলেছেন যেটা সঠিক জায়গায় নেই। আমরা কোনটাকে দূষণ হিসেবে নেবো সেটা নির্ভর করে আমরা বিষয়টাকে কিভাবে দেখছি তার উপরই।

তাই বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় এই সমস্যার সমাধানে নতুন পথের খোঁজ করেছে। শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যবহার করেই পরিবর্তন আনতে চেয়েছে তারা।

গ্রে এজেন্সির করা ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ‘ল্যাঙ্গুয়েজ ম্যাটারস’ নামের একটি ভিডিওতে তারা দেখিয়েছে, একই কথা আরবি হরফে লিখে কতোটা পরিবর্তন এসেছে। তাদের যুক্তি, যেটাকে মানুষ পবিত্র হিসেবে বিবেচনা করেন, সেখানে নিশ্চয়ই তারা প্রস্রাব করতে পারবেন না।

বাংলাদেশের খুব কম মানুষই আরবি ভাষা বোঝেন, তারা হয়তো জানেনও না এসব জায়গায় কি লেখা আছে। তবু শুধুমাত্র আরবি অক্ষর আছে বলেই এসব জায়গায় প্রস্রাব করার জন্য নিজেদের দোষী ভেবে তারা সেখানে মূত্রত্যাগ করবেন না এমনটাই ভেবেছে মন্ত্রণালয়।

ধর্মমন্ত্রী ভিডিওটিতে সবাইকে পার্শ্ববর্তী মসজিদের শৌচাগার ব্যবহারের পরামর্শও দিয়েছেন। হয়তো তার ধারণা, এতে দুটি প্রভাব পড়বে: এক. মানুষ রাস্তার পাশে প্রস্রাব করা থেকে বিরত হবেন এবং দুই. মানুষ বেশি বেশি মসজিদে যাবেন।

rW6Qtwo7kObm

হতে পারে বিষয়টা শুধুমাত্র আচরণ পরিবর্তনের একটি সহজতম পন্থা। কিন্তু বাংলাদেশে বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। কেননা দীর্ঘ সময় ধরে ভাষাই হলো বাংলাদেশের জাতীয় পরিচিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ তখনই রোপিত হয়েছিলো যখন ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করেছিলো, বাংলা নয়, উর্দুই হবে (তৎকালীন) পাকিস্তানের ভাষা। এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। বিশ্বাস এবং ভাষা একে অন্যের বিরুদ্ধে জাতীয়তার জন্য লড়ছিলো। সেসময় পাকিস্তানী সেনারা সবাইকে প্রশ্ন করতো, বাঙালী নাকি মুসলিম? যেন বাংলা বলতে পারাটাই বিশ্বাসঘাতকতা।

এখন দেয়ালের আরবি লিখনগুলো আবারো সেই পুরনো বিতর্ককেই হয়তো সামনে টেনে আনলো। কেউ কেউ বলছেন, বাঙালিরা তাদের নিজেদের ভাষার লেখার উপর প্রস্রাব করতে পারেন, কিন্তু আরবি ভাষার উপরে নয়। ধর্মীয় গোঁড়ামির শেকড় যে সময় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, সেসময় এমন ঘটনা রক্ষণশীল ধার্মিকদের জয়োল্লাসকে আরো বাড়িয়েই দেবে।

স্বাভাবিকভাবেই সমালোচনার মুখে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সমালোচকরা বলছেন, অক্ষর অঙ্কনে নয়, বরং আরো বেশি গণশৌচাগার তৈরিতেই বেশি টাকা খরচ করা উচিত সরকারের। একসময় মানুষ হয়তো দেখবেন, ঢাকা শহরের সবগুলো দেয়াল আরবি শব্দে ঢাকা কিন্তু তারপরও মানুষের প্রস্রাব করার মতো কোনো জায়গা নেই।

hAO3bWBlciOq

পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালে ঢাকা ২০ মিলিয়ন মানুষের শহর হবে। শহুরে জনগোষ্ঠি, পোশাকশ্রমিক, রিকশাচালক, দোকানদার; যারা এই শহরকে জীবন্ত রাখে সরকারের উচিত তাদের সব মৌলিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা যেনো তারা মর্যাদার সঙ্গে জীবন যাপন করতে পারেন। গবেষকরা আরো বলছেন, এখন প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন দরিদ্র মানুষ প্রতিদিন পাঁচ থেকে আট ঘণ্টা ঘরের বাইরে কাটান কাজের প্রয়োজনে।

হয়তো আরো অনেক গণশৌচাগার তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু তাতেও নিশ্চয় টয়লেট সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না। ঢাকা শহরে পুরুষরা যে কোনো জায়গায় প্রস্রাব করতে পারেন। আর তারা সেক্ষেত্রে পুরোপুরি মুক্ত, কিন্তু নারীদের মৌলিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত নয় এই শহরে।

দেয়ালে আরবি শব্দ পুরুষকে অন্য কোথাও যেতে বাধ্য করবে তা ঠিক। কিন্তু কেউ হয়তো ভেবেও দেখছেন না, মেয়েরাতো রাস্তাও ব্যবহার করতে পারেন না তাদের প্রয়োজনে। সামাজিক রীতিনীতির মতে পাবলিক প্লেস শুধু পুরুষদের জন্য, নারীদের জন্য নয়। এমনকি মন্ত্রীর প্রস্তাবেও নারীদের জন্য কোনো সমাধান নেই। বাংলাদেশে নারীরা তো মসজিদেও যেতে পারেন না।

রাস্তায় পুরুষের প্রস্রাব বন্ধ করার পাশাপাশি নারীর জন্য সুবিধার অভাব নিয়েও প্রচারণা চালানো উচিত। তা না হলে বলতে হবে, রাস্তাঘাট কেবল পুরুষদের জন্য আর দেয়ালগুলো আরবি শব্দের জন্যই বরাদ্দ।

(লেখাটি ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত এবং ‘স্ট্রেইটস টাইমস’সহ আরো কিছু পত্রিকায় পুন:প্রকাশিত।
অনুবাদ করেছেন: শর্মিলা সিনড্রেলা)

তাহমিমা আনাম: লেখক, নৃতত্ত্ববিদ। ‘এ গোল্ডেন এজ’ উপন্যাসের লেখক।



মন্তব্য চালু নেই