ফেলানী হত্যা : দীর্ঘ ৬ বছরেও ন্যায়বিচার পায়নি পরিবার
দেশ-বিদেশের বহুল আলোচিত হত্যাকাণ্ড কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কিশোরী ফেলানী হত্যার ৬ বছর পূর্ণ হলো ৭ জানুয়ারি। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে সীমান্তে অনেক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলেও শুধু ফেলানী হত্যার বিচার শুরু করে ভারত। তবে দীর্ঘ ৬ বছরেও মামলার কার্যক্রম শেষ হয়নি। মামলাটি বিএসএফ’র বিশেষ আদালত গড়িয়ে এখন ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে।
নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ দীর্ঘ ৬ বছর ধরে চললেও এখনও ন্যায় বিচার পায়নি ফেলানীর পরিবার। উপরন্তু, আত্মস্বীকৃত খুনি অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে দু’দুবার নির্দোষ সাব্যস্ত করে বিএসএফ’র বিশেষ আদালত। ন্যায় বিচার না হওয়ায় ফেলানীর পিতা নুরুল ইসলাম ভারতের মানবাধিকার সংস্থা মাসুমের সহায়তায় সে দেশের সুপ্রিম কোর্টে একটি রিট আবেদন করায় মামলাটি বর্তমানে ভারতের উচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এখন উচ্চ আদালতের ন্যায় বিচারের আশায় চেয়ে আছে ফেলানীর পরিবারসহ দেশবাসী।
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্তে কাটাতারের বেড়ার উপর গুলি করে নির্মমভাবে খুন করা হয় কিশোরী ফেলানীকে। ভারতের ১৮১ ব্যাটালিয়নের চৌধুরীহাট ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের গুলিতে নিহত ফেলানীর মরদেহ কাটাতারেই ঝুলে থাকে দীর্ঘ ৪ ঘণ্টা। ফেলানীর ঝুলে থাকা লাশের ছবি দেখে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মাঝে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির দাবির মুখে ২০১৩ সালের ১৩ আগষ্ট ভারতের কোচবিহারে বিএসএফ’র বিশেষ আদালতের সোনারী ছাউনীতে ফেলানী হত্যার বিচার কাজ শুরু হয়। ঐ বছর ৬ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয় ঐ আদালত।
এ ঘটনায় বিষয়টি নিয়ে আবারও সমালোচনার ঝড় উঠলে পরবর্তীতে বিজিবির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মামলার কার্যক্রম পুনরায় শুরু করে বিএসএফ’র বিশেষ আদালত। আবারও অমিয় ঘোষকে নির্দোষ সাব্যস্ত করে পূর্বের রায় বহাল রাখে বিএসএফ’র আধিকারী সিপি ত্রিবেদীর নেতৃত্বে ৫ সদস্যের বিচারিক প্যানেল।
ফেলানীর পিতা নুরুল ইসলাম জানান, বিএসএফ’র বিশেষ আদালতে কন্যা হত্যার ন্যায় বিচার না পেয়ে ২০১৫ সালের ৪ আগষ্ট ভারতের মানবাধিকার সংগঠন মাসুম’র (মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ) সহায়তায় ভারতের উচ্চ আদালতে রিট করেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রিটটি গ্রহণ করে শুনানির জন্য সম্মত হন। ফলে ফেলানী হত্যার ন্যায় বিচার এখন সর্বোচ্চ আদালতের ওপর।
তিনি বলেন, আমি এখনও আশাবাদি ভারতের উচ্চ আদালতে আমার কন্যা হত্যার ন্যায় বিচার পাবো।
সন্তানের নির্মম এ হত্যার কথা মনে হলে এখনও ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা জাহানারা বেগম। সংসারের নানা দুঃখ কষ্টের মাঝেও দাবি করেন অভিযুক্ত অমিয় ঘোষের সর্বোচ্চ শাস্তি। তিনি দাবি করেন তার বুকের ধন ফেলানীকে যেভাবে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ, তেমনি তার সর্বোচ্চ শাস্তি যেন নিশ্চিত করেন ভারতের উচ্চ আদালত। যেন অভিযুক্তের মায়েরও একই কষ্ট অনুভব হয়। সীমান্তরক্ষী সকল সদস্যদের মায়েরা যেন এই শাস্তির কথা ভেবে তাদের সন্তানদের এই শিক্ষাই দেন, বিনা অপরাধে কোনো মায়ের কোল যেন খালি করা না হয়।
ফেলানীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা এখনও ভুলতে পারেননি তার স্বজনসহ এলাকাবাসী। সীমান্ত এলাকায় বাস করা এ মানুষগুলো সব সময় আতংকে দিন কাটান। তাদের দাবি এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচারসহ সীমান্ত হত্যা বন্ধের।
কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন জানান, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রিটটি গ্রহণ করায় এবার ন্যায় বিচারের আশা করছেন তিনি।
ইতোপুর্বে বিএসএফ’র বিশেষ আদালতে দু’বার অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেহেতু ঐ আদালতের বিচারক, বিচারপ্রার্থী, আসামী এবং বিচারকাজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই বিএসএফ’র সদস্য, ফলে সেখানে ন্যায় বিচার প্রাপ্তি দূরহ ছিল। মামলাটি ভিন্ন রাষ্ট্রের হওয়ায় এ মামলার আপিলের সুযোগ আমাদের নেই। আপিল করতে হলে বিএসএফকেই করতে হবে। তারা মামলাটির ন্যায় বিচারের স্বার্থে উচ্চ আদালতের দারস্ত না হওয়ায় ফেলানীর বাবা ও ভারতের একটি মানবাধিকার সংগঠন যৌথভাবে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। আমরা আশা করি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবেন। এ মামলায় ভারতের উচ্চ আদালতে ইতিবাচক রায় হলে সীমান্তে আইন বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে এমনটাই আশা এ অঞ্চলের মানুষের।
মন্তব্য চালু নেই