প্রবাসী এক নারীর আহাজারি: ‘আমাকে দেশে নিয়ে যাও, ওরা মেরে ফেলবে’

১৯৯০ সালের দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশে গিয়ে কাজ করার অধিকার পেয়েছিলেন বাংলাদেশের নারীরা। অনেক আগেই এই সিদ্ধান্ত হলেও, সম্প্রতি বেশি নারী শ্রমিক যাচ্ছে বিদেশের মাটিতে কাজ করতে। যাদের বেশিরভাগই গরীব ও স্বামী পরিত্যক্তা অথবা বিধবা। আর নারীদের বেশিরভাগই যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।

নিজের ভাগ্যকে বদলাতে গেলেও, মন্দভাগ্য নিয়ে ফিরে আসছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ সেখানেই নির্যাতনের শিকার হয়ে বরণ করছেন মৃত্যুকে। মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশ তথা- সৌদি আরব, ওমান ও দুবাই দেশে গত তিন মাসে প্রায় ২০০ বাংলাদেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নির্যাতিতা নারীদের অভিভাবকের পক্ষ থেকে পাওয়া অভিযোগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এসব অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, নির্যাতিতা নারীর সবাই পেশায় নারী শ্রমিক হিসেবে বিদেশে কাজ করছেন। তবে যারা গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করেন তারা বেশি মাত্রায় শোষণ, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার শিকার হচ্ছেন। আবার গৃহকর্মে অন্তরীণ পরিবেশ থাকার কারণে নির্যাতনের অনেক ঘটনা প্রকাশিত হয় না। তাই নিরুপায় নারী শ্রমিকেরা সব অন্যায় আচরণ সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন।

নির্যাতিতদের আত্মীয়স্বজনের দেয়া জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রাপ্ত অভিযোগে দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের তিন দেশ তথা সৌদি আরব, ওমান, দুবাই মিলে গত আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরে তিন মাসে ১৯০ নারী শ্রমিক নির্যাতিত হয়েছে। এই তিন দেশে আগস্টে নির্যাতিত হয়েছে ৭৭ নারী, সেপ্টেম্বর ৫৩ এবং অক্টোবর মাসে ৬০ জন। আর এই তিন দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে সৌদি আরবে।

এসব নির্যাতিতা নারীদের মধ্যে একজন ভোলার চরনোয়াবাদের শেফালী বেগম (পাসপোর্ট নং- বিএফ০৫০৬৫৯৯)। গত ৪ সেপ্টেম্বর নিজের দুঃখ ঘোচাতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে যান সৌদি আরব। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে অক্টোবর মাসেই দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের লুকিয়ে ফোন করেন তিনি। ফোনে ওখান থেকে নিয়ে আসার জন্য কান্নাকাটি করেন।

ভগ্নিপতি মো. কলিমুল্লাহকে ফোন দিয়ে শেফালী বলেন, ‘আজকের মধ্যে আমাকে দেশে নিয়ে যাও। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে তারা ঠিকমত খেতে দেয় না, আবার নিয়মিত শারীরিক নির্যাতন করে।’

এ ব্যাপারে তার ভগ্নিপতি কলিমুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘সে (শেফালী বেগম) এখনো বিপদমুক্ত নয়। আমরা সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা আমাদের সঙ্গে ফাজলামো করে। শুধু বলে হবে হবে। কখন হবে এর কোনো ডেট নাই। এদিকে এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারাও বলে- কোনো খোঁজ নাই। অথচ সে (শেফালী) আমার কাছে লুকিয়ে লুকিয়ে তিনবারের মতো ফোন করে কান্নাকাটি করেছিল। তাই ভাবছি ওই এজেন্টের বিরুদ্ধে শিগগিরই মামলা করবো।’

শেফালীর মতো সৌদি আরবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরো আরো অনেক গৃহকর্মী। যাদের মধ্যে রংপুর সদরের মোছাম্মদ রিনা আক্তার, গাজীপুর জয়দেবপুরের আছমা, নরসিংদীর সালমা আক্তার, সিলেট জকিগঞ্জের আরিজা বেগম, নোয়াখালীর সেনবাগের ফাতেমা আত্মীয়-স্বজনের অভিযোগপত্র রয়েছে। এইকইভাবে দুবাইয়ে নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীদের মধ্যে ফরিদপুরের রাজিয়া বেগম, আছিয়া বেগম; আবুধাবিতে নেত্রকোনার দোলেনা, ফরিদপুরের রেখা বেগম; জর্ডানে নির্যাতিত শেরপুরের তহুরা বেগম, ফরিদপুরের তাইজুন নেসা; ওমানে নেত্রকোনার সুমি আক্তার এবং লেবাননে নির্যাতিত মানিকগঞ্জের মিনারা বেগমেরও অভিযোগ আছে।

নারী নির্যাতনের এসব কারণ হিসেবে জানতে চাইলে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরী বলেন, ‘আসলে এসব নারী নির্যাতনের কয়েকটি কারণ আছে। তার মধ্যে প্রবাসী নারী শ্রমিক প্রেরণ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা থাকা, নীতিমালা থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ না করা, প্রাইভেট এজেন্সিগুলোর দৌরাত্ম এবং দূতাবাসগুলোর দায়িত্বে অবহেলা।’

তিনি বলেন, ‘সবগুলো কারণ একটা আরেকটার সম্পর্কযুক্ত। যেমন সরকারের যদি নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতো তাহলে সেখানে অবশ্যই গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু ক্যাটাগরি থাকতো। তাহলে প্রাইভেট এজেন্সিগুলোও নিজের ইচ্ছামত পাঠাতে পারতো না। তারা বিদেশে এমন নারী শ্রমিক পাঠায় যারা নিজের নামও লিখতে পারে না। তাহলে তো একটা ভিন্ন দেশে গিয়ে ভিন্ন ভাষা ও কালচারের সঙ্গে সমস্যা হবেই।’

‘আবার সে দেশে থাকা বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তা হয়তোবা তাদের দায়িত্ব ভালোভাবেন পালন করেন না। কেননা সেখানে যারা যায়, তাদের লিস্ট অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দূতাবাসে থাকে। সেই ডাটা অনুযায়ী তারা যদি মাঝে মধ্যেও খোঁজ খবর রাখেন, তাহলে তো এই ধরনের নির্যাতন অনেকাংশেই কমে যাবে।’ যোগ করেন ফারুক চৌধুরী।

জনশক্তি রপ্তানি ব্যুরোর আগের করা এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ৫৬ হাজার ৪০০ নারী কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে গেছেন, আর ২০১৪ সালে গেছেন ৭৬ হাজার ৭ নারী। মাত্র ২০ হাজার টাকায় তারা এখন বিদেশে যেতে পারছেন। তাই গত ৬ বছরে নারীদের বিদেশে গমনের হার ছয়গুণ বেড়েছে। সরকারিভাবে বিদেশে যাওয়ার খরচ কম হওয়ায় নারী শ্রমিকরা উৎসাহীও হচ্ছেন। কিন্তু একইসঙ্গে বাড়ছে নারী নির্যাতনেরও ঘটনা।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা কোনো নারী গৃহকর্মীকে পাঠানোর পূর্বে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছি। হিউম্যান রাইটসের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সেখানে পাঠাচ্ছি। তবে কিছু কিছু প্রাইভেট রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ বেশি আসছে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। যাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক নির্যাতনের বিষয়টি প্রমাণিত হচ্ছে, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে মামলাও করা হচ্ছে। আবার তাদের লাইসেন্সও বাতিল করা হচ্ছে।’

সব অভিযোগ সত্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অনেকেই বিদেশে গিয়ে ভালো না লাগার কারণে অভিযোগ সাজাচ্ছে। কেউবা মনপুত কাজ না পাওয়ার কারণেও ঢালাওভাবে অভিযোগের আশ্রয় নিচ্ছে। তাই বিষয়গুলো আগে আমরা তদন্ত করছি, তারপর ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে যারা সত্যই এসব নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তাদেরকে আমরা তাড়াতাড়ি সেফ হোমে নিয়ে আসছি। আবার যে মালিকরা এসব কাজের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হচ্ছে।’



মন্তব্য চালু নেই