প্রতিবন্ধি ডাক্তার প্রভাংশু বিমল বড়ুয়ার জীবন সংগ্রাম

তিনি একজন দুই পা বিহীন প্রতিবন্ধি। পেশায় একজন হোমিউপেতিক ডাক্তার। বয়স তার ৭৪। তার সংসারে নেই কোন ছেলে। ৬ কন্যা নিয়ে তার সংসার। ৫০ বছর তার ডাক্তারী পেশার পরিধী। দেড় বছর বয়সে তার পিতা প্রতাপ চন্দ্র বড়ুয়া মারা যান। তাকে লালন পালন করেন তার মা হেমলতা বড়ুয়া। আর লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ করেন তার বড় ভাই সুদানশু বিমল বড়ুয়া। বর্তমানে সে বড় ভাই আর নেই। তিনিও মারা যান।

তার জীবন সংগ্রামের শেষ নেই। যাকে নিয়ে এই লেখা তার নাম প্র্রভাংশু বিমল বড়ুয়া। বাড়ী ডাবুয়া ইউনিয়নের উত্তর ডাবুয়া বড়ুয়া পাড়ায়। তিনি দীর্ঘ ৫০ বছর যাবত আমিরহাট বাজারের একটি দোকানেই তার ডাক্তারী পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি লাঠিছড়ি কিয়াং স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা, ডাবুয়া উচ্ছ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ ইং সনে মেট্রিকুলেশেন পাস,পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহরের ফিরিঙ্গি বাজার জাকের হোসেন হোমিউপেতিক কলেজ থেকে দুই বছরের কোসে ব্যচলার অব মেডিসিন হোমিউপেত ডিগ্রি অর্জন করেন। পাশ করার পর আন্দরকিল্লাহ ডাক্তার কখন্দ্র লাল চৌধুরী এম এর কাছ থেকে একবছর প্রশিক্ষন নেন। এরপর ১৯৬৫ ইং সনে রাউজানের হলদিয়া ইউনিয়নের মোহাম্মদ আমিরহাট বাজারের মরহুম রুহুল আমিন সওদাগরের বেড়া ও টিন সেটের একটি দোকান ভাড়া নেন। সেখানে ডাক্তারী পেশা শুরু করেন। তখন ঐ দোকানের ভাড়া ছিল মাত্র দশ টাকা। তখনকার রোগী প্রতি ফিস ছিল আঠানা তথা ৫০ পয়শা।

ডাক্তারী পেশার ফাঁকে ১৯৭১ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রাউজানের বিনাজুরী এলাকার নির্মল বড়ুয়ার মেয়ে জোসনা রানী বড়ুয়াকে বিবাহ করেন। তিনি প্রতিবন্ধি হলেও বউ আনার জন্য বিনাজুরী যেথে হয়নি তাকে। তাদের ধর্মীয় নিয়ম নীতিতে চলন্ত বিবাহ রিয়াজ চালু থাকায় বাড়ীর মুরব্বিরা গিয়ে নববধু নিয়ে এসেছিল। বিবাহের পর একটি ছেলে জন্ম নিলেও অসুস্থতার কারনে আড়াই বছর বয়সে ছেলেটি মারা যায়। এর পর একে একে ছয়টি কণ্যা সন্তান জন্ম নেয়। আশ্চার্য হলেও সত্য তিনি ছয় মেয়েকে মেয়ে হিসেবে খাটো করে দেখেনি। বরং এই ডাক্তারী পেশার ইনকাম থেকে ছয় মেয়েকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি মাস্টার্স পাস করিয়েছেন। বর্তমানে ৪ কণ্যা বিনা রানী বড়ুয়া,বকুল রানী বড়ুয়া,প্রতিমা রানী বড়ুয়া,অনুপম বড়ুয়া বিবাহ হলেও অন্য দুই মেয়ে নিরুপমা বড়ুয়া ও আলপনা বড়ুয়া মাস্টার্স ফাইনালে স্টাডিতে আছেন। মেয়ে জামাইরা সকলে প্রতিষ্ঠিত। একজন ফটিকছড়ি উপজেলার প্রাইমারি রিসুস সেন্টারে কর্মরত ,আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার , এলোপেতিক ডাক্তার অন্যজন ব্যবসায়ী। তিনি আমিরহাট বাজারের একজন বয়োজষ্ট ডাক্তার হলেও তার চলাফেরায় কেউ বুঝতে পারবে না তার বয়স ৭৪।

বৃদ্ধার কাটায় তার বয়স হলেও এখনও সমান্তরালে অসংখ্য রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে অনেক মুক্তিযুদ্ধাকে গোফনে চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। তিনি বলেন মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য মন কাদঁত কিন্তু আমার দুই পা প্রতিবন্ধি হওয়ায় আমি যুদ্ধ অংশগ্রহন করতে পারিনি। তিনি যখন আমিরহাট বাজারে ডাক্তারী পেশায় নিয়োজিত হচ্ছেন তখন বাজারে ১০/১৫ টি দোকান ছিল। এই প্রবিণ ব্যক্তি ১৭ বছর আমিরহাট বাজারের সেক্রেটারির দায়ীত্ব পালন করেন। তার দোকানের সামনা সামনি হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন কার্যালয় হওয়ায় অনেক চেয়ারম্যান মেম্বারের শালিশ বিছার অনেক পুরানো স্মৃতি তার এখন মনে পড়ছে। বর্তমানে যে দোকানে বসে ডাক্তরী পেশা করছেন সে দোকানের দশটাকার ভাড়া এখন সাড়ে সাতশ টাকা। সে প্রথম ৫০ পয়সার রোগীর ফিস এখন রোগী মাফি হাজারের উর্দ্ধে।

তিনি প্রতিদিন সকাল ৯টায় চেম্বারে হাজির হয়ে একটানা রাত ৮ টা পর্যন্ত চেম্বার করেন। তার চেম্বারে কোন সহযোগী নেই। তার অভিবাহিত দুই মেয়ে প্রতি সাপ্তাহে তার চেম্বারের প্রয়োজনীয় ঔষধ গুলো চট্টগ্রাম শহর থেকে এনে দেন। তিনি রিকশা করে চেম্বার ও বাড়ীতে আসা যাওয়া করেন। ছোটকালে পিত্রহারা এই হোমিউপেতিক ডাক্তার প্রবাংশু বিমল বড়ুয়াকে তার দুই পা প্রতিবন্ধি হলেও তাকে তার মনেবলে পিছিয়ে রাখতে পারেনি। সংসারের পাশাপাশি তিনি তার সাধ্যমতে স্কুল কলেজ ও তাদের ধর্মীয় উপসানালয়ে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন অনেক। তার অসংখ্য রোগী এক নামে তাকে চিনেন ল্যাংঘা ডাক্তার।

আমিরহাট বাজারের সাধারন সম্পাদক এস এম বাবর জানান ডাক্তার বাবু একজন ভাল মানুষ। তার জীবনে কারো সাথে ঝগড়া হয়েছে এমন নজির নেই। তার চিকিৎসা সেবা এই অঞ্চলের জন্য খুব নামকরা। আমি ডাক্তার বাবু এই বাজারে তার ডাক্তারী বয়স আমার বয়স থেকে বেশি। আমি যা বর্তমান দেখেছি তিনি একজন প্রতিবন্ধি হয়েও মানুষকে অকাতরে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে ৭৪ বছরের বয়সী একজন মানুষ ঘরে আর উপাসানালয়ে থাকার কথা। কিন্তু তিনি এখনো এতদ অঞ্চলের মানুষকে রাত দিন চিকিৎসা সেবা দিয়ে মহৎ কাজটি করে যাচ্ছেন। সৃষ্টিকর্তা তার কর্মগুলোর মাধ্যমে তাকে চিরদিন মানুষের মাঝে বাচিয়ে রাখুক সেটি কামনা।



মন্তব্য চালু নেই