প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে ফেসবুক স্ট্যাটাস: পেলেন সাড়া
রামপুরা থেকে শিশু পাচারকারী সন্দেহে গ্রেফতারকৃত অদম্য বাংলাদেশের ৪ তরুণের ব্যাপারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। সর্বশেষ গত ১৩ অক্টোবর তাদের জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পর এই আলোচনার পালে আবারও হাওয়া লাগে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ অক্টোবর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন আশীফ এন্তাজ রবি।
বুধবার রাত ১১টায় পোস্ট করা এই খোলা চিঠি মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত স্ট্যাটাসটি ৬ হাজারেরও বেশি শেয়ার হয়েছে। কমেন্টের মাধ্যমে আলোচনায় অংশ নিয়েছেন প্রায় হাজারখানেক ফেসবুক ব্যবহারকারী।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্ট্যাটাসে কমেন্ট করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্যসচিব আবুল কালাম আজাদ। তিনি স্ট্যাটাসদাতাকে এ ব্যাপারে সরাসরি তার সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ জানান। একই সাথে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উপ প্রেসসচিব মো. আশরাফুল আলম খোকনও কমেন্টের মাধ্যমে একই পরামর্শ দেন।
এ ব্যাপারে আশীফ এন্তাজ রবি জানান, এই ঘটনায় তিনি অভিভূত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাড়া দেওয়ার ব্যাপারটি অভিনব এবং ইতিবাচক। এই ধরনের উদ্যোগ সরকারে সাথে জনগণের যোগাযোগকে আরও ঘনিষ্ট করবে বলে তার ধারণা। ইতিমধ্যে তিনি মুখ্য সচিবের সাথে দেখাও করেছেন। মুখ্য সচিব ব্যাপারটি সমাধানের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেছেন বলে তিনি জানান।
প্রজেক্টগুলোর নাম হচ্ছে ৫২, ২১ এবং ৭১। যাদের প্রজেক্টের এই রকম সুন্দর নাম হয়, তাদেরকে মাসাধিকাল ধরে জেলে পচতে হয়।
আশীফ এন্তাজ রবির স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
প্রিয় প্রধানমন্ত্রী,
একদম নিরুপায় হয়ে আপনাকে চিঠিখানি লিখছি। কোনো বেয়াদবি হয়ে থাকলে, অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমি জানি, আপনি বাংলাদেশের ব্যস্ততম মানুষ। দেশের হাজারো সমস্যা নিয়ে আপনাকে সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তবুও আমাদের সমস্যাটি আপনাকে না জানিয়ে পারছি না।
ঢাকা শহরের একদল ছেলেমেয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটা অসাধারণ কাজ করে আসছিল। যুবক ছেলেরা তাদের চা সিগারেটের খরচ বাঁচিয়ে, সেই টাকা দিয়ে রাস্তার ছেলেমেয়েদের পড়াতো, তাদের খাওয়াতো, তাদের বই কিনে দিতো। একদল মেয়ে তাদের হাত খরচের টাকা থেকে এইসব পথশিশুদের নিজের সন্তান জ্ঞান করে যত্ন আত্তি করতো।
এইরকম কয়েকশত ভলান্টিয়াররা মিলে একটা স্কুল দিয়েছিল, নাম মজার স্কুল। তাদের একটা শেল্টার হোমও ছিল। অদম্য বাংলাদেশ নামে তারা এই ব্যাপারটি রেজিস্ট্রেশনও করেছিল।
এটি কোনো ধান্ধাবাজিমূলক এনজিও না। বিদেশ থেকে তারা একটি পয়সাও পায়নি। সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে তারা এটি চালাতো।
মাস খানেক আগে এই সংগঠনের ৪ জনকে অ্যারেস্ট করা হয়। এরা নাকি মানবপাচারকারী। এই ৪ জনের বয়স ১৮ থেকে ২৪ এর মধ্যে।
এদের নেতা আরিফ আরিয়ান। সে কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে গ্রাজুয়েশন করা। নিজের ক্যারিয়ার শিকেয় তুলে দিয়ে সে দিনরাত বাচ্চাদের পেছনে লেগে থাকতো।
আরেকটা ছেলের কথা আপনাকে শুনতেই হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ওর নাম হাসিব। এই ছেলে এইচএসএসসি এবং এসএসসি- দুটো পরীক্ষাতেই এ প্লাস পেয়েছে। জেলে থাকার কারণে এবার কোনও ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারলো না।
আপা, জাকিয়ার গল্প কি জানেন? জাকিয়া এই টিমের অন্যতম সদস্যা। ওরা দুইবোন। টাকার অভাবে নিজের ছোটবোনের পড়ালেখা বন্ধ। তবু এই জাকিয়া মেয়েটা পথের বাচ্চাদের বুকে টেনে নিয়েছিল। নিজের টিউশনির টাকা থেকে এইসব বাচ্চাদের সে পড়াশোনা করাতো, বই কিনে দিতো। রাস্তায় যেসব বাচ্চাদের দেখলে আমাদের মতো ভদ্রলোকের গা ঘিন ঘিন করে, জাকিয়া তাদের নাকের ময়লা নিজ হাতে মুছে দিতো। একদম শিশু বাচ্চাদের বাথরুম ট্রেনিংটিও সে করাতো। কিছু কিছু মেয়ে, মা হিসেবেই জন্মায়, জাকিয়া হচ্ছে এই ধরনের মেয়ে। এই মাসের ১৭ তারিখে জাকিয়ার পরীক্ষা। আর মাত্র ৩ দিন বাকি। আপা, আর মাত্র ৩ দিন বাকি।
আপা, আমরা প্রশাসনের নানান স্তরে কথা বলেছি। এরা যে মানবপাচারকারী নয়, এটা গোটা বাংলাদেশের মানুষই জানে। এদের সাথে যুক্ত শত শত ভলান্টিয়াররা অবাক হয়ে ভাবছে, এটা কোন বাংলাদেশ?
ওরা তো তরুণ, ওরা তো নবীন। ওদের কাঁচা চোখ। কিন্তু, এই দেশের সবচেয়ে সোনার ছেলেমেয়েরা যখন এইভাবে জেলে পচে তখন আমাদের মতো পোড় খাওয়া মানুষরাও অবাক হয়ে ভাবে, এটা কোন বাংলাদেশ?
আপা, আমরা অনেকের দরজায় দৌড়েছি। অনেক আশ্বাস শুনেছি, অনেক আশারবাণীও শুনেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। আমরা আর পারছি না। আপনি নিজে এবার বিষয়টার দিকে নজর দিন। পুরো ব্যাপারটা ভাল করে তদন্ত করুন। কোন কর্মকর্তা অতি উৎসাহে, নিজের স্বার্থে এইসব দেবতুল্য তরুণদের ফাঁসাচ্ছে কিনা, সেই খবর আপনিই বের করতে পারবেন।
হয়তো কোনো বড় চক্রান্ত হচ্ছে। এই চক্রান্তের ফলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। ঢাকা শহরের একদল নিবেদিত প্রাণ তরুণ তরুণী কেবল জানবে, এই দেশে ভাল কাজের কোনো মূল্য নেই। তারা জানবে, এই দেশ অবিচারের, এই দেশ অনাচারের।
গুলশানের এক কিশোরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সে মদ্যপ অবস্থায় তার বাবার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিল। বন্ধুর সাথে কার রেসিং করতে গিয়ে গাড়িটা উঠিয়ে দিয়েছে এক রিকশার উপর। শোনা যাচ্ছে, সেই রিকশার আরোহী ছিলেন একজন মা। তার কোলের শিশুটি এই ঘটনায় মারা গেছে।
যারা নিরপরাধ তরুণদের মানবপাচার সাজিয়ে জেলে ভরছে, তারা কেন গুলশানের এই ঘটনায় কাউকে এখনও গ্রেফতার করেনি? গ্যাপটা আসলে কোথায়?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গ্যাপটা খুঁজে বের করা কিন্তু আসলেই জরুরি। এই গ্যাপ কেবল আইনের শাসনের গ্যাপ নয়। এটা মূলত জনগণের সাথে রাষ্ট্রের গ্যাপ। কারা এই গ্যাপ তৈরি করছে? কাদের স্বার্থে এমনটা করা হচ্ছে?
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা করজোড়ে আপনার কাছে বিনীত প্রার্থনা জানাচ্ছি, আপনি এই সংকটের সমাধান করুন। আমরা আপনার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখি বলেই এই অনুরোধ করলাম। অন্য কিছু না।
আমরা কারও অন্যায্য মুক্তি চাইছি না, কারও গ্রেফতারও চাইছি না। আমরা শুধু এই গ্যাপটার ব্যাপারে আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আপনার উপর আমাদের আস্থা আছে।
আপনাকে অশেষ শুভ কামনা।
পুনশ্চ ১: এইসব ছেলেদের ৩ টা প্রজেক্ট আছে। প্রজেক্টের গুলোর ব্যাপারে বিস্তারিত না বলি। আপনার সময় কম। প্রজেক্টগুলোর নাম হচ্ছে ৫২, ২১ এবং ৭১। যাদের প্রজেক্টের এই রকম সুন্দর নাম হয়, তাদেরকে মাসাধিকাল ধরে জেলে পচতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি বুঝতে পারছেন, এই গ্যাপটি আমাদের জন্য কত বড় গলার ফাঁস হয়েছে?
পুনশ্চ ২ : আমরা এই ব্যাপার নিয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্র সচিব, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান সকলেরই কাছেই গিয়েছি। তবু এটার কোনো সমাধান হচ্ছে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, গ্যাপটি কিন্তু শক্তিশালীও বটে।বাংলা ট্রিবিউন
মন্তব্য চালু নেই