প্রবাস জীবনের না বলা কিছু কষ্ট
প্রবাস জীবনের না বলা কিছু কষ্ট
-রিমা বেগম পপি
জীবন বড়ই জটিল। আর এটা জটিল সংসারের প্রতিক্রিয়া। হয়তো ভাবছেন হঠাৎ কেন জীবন নিয়ে এতো রচনা লিখতে বসছি। আসলে এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার পর থেকে জীবন আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর যে কত আনন্দ নিয়ে মানুষ কাটায় তা বলা বাহুল্য। যখন একজন তরুণ টগবগে যুবকে পরিণত হয় ঠিক তখনই অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সংসারের হাল ধরতে হয় অনেকেরই। তেমনি এক প্রবাসী যুবকের অজানা কষ্টের কথা বলতে চাই আজ। আইয়ুবী। খুবই চঞ্চল আর দুরন্ত মনের অধিকারী একটি ছেলে। শৈশব-কৈশোর পেরিয়েছে নিতান্তই নিজের মত করে। সারাদিন স্কুল-কলেজ আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় পার করেছে। অনেক বেলা করে প্রতি দিনই সে বাসায় ফিরে আর তখনই মায়ের বকুনি আর বাবার তীব্র রাগে নিঃশ্চুপ হয়ে যেত সে। দরজার আড়াল থেকে ছোট বোনের স্নেহ মাখা হাসি মুখে ইশারাতে ভাইকে ডেকে খাবার দেওয়া যেন নিত্য দিনের রুটিন ছিল। এভাবেই বেশ কাটছিল দিন।
হঠাৎ করেই আইয়ুবীর বাবা মারা গেলেন। দুষ্টুমী ও মাথা থেকে সরে গেল আইয়ুবীর। ঘরের বড় ছেলে যেহেতু, সেহেতু সংসারের হাল ধরতে হবে। কিন্তু কী করবে সে? সবে মাত্র আই.এ পাশ করেছে। এইটুকু লেখাপড়ায় কী হবে? এদিকে সংসারের এই অবস্থা। দুবেলা মা-বোনদের খাবার মুখে তুলে দেওয়া আইয়ুবীর জন্য বড়ই কষ্টের হয়ে পড়েছে। টেনে টুনেতো এভাবে আর সংসারের হাল চলছে না। সংসারের এই কঠিন পরিস্থিতিতে জীবনের এই ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে তাকে এক সময় পাড়ি দিতে হলো স্বদেশ ছেড়ে প্রবাসে। সকলের সাহায্য-সহযোগিতায় আর অনেক ধার দেনা করে সংসারের এই অভাবের গ্লানি কমাতে তাকে মেনে নিতে হলো একাকীত্বের প্রবাস জীবন। এই সিলেট শহর ছেড়ে যখনই সে প্রবাস জীবনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো মনের ভেতর এক কষ্টের ঝড় বয়ে গেল। নিজের পরিবারকে রেখে একা কখনও কোথায়ও বেশিদিন থাকেনি সে। সব কষ্টকে বুকে চেপে অজানার উদ্দেশ্যে প্লেনে উঠে গেল। বার বার পেছনে ফিরে তাকিয়েছে। এখন আর নয় মনটাকে নিজেই শান্ত করল। মা-বোনকে মাথা গুঁজার ঠাঁই দিতে হবে। দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগাড় করতেই তার দূর দেশে যাওয়া। যাই হোক, প্লেন থেকে নেমেই এক নতুন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো মনের ভেতর। নতুন দেশ, নতুন মানুষ আর নতুন করে নিজেকে সবার সাথে মানিয়ে নেওয়া এ যেন এক অসাধ্যকে সাধন করার মত। আইয়ুবীর এলাকার একজন মানুষ লন্ডনে থাকতেন, আইয়ুবীকে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ জোগাড় করে দিলেন। মাথা গুঁজারও একটা ঠাঁই হয়েছে।
রেস্টুরেন্টের কয়েকজন স্টাফের সাথে থাকবে সে। এদের মধ্যে এক একজন এক এক দেশের। তবে বাংলাদেশী একজনকে সে তার সাথী হিসেবে পেয়েছে। যাই হোক শুরুটা ভালোই কাটলো আইয়ুবীর। দেখতে দেখতে প্রায় চার বছর কেটে গেল। এখন আইয়ুবী তার মায়ের বোনের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছে। কিন্তু এই হাসি ফুটাতে গিয়ে কতবার যে সে নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করেছে তা আইয়ুবীই জানে। দিনে ৬ ঘন্টা কাজ করতো সে। সপ্তাহে পাঁচদিন ছিল কাজের ডিউটি। কিন্তু সে সপ্তাহে ৭ দিনই কাজ করতো। নিজের রুটিন মাফিক পাঁচ দিনে ছয় ঘন্টা করে কাজ শেষে ওভার টাইম ও কাজ করত। যে দুই দিন রেস্টুরেন্টে যেত না সেই দুই দিন একটা লন্ড্রীতে আয়রণের কাজ করত। এই দুই দিন প্রায় একাধারে আট ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে আয়রণের কাজ করত। একাধারে এতটা ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আইয়ুবীর কোমরে ব্যথা হয়ে যেত। এতো কষ্টের একটাই উদ্দেশ্য পরিবারকে সুখি রাখা। আগে যখন দেশে ছিল আইয়ুবী তখন ছুটির দিনটা পুরোটাই ঘুমের মধ্যে কাটিয়ে দিত। আর প্রবাসে এসে ছুটি কি তা যেন ভুলেই গেছে। এই চার বছরে হাতে গুণে দশ দিনই সে ছুটি কাটায়নি। মা-বোনদের সাথে প্রায়ই কথা বলতো আইয়ুবী ফোন করে। মাঝে মাঝে মায়ের জন্য এতো মন খারাপ হতো তার ইচ্ছে করত সবকিছু ছেড়ে মায়ের আঁচলের নিচে লুকিয়ে থাকতে। কিন্তু তা যে হবে না সে কথা আইয়ুবী জানত। মা আদর করে আইয়ুবীর পছন্দের জিনিস রান্না করে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন।
সেই সব স্মৃতি যেন তার চোখের সামনে ভেসে আসছে। সবচেয়ে কষ্ট পায় আইয়ুবী তখন, যখন তার জন্মদিন ও ঈদের দিন আসে। জন্মদিনে তাকে কেউ ফিরনী, পায়েস রান্না করে স্নেহের পরশে খাইয়ে দেয় না। আর ঈদের দিনটা আসলে হতাশায় ভরে যায় তার বুক। লন্ডনে সাধারণত একদিন আগেই ঈদ হয়ে যায়। এই ঈদের দিন আইয়ুবী ফোনটা হাতে রাখে সব সময় যদি মায়ের বোনের কিংবা আত্মীয় স্বজনের ফোন আসে। কিন্তু তার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। দেশে তখন ঈদের আগের দিন চালের পিঠা, সন্দেশ নারকেলের পিঠা তৈরিতে সবাই ব্যস্ত থাকে। আইয়ুবী চিন্তা করে হয়তো মা তার বোনকে বলেছেন একটা ফোন আইয়ুবীকে দেওয়ার জন্য। বোন পিঠা তৈরিতে ব্যস্ত থাকায় হয়তো ভুলেই গেছে। অপেক্ষা করতে করতে সে নিজেই ফোন করে কথা বলে। ঈদের দিন আইয়ুবীর সব বন্ধুরা নানা জায়গায় বেড়াতে যায়। আইয়ুবী ঘরে বসেই থাকে মন খারাপ করে। আর দিন গুণতে থাকে পাঁচ বছর তার কবে শেষ হবে আর কবেই মা-বোনকে দেখতে যাবে। এদেশে এক একজন এক এক দেশের। বাঙালি কাউকে দেখলে হারিয়ে যায় সব আগের ফেলে আসা স্মৃতির ভিড়ে।
একদিন হঠাৎ একটা ফোন আসলো আইয়ুবীর মোবাইলে। সেই ফোন পেয়ে থমকে গেল আইয়ুবী। যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়েছে। আইয়ুবীর বোন ফোনে ভাইকে জানালো মা হঠাৎ করেই মারা গেছেন। আইয়ুবী বুঝতে পারল না সে কী করবে। দেশে আসার জন্য পাগল হয়ে গেল। ওর বন্ধুরা ওকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল। আইয়ুবীর মন যেন মানছে না। বন্ধুরা বলল, আর কয়েকটা মাস তার পর তোমার পাঁচ বছর হয়ে যাবে। তুমি তোমার ইচ্ছেমত দেশে আসা যাওয়া করতে পারবে। মনকে শান্ত কর। জানি তুমি যা হারিয়েছে তা ফিরে পাবার নয়। ভাগ্যকে মেনে নাও। আল্লাহকে ডাক। আল্লাহ তোমার মনকে শান্তি দেবেন। এভাবে বেশ কয়েকদিন আইয়ুবী নিশ্চুপ হয়ে গেল। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া নেই। শুধু কান্না আর কান্না। নিজেকে সে সান্ত্বনা দিতে পারছে না। দেশে বোনের সাথে ফোনে কথা বলছে আর কাঁদছে। বোনও বার বার বলছে ভাইরে মা-মারা যাবার আগে তোকে দেখতে চেয়েছিল।
আমি বুঝতে পারিনি যে মা এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবেন। তোর ছবিটা বুকে নিয়ে মায়ের সেকি কান্না। মা বার বার বলতেন আমার ছেলেকে কি আমি শেষ দেখাও দেখে যেতে পারবো না। জানিস ভাই, মা বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিল। তোকে আমি অনেকবার বলতে, চেয়েছিলাম। কিন্তু মা বারণ করেছে। তুই শোনলে নাকি মাকে নিয়ে শুধু টেনশন করবি। তখন আইয়ুবী বোনকে বলে, তুই আগে কেন আমাকে বলিসনি। আমার মত অভাগা আর কেউ নেই রে বোন। মাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পেলাম না। মায়ের একমাত্র ছেলে হয়েও মায়ের কবরে মাটিটুকুও দিতে পারলাম না। আমার বা অন্ধকারে শুয়ে আছেন। আর আমি বিলাস বহুল বাড়িতে নানা রং এর বাতি জ্বালিয়ে বসে আছি।
এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। এভাবে মায়ের স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে কাঁদে আইয়ুবী। প্রবাসে কেটে গেল আইয়ুবীর পাঁচটি বছর। স্বপ্নকে সত্যি করতে সংসারের হাল ধরতে হারিয়ে গেল আইয়ুবীর জীবন থেকে পাঁচটি বছর। অবশেষে আইয়ুবীর অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। দেশে ফিরে এলো। এই প্রবাস জীবন থেকে নতুন অভিজ্ঞতা পেলো।
সে পেয়েছে অনেক কিন্তু হারিয়ে ফেলেছে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস মাকেই। আসলে এই দুনিয়া একটি কঠিন পাঠশালা। এখানে যতদিন তুমি অন্যের তরে নিজেকে বিলিয়ে দেবে ততদিন সবাই তোমাকে মূল্য দেবে। যখন তুমি একটু নিজেকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে তখন সব কাছের মানুষগুলো তোমাকে ছেড়ে চলে যাবে। এ কথাটি আইয়ুবীর বেলায় সত্য হলো। প্রবাস থেকে দেশে ফিরেছে এক বুক কষ্ট নিয়ে মাকে হারিয়েছে বলে। তখন প্রবাসে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে তার বন্ধুরা। দেশ থেকে তেমন ফোন যায়নি। অথচ আজ সে দেশে এসেছে তাই লন্ডন ফেরত ছেলের কত আত্মীয় স্বজনের দেখা মিলছে।
আইয়ুবী ঘরে এসেই মায়ের কবরের পাশে গেল। কবরের চারপাশের বেড়াগুলোতে বাঁকা ধরে গেছে। অনেকক্ষণ কাঁদল সে। মাকে এতো দিনের না বলা কথাগুলো বলল আইয়ুবী। আর অনুভব করলো হয়তো মা তার কথাগুলো শুনছেন। সে মায়ের কবরের মাটি ছুঁয়ে কাঁদতে লাগল। এভাবেই নিজের মাকে খুঁজতে লাগল আইয়ুবী।
লেখিকা : রিমা বেগম পপি, সিলেট লেখিকা সংঘের সদস্য, নন্দনি সাহিত্য ও পাঠচক্রের সদস্য, সিলেট ছাত্র ও যুব ফেডারেশনের সাহিত্য সম্পাদিকা।
মন্তব্য চালু নেই