প্রতি রাতেই চলছে ‘ব্লক রেইড’ : বুটের শব্দে ঘুম ভাঙছে মেস বাসিন্দাদের
রাজধানীর বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও মেসে প্রতি রাতেই চলছে পুলিশের বিশেষ অভিযান ‘ব্লক রেইড’। জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে চলছে পুলিশের এ অভিযান। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বুটের শব্দে ঘুম ভাঙছে ছাত্রাবাস ও মেসের বাসিন্দাদের। গভীর রাতের এ অভিযানে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এক ধরনের আতঙ্ক।
তবে বেশিরভাগ অভিযান শেষে শূন্য হাতেই ফিরছেন আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কোনো কোনো এলাকায় পুলিশের পক্ষ থেকেও মেস উঠিয়ে দেয়ার জন্য মালিকদের তাগাদা দেয়া হচ্ছে।
এক্ষেত্রে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে মেস সদস্যদের বাসা ছেড়ে দেয়ার নোটিশও দিচ্ছেন মালিকরা। এতে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর বিভিন্ন মেসে বসবাসরত প্রায় ১০ লাখ বাসিন্দা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর গত কয়েক দিনে পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অর্ধ শতাধিক মেস ও ছাত্রবাসে হানা দিয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য পুরো এলাকা ঘিরে ব্লক রেইড চালাচ্ছে রাতভর। এ সময় মেসের বাসিন্দা ও মালিকদের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগও উঠেছে। অনেকে বলছেন, অভিযান চলাকালে পুলিশ মেসের বাসিন্দাদের অনেকের সঙ্গে আসামির মতো আচরণ করছে। মেস মালিকদেরও অভিযানের সময় রাতভর জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
মেসের মালিকদের কয়েকজন যুগান্তরকে জানিয়েছেন, সঠিক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালালে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তথ্যপ্রমাণ ছাড়া তল্লাশির নামে তারা হয়রানি না করার জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ করেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ব্যাচেলরদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়া-না দেয়ার ব্যাপারে মালিকদের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তবে ভাড়াটিয়াদের সব তথ্য সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে কয়েক হাজার মেস ও ছাত্রাবাস রয়েছে। এসব মেসে ছাত্র ছাড়াও চাকরিজীবী, চাকরিপ্রত্যাশী বেকার ও নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করেন। রাজধানীতে মেসে বসবাস করেন এমন লোকের সংখ্যা একেবারে কম নয়। বিভিন্ন সূত্রমতে, এ সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
জানা গেছে, গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় (তাজ মঞ্জিল) অভিযানের পর প্রতি রাতেই কোনো না কোনো এলাকায় মেস ও ছাত্রবাসে পুলিশের অভিযান চলছে। এর মধ্যে গত ২৭ জুলাই মোহাম্মদপুর লোহার গেট এলাকার কয়েকটি মেসে অভিযান চালায় পুলিশ। ২৮ জুলাই অভিযান চালানো হয় ঢাকা কলেজের একটি ছাত্রাবাসে। রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত পরিচালিত ওই অভিযানে পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি।
২৯ জুলাই একযোগে অভিযান চালানো হয় রাজধানীর রায়েরবাজার. হাজারীবাগ, মধুবাজার, জিগাতলা, পশ্চিম ধানমণ্ডির ৭/এ নম্বর সড়কের বিভিন্ন মেসে। একই রাতে শুধু রায়েরবাজারে ১১টি ভবনে এবং হাজারীবাগে ১২টি ভবনে অভিযান চালানো হয়।
হাজারীবাগের এক বাসার মালিক বুধবার বলেন, যেভাবে ব্লক রেইড দেয়া হচ্ছে, এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে পরিবার নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। কারণ ভাড়াটিয়া মেস সদস্যদের অনেকেই বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন। এ অবস্থা আর কিছুদিন অব্যাহত থাকলে ভাড়াটিয়া পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি জানান, তার দুটি বহুতল ভবনের অধিকাংশ ফ্ল্যাটেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা ভাড়া থাকতেন। এখন তারা ভয়ে বাসা ছেড়ে দিচ্ছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, শুক্রবার ঢাকার হাজারীবাগের একটি মেসবাড়ি থেকে ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যারা শিবিরের নেতাকর্মী। এছাড়া হাজারীবাগ থানার ইন্সপেক্টর মো. মনিরুজ্জামান জানান, মঙ্গলবার রাত দেড়টার দিকে ১৮৯ মধুবাজার হোল্ডিংয়ের ওই বাড়ির নিচতলায় ‘ব্লক রেইড’ চালানো হয়। ওই মেস থেকে ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পাশাপাশি সেখান থেকে বিপুল সংখ্যক উগ্র মতবাদের বই ও সরকারবিরোধী লিফলেটও উদ্ধার করা হয়েছে। নাশকতার পরিকল্পনা করার জন্য তারা সেখানে বৈঠক করছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্রেফতারকৃতদের সাইফুল ইসলাম নামে ৩২ বছর বয়সী এক যুবক নিজেকে ছাত্রশিবিরের নেতা দাবি করেছেন। সাইফুল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিন মাস আগে ২২ হাজার টাকা ভাড়ায় তারা ওই বাসায় ওঠেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা ঢাকায় এসেছেন।
গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রাজাবাজার এলাকার কমপক্ষে ১১টি মেসে তল্লাশি অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এর আগের দিনও মোহাম্মদপুর, রমনা এলাকার ব্যাচেলর বাসায় অভিযান চালায়।
শেরেবাংলা নগর থানার ওসি গোপাল গণেশ বিশ্বাস বলেন, রাজাবাজার এলাকায় গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় ধরে পুলিশ ছয় থেকে সাত তলাবিশিষ্ট ১১টি ভবনে তল্লাশি চালানো হয়।
তবে তল্লাশিকালে কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তির কোচিং করতে আসা শিক্ষার্থীরা এই ভবনগুলোর বিভিন্ন কক্ষ ভাড়া নিয়েছে।
ওসি গোপাল আরও জানান, মেসগুলোতে বসবাসকারী ছাত্রদের পরিচয়পত্র এবং তথ্যাদি পুলিশ যাচাই করে দেখেছে। কয়েকজনের পরিচয়পত্র বা তথ্যাদির প্রমাণ না থাকায় মোবাইলে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ তাদের সন্দেহ দূর করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে বাসা-বাড়িতে এ অভিযান চলছে। তবে এ অভিযানের কারণে যাতে কোনো নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
রাজধানীর আফতাবনগর (জহিরুল ইসলাম সিটি) আবাসক এলাকার বি ব্লকে ৩ নম্বর রোডে একটি বহুতল ভবনের (পিস তাজমহল) একটি ফ্ল্যাটে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ছাত্র কয়েক বছর ধরে মেস হিসেবে ব্যবহার করছেন। পুলিশি ঝামেলা এড়াতে ওই ফ্ল্যাটটির মালিক ইতিমধ্যে তাদের বাসা ছেড়ে দেয়ার নোটিশ দিয়েছেন। হঠাৎ করে বাসা ছেড়ে দেয়ার নোটিশে এ মেসের বাসিন্দারা পড়েছেন বিপাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জঙ্গি আস্তানা খুঁজে বের করার কৌশলসহ নানা ধরনের দিকনির্দেশনা দিয়ে সম্প্রতি রাজধানীর পুলিশের সব অপরাধ বিভাগকে চিঠি দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। এরপরই শুরু হয়েছে পুলিশের বিশেষ অভিযান ‘ব্লক রেইড’। এদিকে পুলিশি অভিযানের ভয়ে যেসব বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়ার তথ্য ফরম পূরণ করে এতদিন থানায় জমা দেননি, তারাও এখন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিচ্ছেন। ভাড়াটিয়াদের কারও আচরণ সন্দেহজনক মনে হলেই, তাৎক্ষণিকভাবে তা নিজ উদ্যোগে পুলিশকে অবহিত করছেন বাড়ির মালিকরা।-যুগান্তর
মন্তব্য চালু নেই