প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকছে বিপন্ন রোহিঙ্গারা

মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালাচ্ছে তাতে ভীতসন্ত্রস্ত দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। সেনা ও সরকার সমর্থিত সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে পড়ছে তারা।

যদিও বাংলাদেশের সরকার বলছে, সীমান্তে কঠোর নজরদারি চলছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে— সীমান্তে নজরদারি থাকলে রোহিঙ্গারা রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে তারা ঢুকে পড়ছে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে। দিনের বেলায় অনুপ্রবেশের ঘটনা দেখা না গেলেও গভীর রাতে ঠেকানো যাচ্ছে না রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের মংডু শহরের উত্তাঞ্চলেরর রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে রাখাইন সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত অত্যাচার নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। এরফলে শত শত রোহিঙ্গা নারী পুরুষ শিশু সন্তানদের নিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে, বনাঞ্চল ও ধানক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছে। দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকলেও রাতের সময় নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ-কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। সীমান্তে বিজিবি-কোস্টগার্ড সদস্যরা দিবারাত্রী টহল জোরদার রাখলেও ফাকঁফোকর দিয়ে ঠিকই ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা। এদের মধ্যে কেউ কেউ নির্যাতনের শিকার হলেও বেশির ভাগ গ্রাণভয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছে।

গত ৯ অক্টোবরে মিয়ানমারের বিজিপি ক্যাম্পে হামলায় ৯ বিজিপি সদস্য নিহত ও অস্ত্র গোলাবারুদ লুটের পর শুরু হয় আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতন। মিয়ানমার সরকারের দাবি— এটি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অভিযান। তবে রোহিঙ্গাদের দাবি সরকার পরিচালিত এ অভিযান মুসলিম নিধনের অভিযান।

এ ছাড়া বাড়ি ঘর, মসজিদ ও দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে শত শত। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। কাজ না পাওয়ায় রোহিঙ্গাদের আয় রোজগার বন্ধ রয়েছে।

ফলে বাচাঁর তাগিদে দেশ ত্যাগে বাধ্য হচ্ছে এমনটি জানালেন গত ২০ নভেম্বর রবিবার ভোরে টেকনাফে অনুপ্রবেশ করা মো. আলম। তিনি জানান, মংডু খেয়ারী প্রাং এলাকায় নিজ বাড়ির সামনে তা ছিল মুদি দোকান। ৮ সন্তান নিয়ে ১০ সদস্যের তাদের পরিবারে অভাব ছিল না। ৪র্থ শ্রেণির ছাত্র রবি আলম, প্রথম শ্রেণির ছাত্র মো. রফিক ও প্রাক প্রথম শ্রেনির ছাত্র মো. হারেসসহ সবাইকে সাথে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এখন কি হাল হবে সে জানে না। স্কুল পড়ুয়া ছেলেদের কী হবে তা ভেবে সে অস্থির। কিন্তু উপায় ছিল না তার।

মুসলিম দেশ একটু হয়ত সহানুভুতি পাবে সে আশায় বাংলাদেশ আসা তার। কিন্তু আজকে ( সোমবার) সে এক টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। কাল তার কী হবে এ নিয়ে চিন্তিত মো. আলম।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে এক সন্তানের জননী রশিদা বেগম। ২০ নভেম্বর রোববার ভোরে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং মিনাবাজার সীমান্ত দিয়ে সে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। স্বামীকে রেখে সে সম্ভ্রম বাচাঁতে পালিয়ে আসে। এক ১০ দিন লেগেছে মিয়ানমারের নিজ গ্রাম পোয়াখালী চাককাটা পাড়া থেকে টেকনাফ পৌঁছতে তার। সাথে ছিল শ্বাশুড়ি বাহারু বেগমসহ অন্য ১০ জন। রাতের বেলায় পাহাড়ি পথ ও ধান ক্ষেত মাড়িয়ে রাত্রে নাফ নদী ক্রস করেছে এরা। পথে পথে কয়েকটি জায়গায় টাকা দিয়ে সে এতদূর পৌঁছতে পেরেছে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ১৯ নভেম্বর শনিবার দুপুরে শুনতে পেয়েছে তার স্বামী মো. সলিমকে মিয়ানমার রাখাইন সন্ত্রাসী ও সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। রশিদা স্বামীর চিন্তায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, প্রচুর ধান বাড়িতে জমিয়ে রাখা ছিল, বাড়ির আঙ্গিনায় বাঁধা ছিল হালের গরু। সবকিছু ফেলে দিয়ে ইজ্জত বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি।

তার স্বামীর কোনো দোষ ছিল না। খবর পাওয়া গেছে চোখ বেঁধে, মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে তার স্বামীকে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে যে ফেরত আসবে সে আশা করা যায় না।

টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা বস্তির চেয়ারম্যান ডা. দুধু মিয়া জানান, দু’ এক দিনের মধ্যে রাতের সময় বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা মুসলিম পরিবার এ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের তাৎক্ষণিক অবহিত করেছেন বলেও দাবি করেন।

তিনি আরো জানান, বিষয়টি কারো জন্যই সুখকর নয়।

এদিকে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকলেও স্বীকার করছে না সংশ্লিষ্টরা। বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা বলছে সীমান্ত স্বাভাবিক রয়েছে।

টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটলিয়ান কমান্ডার লে.কর্ণেল আবু জার আল জাহিদ বলছে, সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্যরা রাতের সময়ও নাফনদীতে টহল জোরদার করেছে। ফাকঁফোকর দিয়ে হয়তো দু এক পরিবার ঢুকে যাওয়া অসম্ভব নয়।



মন্তব্য চালু নেই