ফরমালিন নয়, ফলমূলে এখন মানবঘাতি রাসায়নিক
এমনিতেই ফরমালিন আতঙ্কে ভীত দেশের মানুষ। ফলমূল, মাছ-মাংস, শাক-সবজি খেতে নানা সংশয় কাজ করে সবার মনে। ফরমালিনের বিরুদ্ধে রীতিমেতো খড়গহস্ত সরকারও। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ফরমালিনমুক্ত বাজার গড়তে গলদঘর্ম হয়ে উঠেছে। তাই বলে কি থেমে আছে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি? ফরমালিন ছেড়ে তারা এখন ফলমূল, কাঁচা সবজিসহ নানা খাদ্যে ব্যবহার করছে কীটনাশকসহ ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক রাসায়নিক। আর এসব রাসয়নিকযুক্ত খাবার খেয়ে কমে যাচ্ছে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। ছড়াচ্ছে নানা মানবঘাতি ও জটিল রোগ।
বর্তমানে উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির ফলে প্রায় সারা বছরই বাজারে বিভিন্ন ফলমূল পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগুলো আকারে বেশ বড় এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়। কিন্তু উৎপাদন, বিপণন ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যমান নিয়ন্ত্রণে কোনো শৃঙ্খলা নেই। পুরো সেক্টরটিতে চলছে অরাজকতা। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী বেশি উৎপাদন, ফলকে সতেজ রাখা, আকারে বড় করা ও রঙ আকর্ষণীয় করার জন্য বিভিন্ন রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার করে চলেছে। আবার অনেক কৃষক এসব কিছু না জেনেই খাদ্যে ব্যবহার করছে ক্ষতিকারক কীটনাশক।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ফল উৎপাদনে সাইপারমেথ্রিন, ডাইমেথবেট, টাফগর (৪০ ইসি), ছত্রাক নাশক- ডায়মেন এম ৪৫, থিড়ভিট, রিডোমিল, পিজিআর- জিফরেমিন, সাইটোকাইনিন, অক্সিন ইত্যাদি কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। তবে এসব কীটনাশকের সবটাই অনুমোদিত। পরিমিত ও সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করলে কোনো ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হলেই মানবদেহের জন্য ক্ষতি বয়ে আনে।
বিশেষ করে ইথাইলিন জাতীয় গ্যাস ও ইথারেল (এক ধরনের হরমোন), ইথোফোন (নিষিদ্ধ) এবং ক্যালসিয়াম কার্বাইড ব্যবহার করে যেসব ফল পাকানো হয়, তা মানবদেহের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে ইথোফোন (নিষিদ্ধ) স্প্রে বা গ্যাস আকারে ব্যবহার করা হলে ক্ষতি হয় না। কিন্তু সচেতনতার অভাবে দ্রুত কার্যকারীতার জন্য তরল আকারে ব্যবহার করে থাকে কৃষকরা।
কৃষকের অসেচতনতা এবং অজ্ঞানতার কারণেই এ ধরনের কীটনাশকগুলো মাত্রাতিক্ত ব্যবহার করা হয় বলে জানান কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (হর্টিকালচার উইং) ড. আজহার আলী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কলা, আম, আনারস, পেঁপে যখন পাকতে শুরু করে, তখন আপনা থেকেই এসব ফল ইথাইলিন গ্যাস ছাড়ে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা ফল পরিপক্ক হওয়ার আগেই গাছ থেকে তা সংগ্রহ করে এবং বাজার থেকে ইথারেল কিনে এসব ফলের গায়ে স্প্রে করে। ক্যালসিয়াম কার্বাইডের সাহায্যেও ফল পাকানো হয়। ক্যালসিয়াম কার্বাইড পানিভর্তি ড্রাম বা বড় পাত্রে দ্রবীভূত করা হয়। সে পানিতে কলার কাঁদি, আম, আনারস বা পেঁপে চুবিয়ে তোলা হয়। ফলে ওইসব ফল হলুদ রঙ ধারণ করে।’
আজাহার আলী বলেন, ‘ফল পাকাতে ব্যবহৃত উপাদানগুলো খুব বেশি ক্ষতিকর নয়। কিন্তু এগুলো শরীরের উপর তাৎক্ষণিক প্রভাব না ফেললেও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।’
মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ রোধে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যক্রম প্রসঙ্গে আজহার আলী বলেন, ‘সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ ছাড়া কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের কিছুই করার নেই। তবে গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিসের (জিএপি) মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের কাজে এগিয়ে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ জালাল উদ্দিন আশরাফুল হক বলেন, ‘সবধরনের কেমিক্যালেরই একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া থাকে। প্রভাবটা হয়তো একদিনে দেখা যাবে না, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ক্ষতিকর প্রভাব বেশী থাকে। আস্তে আস্তে এই কেমিক্যালগুলো আমাদের শরীরে জমা হয়। এক সময় দেখা যাবে এর প্রভাবে মানবদেহে একটা বিশেষ ধরনের বা কয়েক ধরনের ক্যানসারের সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘এজন্য জনগণকে সচেতন করতে সরকারের উদ্যোগ দরকার। উৎপাদনের স্বার্থে কীটনাশক ব্যবহার করতেই হবে। কিন্তু অবশ্যই তা সহনশীল, পরিমিত ও নিরাপদ মাত্রায় ব্যবহার করতে হবে।’
মন্তব্য চালু নেই