ফুলকন্যাদের ব্যস্ততা

ফুল ছাড়া কি প্রিয় মানুষকে হৃদয়ের জমে থাকা ভালোবাসার কথা বলা যায়? হৃদয়ে জমে থাকা সেই ভালোবাসা ফুল ছাড়া যেন অসম্পন্নই থেকে যায়। প্রিয় মানুষটিকে মূল্যবান কোন উপহার দিতে পারুক আর নাই পারুক ছোট্ট একটি ফুল তুলে দিয়ে প্রকাশ করতে পারে হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা।

ভালোবাসা প্রকাশের মহামূল্যবান ফুলটি দেশের অগনিত তরুণ-তরুণীসহ সব বয়সের মানুষের হাতে তুলে দিতে ব্যস্ত সময় পার করছে ঝিনাইদহের ফুলকন্যারা। প্রতিবছর বসন্ত বরণ, ভালবাসা দিবস, বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মতো দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। আর এ চাহিদার সিংহভাগ যোগান দিয়ে থাকে এই এলাকার ফুল চাষিরা।

ঝিনাইদহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় মাঠের পর মাঠে চাষ করা হয়েছে গাঁদা, রজনীগন্ধ্যা, গোলাপ ও গ্লাডিয়াসসহ নানা জাতের ফুল। এসব ফুল ক্ষেত থেকে সংগ্রহ ও মালা গাঁথা থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত এই এলাকার মেয়েরাই করে থাকে। ফলে পুরুষের পাশাপাশি মেয়েদেরও কর্মসংস্থান হচ্ছে।

এ এলাকার উৎপাদিত ফুল প্রতিদিন দূরপাল্লার পরিবহনে ভরে চলে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। জাতীয় ও বিশেষ দিনগুলো ছাড়াও সারা বছর এ অঞ্চলের উৎপাদিত ফুল সারা দেশের চাহিদা মেটাতে ভূমিকা রাখে।

কথা হয় কালীগঞ্জ উপজেলার ফুলনগরী বলে খ্যাত বড়ঘিঘাটি গ্রামের ফুলকন্যা নাজমা, নুরজাহান, স্বরসতী ও আয়েশা বেগম জানায়, বছরের বারো মাসই ফুল তোলার কাজ করি। কিন্তু বিশেষ বিশেষ দিন সামনে রেখে কাজ বেশি করতে হয়। আয় উপার্জন ও বেশি হয়।

তারা জানায়, প্রতি ঝোপা ফুল তুলে গেঁথে দিলে ফুল মালিক ১০ টাকা করে দেয়। প্রতিদিন তারা ১২ থেকে ১৮ ঝোপা ফুল তুলতে পারে। অনেকে আবার স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে একটি বাড়ির কাজ ও গৃহপালিত পশু কেনে। এরপর ফুলের কাজ করে কিস্তির টাকা পরিশোধ করে।

এভাবেই এ এলাকার প্রায় প্রতি বাড়ির নারীরা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে কারণে এই এলাকার মানুষ দিনে দিনে এখন বেশ স্বচ্ছল হয়ে উঠছেন।

ঝিনাইদহ কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ জয়নুল আবেদীন জানান, এ বছর জেলায় প্রায় ২শ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে গ্লাডিয়াস, রজনীগন্ধ্যা গোলাপ, গাঁদাসহ নানা জাতের ফুল। উৎপাদন ব্যয় কম, আবার লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকরা ফুল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।

জেলার গান্না, বালিয়াডাঙ্গা, তিল্লা, সিমলা, রোকনপুর, গোবরডাঙ্গা, পাতবিলা, পাইকপাড়া, তেলকুপ, গুটিয়ানী, কামালহাট, বিনোদপুর, দৌলতপুর, রাড়িপাড়া, মঙ্গলপৈতা, মনোহরপুর, সাইটবাড়িয়া, বেথুলী, রাখালগাছি, রঘুনাথপুরসহ জেলার বিভিন্ন গ্রামের মাঠে ফুল চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গাদা ফুল চাষ হয় কালীগঞ্জের বালিয়াডাঙ্গা এলাকায়। এ কারণে সবাই এখন এ এলাকাকে ফুলনগরী বলেই চেনে।

সরেজমিনে ঘুরে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জের মেইন বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়, দুপুর থেকে শত শত কৃষক তাদের ক্ষেতের উৎপাদিত ফুল ভ্যান, স্কুটার ও ইঞ্জিন চালিত বিভিন্ন পরিবহনে নিয়ে আসছেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বালিয়াডাঙ্গা বাজার ও কালীগঞ্জ মেইন বাসস্ট্যান্ড ভরে যায় লাল, সাদা আর হলুদ ফুলে ফুলে।

সারাদেশের আড়তগুলোতে ফুল পাঠাতে আসা একাধিক ফুলচাষিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সারা বছরই তারা ফুল বিক্রি করে থাকেন। তবে প্রতিবছর বাংলা ও ইংরেজি নববর্ষের দিন, স্বাধীনতা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, ভালবাসা দিবস প্রভৃতি দিনগুলোতে ফুলের অতিরিক্ত চাহিদা থাকে। ওই সময় দামও থাকে ভালো। ফুলচাষিরা নিজেরা না এসে সারা বছর তাদের ক্ষেতের ফুল চুক্তি মোতাবেক ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরের ফুলের আড়তে পাঠিয়ে দেন। এ সব স্থানের আড়তদাররা বিক্রির পর তাদের কমিশন রেখে বাকি টাকা পাঠিয়ে দেন। ফলে ফুল চাষিদের টাকা খরচ করে ফুল বিক্রির জন্য কোথাও যাওয়া লাগেনা। তারা মোবাইল বা ফোনালাপের মাধ্যমে বাজার দর ঠিকঠাক করে ফুল পাঠিয়ে থাকেন বলেও জানান কৃষকরা।

দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলেও দ্রুত পচনশীল এ ফসল সংরক্ষণের জন্য নেই কোনো হিমাগার। ফলে যখন বাজারে যোগান বৃদ্ধির কারণে হঠাৎ দাম কমে যায় তখন লোকসানে বিক্রি করা ছাড়া উপায় থাকেনা ফুলচাষিদের। ফলে কৃষকরা বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে।

বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের ফুলচাষি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক জানান, ১৯৯১ সালে এ এলাকায় সর্বপ্রথম ফুল চাষ করেন বালিয়াডাঙ্গার ছব্দুল শেখ। তিনি ওই বছর মাত্র ১৭ শতক জমিতে ফুল চাষ করে স্থানীয় বিয়ে, সামাজিক অনুষ্ঠান ও জাতীয় দিবসগুলোতে ক্ষেত থেকেই বিক্রি করে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা লাভ করেছিলেন। এরপর থেকে এ চাষ বিস্তার লাভ করতে থাকে। ধান পাট সবজি প্রভৃতি ফসলের চাষ করে উৎপাদন ব্যয় বাদ দিলে খুব বেশি একটা লাভ থাকেনা। কিন্তু ফুল চাষ করলে আবহাওয়া যদি অনুকুলে থাকে তাহলে যাবতীয় খরচ বাদে প্রতি বিঘায় ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। ফলে দিন যতো যাচ্ছে এ অঞ্চলে বৃদ্ধি পাচ্ছে ফুল চাষ।

স্থানীয় ফুলচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান জানান, এলাকার কৃষকরা কষ্ট করে ফুল উৎপাদন করলে প্রায়ই তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। মধ্যভোগী ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে অনেক লাভবান হয়। কিন্তু ফুল সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে কৃষকরা কম দামে তাদের হাতে ফুল তুলে দেয়।



মন্তব্য চালু নেই