প্রবাস জীবনের কষ্ট ও কিছু প্রশ্ন

দারিদ্রপীড়িত মানুষগুলোর কাছে ক্ষুধার চেয়ে বড় ব্যাধি আর নেই। এই ব্যাধি উপশমের চেষ্টা আমাদের সকলের। তবে, ধনিকশ্রেনী ক্ষুধা উপভোগ করে আর দরিদ্র শ্রেনী ক্ষুধা নিবারণ করে জীবন, যৌবন, সম্মান, সম্ভ্রম সব বিকিয়ে দিয়ে।

মাঝে-মাঝে মনে হয় ক্ষুধা-উদ্রেকরকে যদি বোঝানো যেতো তাহলে হয়তো এতটা বৈষম্যের শিকার হতো না মানুষ। কোন আগন্তুকের মায়ের সুরক্ষিত গর্ভ থেকে যখন সুতিকাগারে আগমন ঘটে, তখন থেকেই ক্ষুধায় তাড়িত হতে থাকে সে। আগন্তুক শিশুটি কথা বলতে পারে না। বলতে পারে না, আমি ক্ষুধার্ত। আমাকে খাবার দাও। কিন্তু হাত পা ছোড়াছুড়ি আর চিৎকার করে সে জানান দেয় সে ক্ষুধার্ত। ক্ষুধা নিবারণ হলে, সে হাসতে থাকে। নিজের মনে খেলা করতে থাকে। আবার কখনো শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার অব্যক্ত কান্না হাসির অর্থ ঠিক বুঝে নেয় তার গর্ভধারিণী।

পৃথিবীর আদি থেকেই ক্ষুধাকে পুঁজি করে মানুষের প্রভূ হতে পেরেছে এক দল মানুষ। হাইডেলবার্গ মানুষেরা ছিল বৈষম্যহীন। তার কিছুকাল পরে নিয়েনডারথেল মানুষের মধ্যে থেকেই শুরু হয় বৈষম্য। তখন মানুষ আর বনে-বাদারে ঘুরে বেড়ায় না। গুহায় বাসা করে এবং আগুনের আবিস্কার হয়। আগুন আবিস্কার মানুষের জীবনে বৈপ্লবিক পরির্বতন ঘটে। সামাজিক জীবনে যেমনি স্বচ্ছন্দ বাড়ে, তেমনি বাড়তে থাকে সামাজিক বৈষম্য। মানুষ যখন কৃষির দিকে ঝুকতে থাকে, তখন চরম ভবে দেখা দেয় সেই বৈষম্য। কারণ, কৃষির জন্য দরকার, উর্বর জমি, উৎপাদন ব্যয়, কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি এবং সেচ। পরিবার-তন্ত্রের পর পৃথিবীতে যে সামাজিক-তন্ত্র শুরু হয় তার নাম ‘টোটেম’। এই ‘টোটেম’ সমাজের মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠে সঙ্ঘ।

টোটেম ছিল সমাজ ভিত্তিক, আর সঙ্ঘ গড়ে ওঠে কয়েকটি টোটেমের সমন্বয়। এখন সঙ্ঘর নেতা নির্বাচন হয়, এবং তাদের কথা মতোই সমাজ পরিচালিত হতে থাকে। এর সাথে সাথে মানুষ ক্ষমতার স্বাদ পায় এবং সঙ্ঘের নেতাদের দ্বারা শুরু হয় বৈষম্য। কারণ তখন যৌধ পরিবার ভেঙে পড়ে এবং একক পরিবারগুলোর মধ্যে জমি ভাগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। আর তখনি সঙ্ঘর নেতারা বেছে নেয় উর্বরব জমি, তাদের হাতে থাকে কৃষি উপকরণ এবং যন্ত্রপাতি। তখন তাদের আর কাজ করতে হয় না। উর্বর জমিতে ভাল ফসল ফলে। বছরের খাবার খেয়েও তাদের উদ্বৃত্ত থাকে। এদিকে সাধারণ কৃষকের ভাগ্যে যে সব অনুর্বর জমি, তাতে ফসল ফলে না।

যাও ফলে বছরের তিন মাস, ছ’মাস বা ন’মাস খেতে পারে তারা। বছরের বাকি মাস গুলো অভুক্ত থাকার উপক্রম হয় তাদের। তাই এক রকম বাধ্য হয়েই সাধারণ কৃষকদের যেতে হয় বিত্তশালীদের কাছে। বছর খেয়েও যাদের উদ্বৃত্ত থাকে বহু খাবার। এই সুযোগে সাধরণ কৃষকদের খাটিয়ে আরো ফসল উৎপাদন করতে থাকে সঙ্ঘের নেতারা। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণ কৃষক ধীরে-ধীরে ভূমিহীন হয়ে দাসে পরিণত হয় এবং সঙ্ঘের সভাপতিরা প্রধমে হয়ে উঠে ভূ-স্বামী তার পরে সামন্তরাজ।

এত সব কথা বলার কারণ একটাই, আমরা এখনো এই সব দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়েছি কি না। যদি হয়েই থাকি তবে তা কতটুকু। সেই হিসেব আমাদেরই করতে হবে। আমার বয়স যখন চৌদ্দ বা পনেরো বছর তখন একটি ছবি দেখেছিলাম। ভারতীয় বাঙলা ছবি। নামটা মনে নেই। ছবিটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল দুর্ভিক্ষ। দেশে যখন দুর্ভিক্ষ শুরু হলো, তখন খাদ্য মজুদ করতে লাগলো একদল বুর্জোয়া শ্রেনী। খাদ্য মজুদ করে দুর্ভিক্ষের চেহারাটা আরো শতগুন কঠিন করে তুললো তারা। তার পর অল্প পরিমানে খাদ্য বাজারে ছেড়ে চড়া দামে বিক্রি করতে শুরু করলো। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষকে সর্বশান্তকরতে সময় লাগার কথা নয়। লাগেও নি। শুধু তাই নয়, গ্রামের যুবতীদের চাল দেবার নাম করে ঘরে ডেকে তাদের সম্ভ্রম লুন্ঠনেও নৃশংস ভুমিকা রেখেছিল এই সব আড়তদার, মজুতদারেরা।

সেদিন অ্যাডমিনিট্রেশন স্ট্রীটের ওবায়েদ হসপিটালের (রিয়াদ) করিডোরে দাঁড়িয়ে অঝরে কাঁদতে লাগলাম। যে ছেলেটি মারা গেছে সে আমার নিকট আত্মিয় বা প্রতিবেশী কেউ নয়। তবুও কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিলাম না নিজেকে। ছেলেটির বয়স চৌত্রিশ-পয়ত্রিশ হবে হয়তো। ছেলেটির অকস্মাৎ এই অন্তর্ধান মেনে নিতে পারে নি কেউ। দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে যখন চোখের জল ফেলছি তখন কে একজন এসে বলল, আমার ছোট ভাই আলামিনকে পুলিশে নিয়ে গেছে। মৃত ছেলেটি ছিল আমার ছোট ভাইর বন্ধু। ছেলেটি যখন অসুস্থ্য হয়ে পড়ে, তখন ওর সাথে হসপিটালে এসেছিল আমার ছোট ভাই। এবার কান্না শুকিয়ে ভয় এসে হানা দিল বুকের মধ্যে। এত ভয় আর কোন দিন পাই নি। মনে হচ্ছিল স্বয়ং মৃত্যু দূত আমার সম্মুখে। এত ভয়ের কারণ হচ্ছে, মৃত ছেলেটি ছিল অবৈধ।

এই সৌদি আরবে কি ভাবে মানুষ অবৈধ হয় সে সম্পর্কে দু-চারটি কথা না বললেই নয়। এখানে এক রকম দাসের মতোই বাস করছি আমরা। সেই প্রাচীন গ্রীক, রোম বা আলেকজান্দ্রিয়ার মানুষকে দাস করে হাটে বাজারে বিক্রি হতো, তাদের মধ্যে আবার কোন কোন শক্ত দেহের দাসদের বানানো হতো গ্ল্যাডিএটর। তাদের নিয়ে জুলিয়েস সিজারের রোমক্লোজমের মতো অনেক জায়গায় চলতো মৃত্যু খেলা। এখন হয়তো এতটা নৃশংস নেই মানুষ। কিন্তু এখানে কফিলদের কাছে আমরা দাসের মতোই বন্দি। কফিল হচ্ছে, ভিসাদাতা। তার ইচ্ছে মতোই চলতে হবে আমাদের। কফিল যদি ভাল হয়, আমাদের কপাল ভাল, আর যদি খারাপ হয় তাহলে কপাল খারাপ। কয়েক বছর আগেও একটু সুযোগ ছিল আমাদের। কফালা অর্থৎ ট্রানসফার খোলা ছিল। এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে।

তাই ইচ্ছে হলেও কফিল পরির্বতন সম্ভব নয়। কফিল যদি দয়া করে বাহিরে কাজ করতে দেয়, তাহলে শুধু বাহিরে কাজ করতে পারি আমরা। তার বিনিময়ে তাকে বার্ষিক অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয় আমাদের। আর যদি না করতে দেয়, তবে তার মতেই কাজ করতে হবে। কখনো মরুভূমিতে উট আর ছাগল চড়ানো আবার কখনো কৃষি কাজ। কিছুই করার থাকে না আমাদের। কারণ, এখানে আমরা যারা আসি তাদের মধ্যে শতকরা পঁচানব্বই ভাগ লোকের মাথায় থাকে ঋণের বোঝা। তাই ফেরার সব পথ বন্ধ। উপায় থাকে আত্মহত্যা। সে কথাও যে কেউ-কেউ ভাবে না তা নয়। কিন্তু মরতে পারে না, সংসারের অন্য লোকগুলো কথা ভেবে।

যে মানুষটাকে পরিবারের পক্ষ থেকে বিদেশে পাঠানো হয় অনেক ধারদেনা করে, তার অপমৃতু বা যেকোন দুর্ঘটনা পুরো পরিবারকে পথে বসিয়ে দেবে। তাই যুদ্ধ করতে হয় বেঁচে থাকার জন্য। অনেকেই আছে যারা বিদ্রোহ করে পালিয়ে আসে কপিলের কাছ থেকে। কারণ অনেক কফিল আছে যারা বেতন দেয়না, আবার অনেকেই যে সামান্য বেতন দেয় তা নিজেরই পেট চালাতে কষ্ট হয়। এই সব পালিয়ে আসা লোকগুলো অবৈধ হয়ে থেকে যায় এ দেশে। আবার অনেক সময় কফিল নিজেই টাকা খেয়ে বসে থাকে, ইকামা (ওয়ার্ক পারমিট) করে দেয় না , ফলে অবৈধ হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না আমাদের। এর ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, ভাল কফিলও আছে। কিন্তু কথা একটাই, কফিলের উপর নির্ভর করে আমাদের ভাগ্য। এদেশে আমাদের সাহায্য করার কেউ নেই। দুতাবাসের লোকগুলোর গুনগান করে শেষ করা আমার মতো লোকের কাজ নয়।

যে ছেলেটি মারা গাছে তার কথা বলি। ওর নাম বাবুল। বেশ কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবে ছিল। অবৈধ হবার করণে দেশেও ফিরতে পারছিল না। বেশ কয়েক বছর ধরে সৌদি আরবে ভিসা বন্ধ এবং ট্রানসফার ( তানাজুল) বন্ধ। বাবুল যখন বৈধ ছিল তখনই সে তার কফিলকে পাঁচ হাজার রিয়াল অর্থাৎ বাংলাদেশের মুদ্রার এক লক্ষটাকারও বেশি দিয়েছিল ইকামা নবায়নের জন্য। কিন্তু ওর কফিলের কি সব সমস্যার কারণে ইকামা নবায়ন হয়নি বাবুলের। তাই অবৈধ হয়েই থাকতে হয়েছে তাকে। দেশেও ফিরে যেতে পারে নি, কি খাবে, কি করবে, দেশে কাজ নেই।
আমার ছোট ভাইর সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করলাম।

অনেক বার চেষ্টা করার পর যখন ফোন রিসিভ করছিল না আলামিন, তখন অসহায়ের মতো আবার কাঁদতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টা খানেক পরে ফোন রিসিভ করলো আলামিন। জনলাম, তাকে পুলিশ, স্টেশনে নেয়া হচ্ছে, কেন নিচ্ছে সে নিজেও জানে না। এখনো পুলিশের সাথে গাড়িতে সে। রাত বাড়ছে, ভয়ে কুচকে যেতে লাগলাম। এতটা অসহায় আর কখনো মনে হয়নি নিজেকে। মনে হচ্ছিল, এখনি চলে আসি বাংলাদেশে। এই জীবনের চেয়ে দেশে দিনমজুর হয়ে বেঁচে থাকা অনেক সুখের। তারও ঘন্টা তিনেক পর জানলাম, বাবুল যেহেতু অবৈধ তাই ওর সম্পর্কে জানার জন্যই পুলিশ স্টেশনে নেয়া হয়েছে আলামিনকে। রাতেই ছেড়ে দেয়া হবে ওকে এবং এই লাশের সব দায়-ভার আলামিনকে বহন করতে হবে। রাত বাড়ছে, কাল সকালে ডিউটিতে যেতে হবে।

শুধু মাত্র ক্ষুধা নামক ব্যাধি বা ক্ষুধার অগুন নির্বাপনের রসদ জোগাতেই প্রিয় মাতৃভূূমি ছেড়ে হাজার-হাজার মাইল দূরে এদেশের শ্রমিক হয়ে পড়ে থাকতে হয় আমাদের। বিলাসিতার জন্য কেউ এদেশে আসে না। ফজরের আজানের আগে ঘুম থেকে উঠে সারা দিন হাড় ভাঙা খুটুনি, হাতে-পায়ে, গায়ে- মুখে কালিঝুলি আর রাজ্যের সব ক্লান্তি বুকে নিয়ে রাতে রুমে ফিরতে হয় আমাদের। তার উপর সংসারের চিন্তা-ভাবনা আমাদের আষ্টেপৃষ্টে এমন ভাবে লেগে থাকে, প্রায় প্রতি রাতেই দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠি। তবুও দু’গালের কঠিন চামড়ায় ভাঁজ ফেলে হাসতে হয়। আমাদের কষ্টের কথা কখনো পৌঁছে দিতে পারি না আমাদের পরিবারকে। শত কষ্ট নিজের মধ্যে চেপে রেখে টাকা পাঠাতে চেষ্টা করি, যেন ভাল থাকে তারা।

এখানে আমরা যারা বাংলাদেশীরা আসি তাদের দুরাবস্থার কোন শেষ নেই। আমাদের মধ্যে খুব কম লোকই রয়েছে যারা পূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশে আসে। তাই কনস্ট্রাকশন সাইডে লেবার দেয়া ছাড়া তেমন কোন ভাল কিছুই জোটে না আমাদের কপালে। সেখান থেকেই আমরা কাজ শিখে এগিয়ে চলি। তবে আশার কথা হলো, আশ্চর্য জনক ভাবে কাজ এবং ভাষা শিখে নিতে পারে বাংলাদেশিরা। আমাদের দেশের সরকারগুলো যদি জনগণের কথা ভাবতো তাহলে প্রাবাসীদের মনে এত সব শঙ্কা থাকতো না। নিজেদের দূতাবাসে গেলে সাহায্য পাওয়া যাবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দূতাবাসে যাওয়া মানে আরো নতুন কোন বিপদ গায়ে জড়িয়ে ফিরে আসা।

সংসারের প্রধান যদি স্বার্থপর হয়ে অন্যায়, মিথ্যা, সাম্যহীনতায় ডুবতে থাকে, তখন সংসারের অন্য সদস্যদের সম্মুখে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই থাকে না। আমাদের অবস্থা ঠিক তেমনি।

বাবুলের কথা মনে হলে বুকের রক্ত আর চোখের জল এক হয়ে জমাট বেঁধে শ্বাসরুদ্ধ করে দিতে চায় বার-বার। মৃত্যুর মাত্র আর্ধঘন্টা আগেও সবার সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল সে। মৃত্যু যে এতটা নির্মম হতে পারে কাছ থেকে না দেখলে তা হয়তো কোন দিনই বোঝা হতো না। বাবুলের সেল ফোনের স্ক্রিনে সব সময় একটি ছবি ভেসে থাকতো। ওর ছোট্ট মেয়েটির ছবি। মেয়েটির সাথে দেখা হলো না, আর হবেও না কোন দিন। মেয়েটিকে স্ত্রীর গর্ভে রেখেই বিদেশে আসতে হয়েছিল তার। খুব সকালে কাজে যেতে হতো বাবুলের। ঠিক সেই সময় মতো মেয়েটি বাংলাদেশ থেকে ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে দিত বাবুলের। সেদিনও দিয়েছিল, বাবা কাজে যাবে না ?





সেদিনই সন্ধ্যায় ….। বাবুলের ছোট মেয়েটি যেমনি তার বাবাকে দেখা এবং আদার পাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে, ঠিক তেমিন বাবুলও বঞ্চিত হয়েছে তার মেয়েটাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিতে, আদর করা থেকে। তাই তো অনেকেই ছেলে মেয়ের ছবি বুকের কাছে রেখে নিভৃতে অশ্র“ বিসর্জন দেয়। কেউ জানবে না, কেউ বুঝবে না এই কষ্টের রূপ কত বিভৎস। বেদনার এই ঋণ কে শোধ করবে? সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র না কি বিশ্ব।

সেই ছোট মেয়েটিকে নিয়ে কত সব স্বপ্ন দেখতো বাবুল। ভাল ভাবে পাড়ালেখা করাবে, ভাল মানুষ বানাবে, ভাল ঘর দেখে বিয়ে দেবে। বিয়েতে স্পেনের দামি কম্বল দেবে, গহনা দেবে। তার জন্য এখনি কত রকম পরিকল্পনা ছিল ওর। ও যখন ওর স্বপ্নের কথাগুলো বলতো, তখন ওর চোখে লেগে থাকতো পবিত্রতা আর সুখ। এই দীর্ঘ প্রবাস জীবনের প্রতিটি প্রহরের কষ্টগুলো দিয়ে যা ছিল কেনা। কিন্তু মৃত্যুর কাছে বড় অসহায় মানুষ। এক মুহূর্তেই সব শেষ। লাশটা পর্যন্ত দেশে নেয়া গেলো না। অবৈধ না হলে চেষ্টা করে দেখা যেতো। সেও অনেক কঠিন ব্যাপার। ডাক্তার যখন ওকে মৃত বলে ঘোষণা করলেন, তার মিনিট দশেকের মধ্যেই তাকে নিয়ে যাওয়া হলো হিম ঘরে। এর পর দিন রাত দৌঁড়াতে হলো তাকে দাফন করার জন্য। অনেক নিয়ম কানুন রয়েছে, কাগজ পত্র, টাকা পয়সা। শেষ পর্যন্ত পাঁচ দিন পরে মালাজের একটি সরকারি কবরস্থানে সমাধিত করা হলো বাবুলকে।

প্রিয় পাঠক বন্ধুরা, এটা শুধু বাবুলের একার জীবনের গল্প নয়। প্রবাসী প্রত্যেকটি মানুষের জীবন প্রায় একই রকম। কত মানুষ কাজে গিয়ে মরছে, আরো হৃদয়বিদারক ঘটনার সাক্ষী হয়ে। এই কষ্ট একজন প্রাবসী ছাড়া কেউ বুঝবে না। কারণ, অনুমান বা অনুধাবন করে যেখানে পৌঁছনো যায়, নির্দিষ্ট বেদনা বা কষ্ট তার চেয়ে কোটি-কোটি বা তারও বেশি আলোকবর্ষ মাইল দূরে।

একটি দেশকে এগিয়ে নেবার জন্য সে দেশের যুব সমাজের ভুমিকাই থাকতে হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের দেশের যুবকরা আমাদের দেশটার জন্য কোন অবদানই রাখতে পারছে না। অথচ, তারা তাদের মেধা এবং শ্রম দিয়ে কত কি করছে অন্যের দেশে। ভাবা যায়! এই মুরুভূমিতে তারা ফসল ফলাচ্ছে। একটু সুযোগ পেলে তারা যে সোনার বাংলা গড়তে পারতো তাতে কোন রকম সন্দেহ নেই আমার। আমদের মেধা আর শ্রমে দিনে-দিনে উন্নত হচ্ছে অন্য সব দেশ। একথা ভাবলে খুব কষ্ট হয়।

নিজের দেশে কাজ করে দেশটা এগিয়ে নিয়ে যাবার সুযোগ পেলাম না আমরা। বার-বার মনে হয় কোন ভাবেই স্বাধীন হতে পারছে না বংলার মানুষ। একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড থাকলেই কি স্বাধীনতা পাওয়া যায়? সময়ের সাথে-সাথে পরির্বতন ঘটেছে আগ্রাসনের প্রক্রিয়ার। তাই মাঝে-মাঝে মনে হয় আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি ঠিকই, মুক্ত আমরা হতে পারি নি। দেশটা যেন এদেশের মানুষ চালাচ্ছে না।

একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কোথায় করি সেই স্থানটি পাই না। পাকিস্তানিরা পঁচিশ বছরে এদেশে যে সম্পদ লুট করেছে, তার চেয়ে শতগুন কি লুটে নেয়নি দেশি লুটেরা বাহিনী? এই সব অনিয়ম না হলে কখনোই বিদেশে পড়ে থাকতো হতো না আমাদের। এটা শুধু আমার বিশ্বাস নয়, এদেশের কোটি-কোটি মানুষের মনের কথা। মাঝে-মাঝে বুঝতে পারি না দেশটা কারা চালাচ্ছে, কি ভাবে চলছে, গণতন্ত্র না কি পূজিতন্ত্রের হাতে বন্দি আমরা ? রাষ্ট্র কেন আমাদের দায় নেবে না?

প্রবাসী শ্রমিকের রক্তের ঋণে ঋণী হবে না? দুতাবাসগুলোতে কেন সৎ লোক স্থান পাচ্ছে না? তাহলে বাংলাদেশে কি কোন সৎ মানুষ নেই! এই সব নৈরাজ্য থেকে রক্ষা পেতে হলে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে সচেতন ভাবে। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক যদি দেশে কাজ করার সুযোগ পায় তবেই দেশটা এাগিয়ে যাবে। কেউ রুখতে পারবে না আমাদের। যে গোষ্ঠির অর্থনৈতিক মুক্তি নেই, তাদের দাস হয়েই বেঁচে থাকতে হয়। বাংলাদেশের কিশের অভাব? কেন অর্থনৈতিক মুক্তি নেই আমাদের। সেই ব্যর্থতা কার?

লেখক: কাজী সাইফুল ইসলাম



মন্তব্য চালু নেই