ফেলে যাওয়া চুলই ধরিয়ে দেবে অপরাধীকে!

কান ধরে তো টেনে আনা হয়ই। তারপর পরানো হয় হাতকড়া। আর গা ঢাকা দিয়ে থাকলে ডিএনএ ধরে টেনে বের করতে হয় ‘অজ্ঞাতবাসের অন্ধকার’ থেকে।

অপরাধীদের, সন্দেহভাজনদেরও। সেই কান নয়, ঝুটঝামেলা বেশি বলে সেই ডিএনএ-ও নয়। এবার একেবারে চুল ধরেই টেনে বের করা যাবে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা অপরাধীদের।

এমনকি সন্দেহভাজনদেরও। চুল তো শুধুই মাথায় থাকে না। আমাদের সারা গায়েই রয়েছে চুল। লোম। আর সেটাই ধরিয়ে দেবে অপরাধীদের। এমনটাই বলছেন ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা। তাদের একেবারে সাম্প্রতিককালের গবেষণা এমনটাই জানাচ্ছে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞান-জার্নাল ‘প্লস-ওয়ান’-এ।

ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, চুলের ভেতর থাকা নানা রকমের প্রোটিনই এক জনের চুলকে অন্য জনের চুলের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা করে দেয়। আর কোন দু’টি মানুষের চুলে একই ধরনের প্রোটিন একই পরিমাণে থাকে না। দু’টি মানুষের চুলে যেমন প্রোটিনের হেরফের থাকে, তেমনই তাদের পরিমাণেও থাকে তারতম্য।

একই ধরনের প্রোটিন কারও চুলে কম থাকে, কারও চুলে থাকে বেশি। আবার তৃতীয় কোনও ব্যাক্তির চুলে থাকা প্রোটিনগুলি বা তাদের পরিমাণের সঙ্গে বাকি দু’জনের চুলে থাকা প্রোটিনের ধরন বা পরিমাণ একেবারেই মেলে না। মেলে না সেই প্রোটিনের গঠন-কাঠামোও (মলিকিউলার স্ট্রাকচার)।

ফলে চুলের ভেতরে থাকা প্রোটিনের হেরফেরই এক জনের থেকে আরেক জনকে আলাদা করে দেয়। আর ডিএনএ পরীক্ষার মতোই প্রায় নিখুঁত হতে পারে অপরাধীদের ‘চুল দিয়ে চেনা’র সেই পদ্ধতি।

বিজ্ঞানের সব পদ্ধতিতেই যেমন থাকে, অপরাধী খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে ফরেনসিক বিজ্ঞানের ডিএনএ পরীক্ষাতেও থেকে যায় তেমনই কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির সম্ভাবনা।

শুধু তাই নয়, ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ডিএনএ পরীক্ষার কিছু খামতিও রয়েছে। চুলের প্রোটিনের ফারাক বুঝে অপরাধীদের সনাক্ত করে ফেলা আর খুঁজে বের করার পদ্ধতিটা সে ক্ষেত্রে আরও নির্ভুল হয়ে উঠতে পারে বলে গবেষকদের দাবি। এ খবর দিয়েছে আনন্দবাজার।

ডিএনএ পরীক্ষা করে অপরাধীদের খুঁজে বের করতে গিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় ২০০৯ সালে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল’ নতুন ফরেনসিক পরীক্ষা-পদ্ধতি বের করার কথা ভাবতে শুরু করে। এ ব্যাপারে দ্রুত গবেষণা শেষ করতে বলে ফরেনসিক বিজ্ঞানীদের।

এরই প্রেক্ষিতে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি’র বিশেষজ্ঞ গ্লেন্ডন

পার্কারের নেতৃত্বে গবেষণা শুরু করেন ফরেনসিক বিজ্ঞানীদের একটি দল। সেই গবেষকদলে রয়েছেন এক বাঙালি ফরেনসিক বিজ্ঞানীও। ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক বিজ্ঞানী অনুরাধা বসু।

আমাদের চুলের ভেতরে থাকা বিভিন্ন ধরনের প্রোটিনের জিন-কাঠামোগুলি কী রকম হয় আর সেগুলির মধ্যে ফারাকটা দেখা যায় কোথায় কোথায়, মিউটেশনের (অভিযোজন) জন্য সেই জিন-কাঠামো কতটা বদলে যায় ও কীভাবে তা বদলে যায়, ফরেনসিক বিজ্ঞানীদের ওই দলটি তা খুঁটিয়ে দেখছেন গত ৫/৬ বছর ধরে। আর কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তেই বেরিয়ে পড়ল সাপ! দেখা যায়, চুলের প্রোটিনের নিরিখেই একটি মানুষের থেকে অন্য মানুষটি হয়ে যান একেবারেই আলাদা। স্বতন্ত্র, স্বাধীন।

অনুরাধা বলছেন, ‘‘দু’টি জিনিস একেবারে শুরুতে খুব সহজ করে বুঝে নিতে হবে। এক, চুল দিয়ে অপরাধীদের চেনার পদ্ধতি চালুর সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার জন্য প্রোটিনের ফারাক খুঁজে বের করার প্রক্রিয়াটা রয়েছে এখনও প্রাথমিক পর্যায়েই। ডিএনএ পরীক্ষা-পদ্ধতি চালুর সময়েও এই প্রক্রিয়াটা হয়েছিল।

তাই চুল দিয়ে অপরাধী সনাক্তের পদ্ধতি চালুরও এটাই প্রথম ধাপ। এই প্রথম ধাপটা পার করতে হয়েছিল ডিএনএ পরীক্ষা-পদ্ধতি চালুর ক্ষেত্রেও। দুই, বিশেষজ্ঞদের একাংশের ধারণা, কতটা নিখুঁত, সেই নিরিখে চুলের প্রোটিনের ফারাক বুঝে অপরাধী চেনার ব্যাপারে ডিএনএ পদ্ধতির সঙ্গে তার সমানে সমানে টক্কর দেওয়াটা কিছুটা মুশকিল। তবে ডিএনএ পরীক্ষার পদ্ধতিতে যেখানে কাজ হয় না, সেখানে এই পদ্ধতির বিকল্প হয়ে ওঠার সম্ভাবনা যথেষ্টই।’’

বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অপরাধী খুঁজে বের করার ব্যাপারে ডিএনএ পরীক্ষা-পদ্ধতি কোন কোন ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। সেগুলো কী কী?

অনুরাধার কথায়, ‘‘প্রথমত, ডিএনএ দূষিত জলের ছোঁয়ায় নষ্ট হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, অত্যধিক তাপে নষ্ট হয়ে যায় ডিএনএ। তৃতীয়ত, অত্যধিক আলো বা বিশেষ কয়েকটি আলোকতরঙ্গ ডিএনএ’র ওপর এসে পড়লে তা একটা সময়ে নষ্ট হয়ে যায়। আর চতুর্থত, স্বাভাবিক নিয়মেও ডিএনএ নষ্ট হয়ে যায়।

ওই ৪ ভাবে বা তাদের মধ্যে যে কোন এক রকম ভাবে ডিএনএ নষ্ট হয়ে গেলে, সেই ডিএনএ পরীক্ষা করে অপরাধী সনাক্ত কাজটা ঠিকমতো করা যায় না। সে ক্ষেত্রে চুলের প্রোটিনের তারতম্য বিচার করে অপরাধী সনাক্তের পদ্ধতি অনেকটাই কার্যকর হতে পারে। কারণ, বিভিন্ন রকমের প্রোটিন তৈরি করতে পারে যে সব অ্যামাইনো অ্যাসিড, তাদের গঠন-কাঠামো আর তাদের গঠন-কাঠামোর ফারাকটা চুলের প্রোটিনেই খুব ভালভাবে বুঝতে পারা যায়।’’

আর অপরাধী চেনার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা-পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাগুলো রয়েছে কোথায় কোথায়? সহযোগী গবেষক ব্র্যাডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক বিজ্ঞানী অ্যান্ড্রু উইলসন ই-মেলে জানিয়েছেন, প্রথমত, ডিএনএ-র চেয়ে প্রোটিন অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যায়। আর তা সহজলভ্যও। দ্বিতীয়ত, ডিএনএ-র চেয়ে প্রোটিন অনেক বেশি সময় টেঁকে, এমনকী, অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশেও। তৃতীয়ত, ডিএনএ-র চেয়ে প্রোটিন অনেক বেশি শক্তপোক্ত। ডিএনএ অনেক বেশি ভঙ্গুর।

এখনও পর্যন্ত মূলত জন্মসূত্রে ইউরোপীয় ও আফ্রিকান হয়েও নাগরিকত্বের সূত্রে দীর্ঘ দিন আমেরিকায় রয়েছেন, এমন ৮২ জনের চুলের নমুনা থেকে মোট ১৮৫ রকমের প্রোটিনের সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা। আর সেই ১৮৫ রকমের প্রোটিনের মধ্যে থাকা অ্যামাইনো অ্যাসিডের গঠন-কাঠামো আর তাদের তারতম্য খুঁটিয়ে দেখেছেন তারা। জন্মসূত্রে কয়েকজন কেনিয়ান নাগরিকেরও চুলের প্রোটিন পরীক্ষা করে দেখেছেন গবেষকরা। এমনকি, কবর থেকে মৃত ৬ জনের মাথার চুল তুলে এনেও তারা পরীক্ষা করে দেখেছেন। সেই মৃতদেহগুলো ১৭৫০ সাল থেকে ১৮৫০ সালের মধ্যকার সময়ের।

তবে চুল দিয়ে অপরাধী চেনার পদ্ধতির এখনও কয়েকটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেগুলি কী কী? বাঙালি ফরেনসিক বিজ্ঞানী অনুরাধার কথায়, ‘‘আরও মোটামুটি ৫টি বিষয় আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে। এক, দেখতে হবে চুলের প্রোটিনের মধ্যে থাকা জিনগুলোর অভিযোজন কতটা দ্রুত হতে পারে, কত দ্রুত তাদের গঠন-কাঠামো বদলে যায় বা বদলে যেতে পারে।

দুই, নিশ্চিত হতে হবে আরও বেশি চুলের নমুনার ওপর পরীক্ষা চালিয়ে। এখনও পর্যন্ত চুলের ৮২টি নমুনা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছি আমরা।

তিন, চুলের আরও বিভিন্ন রকমের প্রোটিন নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, যাতে প্রোটিনের তারতম্য আরও ভালভাবে বোঝা যায়।

চার, দেখতে হবে আমরা দু’বেলায় যা খাই, সেই সব খাবারদাবার আর পরিবেশ আমাদের চুলের প্রোটিনের গঠন-কাঠামোকে কতটা বদলে দেয় বা বদলে দিতে পারে।

পাঁচ, আমরা অনেক বেশি সংখ্যায় চুল নিয়ে পরীক্ষাগুলি করেছি। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, অপরাধী কোন অপরাধ করে পালানোর সময় ঘটনাস্থলে বেশি চুল ফেলে উধাও হয়ে যায় না। তাই ঘটনাস্থল থেকে খুব সামান্য পরিমাণে চুল পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও যাতে অপরাধীদের খুঁজে বের করতে কোন অসুবিধা না হয়, গবেষণায় সেই ব্যাপারটিতেও আমাদের সুনিশ্চিত হতে হবে।’



মন্তব্য চালু নেই