পেশাদার বাহিনী বনাম অখ্যাত ৮ যুবক
দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টার চেষ্টার পর শিশু জিহাদ উদ্ধার অভিযান স্থগিত করে ফায়ার সার্ভিস। এরপরই স্থানীয় কয়েকজন যুবক উদ্ধার চেষ্টায় নামে। মাত্র ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় তারা সরকারি পেশাদার বাহিনীর ২৩ ঘণ্টার চেষ্টাকে সম্পূর্ণ ব্যর্থ প্রমাণ করেন।
শুরু থেকে রশি নামিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে উদ্ধারের চেষ্টা করে ফায়ার সার্ভিস। এরপর ক্যামেরা নামিয়ে শিশুটির অবস্থান শনাক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। শেষ পর্যন্ত পাইপে কিছু নেই বলে সিদ্ধান্ত দেন খোদ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
শনিবার দুপুরের ‘পাইপে কোনো মানব শিশু নেই’ ঘোষণা দিয়ে অভিযান স্থগিত করা হয়। এরপর স্থানীয় কয়েকজন যুবক লোহার তার দিয়ে তৈরি একটি জালের সঙ্গে কেবল টিভির ম্যানুয়েল ক্যামেরা বেঁধে পাইপের ভেতরে পাঠিয়ে শিশু জিহাদকে উদ্ধার করেন। এতে অবশ্য ফায়ার সার্ভিস তাদের ক্রেন ও কয়েকজন কর্মী দিয়ে সহায়তা করেছে।
উদ্ধারের আগে পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থ অভিযানের চিত্রটি এরকম
গতকাল শুক্রবার বিকেল ৩টায় খেলতে গিয়ে পরিত্যক্ত গভীর নলকূপের পাইপে পড়ে যায় শিশু জিহাদ। পাইপের কাছে থাকা এক শিশু জিহাদের কান্না শুনতে পায়। এরপর এক তরুণীও জিহাদের কান্না শুনতে পান। ছড়িয়ে পড়ে শিশু জিহাদ পাইপের মধ্যে পড়ে গেছে।
বিকেল চারটার দিকে খবর ছড়িয়ে পড়লেও উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয় পাঁচটার পর। শুরুতে স্থানীয়রা দড়ি নামিয়ে শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। তাদের মতে, শিশুটি বেশ কয়েকবার দড়ি ধরে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু তখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি সে বেঁচে আছে কি না।
ফায়ার সার্ভিসের ব্যর্থ অভিযান পেশাদার বাহিনী বনাম অখ্যাত ৮ যুবক
সন্ধ্যা ৬টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দলের একজন জানান, শিশুটি পাইপের ভেতর থেকে সাড়া দিচ্ছে। সে বেঁচে আছে। এতেই গণমাধ্যম যেমন বেশি সজাগ হয়ে ওঠে তেমনি তৎপর হয় উদ্ধারকারী দলও। তখন তাকে সুস্থ রাখতে দড়ির মাধ্যমে জুস, খাবার ও পানি পাঠানো হয়। পাইপ দিয়ে সরবরাহ করা হয় অক্সিজেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দাবি করেন, শিশুটি খাবার ও জুস খেয়েছে। সে তার বাবার সঙ্গে কথাও বলেছে।
এবার দড়ি নামিয়ে শিশুটিকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ফায়ার সার্ভিস। তবে পাইপের গভীরতা নিয়ে তাদের সঠিক ধারণা তখনো ছিল না। প্রথমে বলা হয়েছে ৩শ ফুট তারপর ৪শ এরপর প্রায় ৬শ ফুটও বলা হয়েছে।
রশি প্রযুক্তি ব্যর্থ হওয়ার পর ১৭ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপের মধ্যে থাকা সাবমার্সিবল পাম্পের চিকন পাইপটি কেটে কেটে ক্রেন দিয়ে টেনে তোলা হয়। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল এই পাইপের নিচের কোথাও শিশুটি আটকে আছে। কিন্তু পাইপ তোলার পর সেরকম কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
রাত সাড়ে ১১টা। পাইপের মধ্যে নেমে শিশু উদ্ধারে প্রস্তুত রানাপ্লাজায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া বশির আহমেদ। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৬শ ফুট গভীরে তাকে নামতে দেননি ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক।
তখন বুয়েটের ম্যাকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্যাচার নামের একটি যন্ত্র তৈরি করে এর মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান পরিচালনার কথা বলেন। তবে তার আগে ক্যামেরা দিয়ে শিশুটির অবস্থান শনাক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়।
অবশেষে এলো ওয়াসার ক্যামেরা। ইনটেক ক্যামেরাটি পাইপে নামাতে বেশ কিছু সময় ব্যয় হলো। চালু হওয়ার পরও বন্ধ হয়ে গেল মাঝপথে। আবার চালু হলো কিন্তু কোনো শিশুর শরীর দেখা গেল না দেখা গেল শুধু কিছু কাগজ আর পোকামাকড়। দাবি করা হলো, পাইপের শেষ মাথা পর্যন্ত পৌঁছেছে ক্যামেরা।
এবার পাইপে শিশু পড়ে যাওয়ার পুরোটাই গুজব বলে দাবি করলেন উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া এনএসআইয়ের যুগ্ম-মহাপরিচালক আবু সাঈদ রায়হান।
অবশ্য আশা ছেড়ে দেয়া হয়নি। ঢাকা ওয়াসার হয়ে কাজ তৃতীয় পক্ষের একটি প্রতিষ্ঠান। এবার এলো তাদের ক্যামেরা। ক্যামেরা নামানো হলো। তারাও দাবি করলেন, নিচে কোনো শিশুর অস্তিত্ব নেই।
তখন উদ্ধার অভিযানের কার্যত সমাপ্তি ঘোষণা করলেন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বললেন, ‘উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ক্যামেরা নিচে নামানো হয়েছিল, সেখানে মানুষের কোনো অস্তিত্ব দেখা যায়নি। কিছু কীটপতঙ্গের ছবি দেখা গেছে। ক্যামরায় দেখে মনে হচ্ছে সেখানে কেউ নেই। তারপরও পাইপের নিচে যে আবর্জনা আছে সেগুলো তুলে আমরা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখবো।’
এসময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করলেও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি।
শনিবার দুপুর আড়াইটায় সংবাদ সম্মেলন করে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আলী আহমদ খান উদ্ধার অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দেন।
পাইপটি থেকে মাত্র ১০-১২ গজ দূরে এই সংবাদ সম্মেলন শেষ করার ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মাথায় একটি হাতুড়ে পদ্ধতিতে শিশুটিকে উদ্ধার করে স্থানীয় কয়েকজন যুবক।
ঝালাই দিয়ে তৈরি করা একটি রডের খাঁচায় ক্যাবল টিভির ম্যানুয়েল ক্যামেরা ও ইস্পাতের তারের জাল দিয়ে এই বিশেষ যন্ত্র তৈরি করা হয়। ফারুকের নেতৃত্বে উদ্ধারে ব্যবহৃত বিশেষ যন্ত্রটি তৈরি করেন লিটু, আবু বকর সিদ্দিক, আব্দুল মজিদ, আব্দুল কাদের চৌধুরী, সুজন দাস রাহুল, শাহ মো. আব্দুল্লা মুন এবং শরিফুল ইসলাম। তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত থাকলেও মানবতার সেবায় এক।
শুক্রবার ৩ ঘণ্টার চেষ্টায় এই খাঁচাটি তৈরি করেন তারা। রাতেই এরা এটি ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু ফায়ার সার্ভিস অনুমতি দেয়নি।
এ টিমের সদস্য আব্দুল মজিদ একজন ইলেকট্রিশিয়ান। রানাপ্লাজা ধসের পর সেখানকার উদ্ধারকারী টিমের সদস্য ছিলেন তিনি। রাহুল ছিলেন রানাপ্লাজার স্বেচ্ছাসেবক। আর শরীফুল ইসলাম একজন গাড়ি ব্যবসায়ী বলে জানা গেছে।
পেশাদার বাহিনী হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও ওয়াসার এই ব্যর্থতায় খোদ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। এই বাহিনীর সক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আর বিভিন্ন সময় সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি গুজব বলে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতাও সবাইকে অবাক করেছে।
যদিও ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক আলী আহমেদ দাবি করেছেন, ‘আমরা স্থগিত করছিলাম, তবে তখনও আমাদের কর্মীরা সেখানে ছিল। এলাকাবাসী আমাদের সহযোগিতা করেছে। সবার সহযোগিতায় শিশুটি উদ্ধার হয়েছে।’
মন্তব্য চালু নেই